banner

শনিবার, ১৪ Jun ২০২৫ ইং, ,

Daily Archives: June 12, 2025

 

শোনো, বন্ধু হও! প্যারেন্টিং মানে আদেশ নয়, সহযাত্রা

বাসায় ফিরে এসে যখন দরজায় আপনার ছোট্ট সন্তান ছুটে আসে, কিংবা বৃদ্ধ মা-বাবা এক কাপ চায়ের অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকেন—তখন আপনি কি ভাবেন? আপনি কি শুধু নির্দেশ দেন, নাকি একটু নরম সুরে, সহমর্মিতায় কথা বলেন? পরিবার মানে শুধু কর্তৃত্ব নয়, পরিবার মানে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বোঝাপড়ার সম্পর্ক, যেখানে সবাই একে অপরের বন্ধু।

অনেকেই মনে করি, সন্তান জন্ম দিলেই আমরা “ভালো” বাবা-মা হয়ে যাই। কিন্তু সন্তানের জন্য সত্যিকারের ভালো পিতামাতা হয়ে ওঠা আলাদা ব্যাপার। এটা দায়িত্ব, ধৈর্য ও দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়।

❝আমার সন্তান আমার স্বপ্ন নয়, সে নিজের স্বপ্ন নিয়ে জন্ম নিয়েছে❞
প্যারেন্ট হিসেবে, আমি আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারি না। আমি তাকে শুধু দেখাতে পারি ভালোটা কী, মন্দটা কী। আমি পার্থক্য চিনতে শেখাতে পারি যাতে সে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

কিন্তু আমাদের সমাজে কী ঘটে? ছেলেমেয়েদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় বাবা-মার ইচ্ছার গদি। তারা যদি আকাশে উড়তে চায়, আমরা তাদের পাখা কেটে দেই। যদি তারা সমুদ্রে ভাসতে চায়, আমরা বলি—না, তোমাকে শুধু ডাক্তার হতে হবে। জাহাজের নাবিক হওয়া মানেই জীবন নষ্ট।

এই যে চাপ, এই ডমিনেশন—আমি এর ঘোর বিরোধী। আমরা কখনো তাদের জিজ্ঞেস করি না, “তুমি কী হতে চাও?” “তোমার স্বপ্ন কী?” বরং আমরা নিজেদের অপূর্ণ স্বপ্নগুলো তাদের উপর চাপিয়ে দিই। এটা কি পিতামাতার দায়িত্ব? নাকি এক ধরণের মানসিক আগ্রাসন?

শুধু নম্বর নয়, জীবনটাও গুরুত্বপূর্ণ
আমরা সন্তানদের এমনভাবে লালন পালন করি, যেনো তারা আমাদের কর্মচারী। পরীক্ষায় ভালো নাম্বার আনতে বলি, মানে আনতেই হবে। পাশের বাসার মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার, সুতরাং আমার মেয়েকেও হতে হবে। কিন্তু পাঁচ মিনিট সময় নিয়ে কি আমরা কখনো জানতে চেয়েছি—সে আসলে কী হতে চায়?
সে কি উড়তে চায়, না ডুবতে চায়? তার চোখের স্বপ্নগুলো কি আমরা সত্যিই দেখি?

আমরা এই জটিল প্রতিযোগিতামূলক সমাজে আমাদের সন্তানদের এমন একটা দৌড়ে নামিয়ে দিচ্ছি, যেখানে তারা নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। এক সময় দেখা যায়—চাপ নিতে না পেরে একটা শিশু আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। তখন আমরা কেবল বলি—“ও খুব দুর্বল ছিলো।” আসলে, আমরা কি তার পাশে ছিলাম?

🌱 বন্ধু হোন, বোঝার চেষ্টা করুন
একজন আদর্শ অভিভাবক মানে “বন্ধু” হওয়া। তার সাথে হাঁটা, তার স্বপ্ন শুনা, ভুল করলে ভালোবেসে শেখানো। একসাথে সিদ্ধান্ত নেওয়া—কীভাবে সে ভালো মানুষ হতে পারে। তাকে এমন পরিবেশ দেওয়া, যেখানে সে ভয় নয়, ভালোবাসা নিয়ে বড় হতে পারে।

আমার সন্তান, আপনার সন্তান, আমাদের বাবা, আমাদের মা—প্রতিটা জীবনই মূল্যবান। ইনডিভিজুয়াল জীবন মানেই আলাদা এক জগৎ। চলুন না, প্রতিটা জীবনের প্রতি সম্মান রাখি।

📌 সন্তান কোন ‘প্রজেক্ট’ নয়-সে একজন মানুষ
সন্তান আমাদের “প্রজেক্ট” না যে ঠিক করে দেওয়া যাবে কোথায় পৌঁছাবে। সে একজন স্বতন্ত্র মানুষ। তারও অনুভূতি আছে, চিন্তা আছে, স্বপ্ন আছে। তাকে বোঝা, তাকে ভালোবাসা, তাকে স্বাধীনভাবে বাঁচতে দেওয়াটাই পিতামাতার দায়িত্ব।

শুধু বলবেন না, “আমি তোমার জন্য সব করেছি।” বরং এমন কিছু করুন যাতে সে নিজে বলতে পারে, “আমার মা-বাবা আমার জন্য একটা বেঁচে থাকার জায়গা ছিলেন।”

Photo Credit: Sahlah

 

শিশুর স্মৃতিশক্তি বাড়াতে করণীয় ও বর্জনীয়

শিশুদের শারীরিক যত্নের পাশাপাশি মানসিক বিকাশে সচেতনতা থাকা জরুরি। বিশেষ করে জন্মের পর প্রথম পাঁচ বছর হলো শিশুর মস্তিষ্ক গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়টাতেই স্মৃতিশক্তি প্রভাবিত হওয়ার ভিত্তি তৈরি হয়। তাই অভিভাবক হিসেবে কিছু কাজ নিয়মিত করলে শিশুর মনে রাখার ক্ষমতা আরও উন্নত হতে পারে।

করণীয়
১. খেলাধুলার মাধ্যমে শেখানো:
শিক্ষাকে আনন্দময় করতে হলে খেলাধুলা ও গেম-ভিত্তিক শেখানো কার্যকর। মেমোরি গেম, ধাঁধা, শব্দজট, চিত্রপরিচিতি—এসব খেলার মাধ্যমে শিশুর শেখার প্রতি আগ্রহ বাড়ে এবং শেখা বেশি সময় ধরে মনে থাকে।

২. কল্পনা করার অভ্যাস গড়ানো:
শিশুকে গল্প শোনানোর পর বলা যেতে পারে, “এবার চোখ বন্ধ করে ভাবো, তুমি কী দেখলে?”—এভাবে কল্পনাকে সক্রিয় করলে স্মৃতিও দীর্ঘস্থায়ী হয়।

৩. শেখা বিষয় অন্যকে শেখাতে উৎসাহ:
যে জিনিসটা সে শিখেছে, তা যদি কাউকে (যেমন ছোট ভাই/বোন, দাদি-নানি) শেখাতে পারে, তাহলে বিষয়টি তার মনে আরও ভালোভাবে গেঁথে যায়। এতে তার আত্মবিশ্বাসও বাড়ে।

৪. ভেঙে ভেঙে শেখানো:
বড় কোনো তথ্য বা অধ্যায়কে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে শেখালে শিশুর পক্ষে তা সহজে মনে রাখা সম্ভব হয়। প্রতিটি ধাপকে বোঝার সুযোগ দিলে তার ধারণা আরও পরিপক্ব হয়।

৫. হাইলাইট এবং রঙের ব্যবহার:
শিশুদের জন্য পড়ার সময় গুরুত্বপূর্ণ শব্দ বা বাক্য রঙিন কলম দিয়ে হাইলাইট করে দেওয়া যেতে পারে। শিশুরা রঙের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, যা তার মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে।

৬. দৈনন্দিন রুটিনে শেখার সময়:
শিশুর জন্য একটি নির্দিষ্ট পড়ার ও শেখার সময় নির্ধারণ করলে সে অভ্যাস গড়ে তুলতে শেখে। শেখার সময়টা যেন চাপমুক্ত ও আনন্দদায়ক হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

৭. গল্প বলার অভ্যাস গড়ে তোলা:
ঘুমানোর আগে গল্প বলা শিশুর কল্পনাশক্তি ও শব্দভাণ্ডার বাড়ায়। পাশাপাশি, গল্পের ধারাবাহিকতা মনে রাখার চেষ্টা করাও স্মৃতিশক্তি উন্নত করে।

৮. শরীরচর্চা ও খেলাধুলা:
দৌড়, লাফঝাঁপ, বল খেলা, সাইকেল চালানো—এসব শারীরিক কসরত শিশুর রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে, মানসিক চাপ কমায় এবং শেখার আগ্রহ বাড়ায়।

৯. পুষ্টিকর খাদ্য:
শিশুর খাদ্যতালিকায় রাখুন ডিম, মাছ, দুধ, বাদাম, তাজা ফল, সবজি এবং যথাসম্ভব প্রাকৃতিক খাবার। চকলেট, সফট ড্রিংকস বা ফাস্টফুড কমিয়ে দিলে মনোযোগ বৃদ্ধি পায়।

১০. পর্যাপ্ত ঘুম:
বয়স অনুযায়ী শিশুকে ৮-১০ ঘণ্টা ঘুমাতে দিতে হবে। গভীর ঘুমই তার মস্তিষ্ককে পুনরায় সজীব করে এবং শেখা মজবুত করে।

১১. আবেগিক নিরাপত্তা:
শিশু যেন তার ভুল বলার ভয়ে ভীত না থাকে বা প্রশ্ন করতে সংকোচ না করে, সেজন্য তাকে সহানুভূতির সঙ্গে বড় করতে হবে। এতে শেখার আগ্রহ বাড়ে।

১২. নিয়মিত বইপড়া:
কমিক বই, ছবি সহ গল্পের বই বা ইসলামিক শিশুতোষ বই পড়ার অভ্যাস গড়লে সে শব্দ চিনতে শেখে, ভাষা রপ্ত করে এবং কল্পনা শক্তি বাড়ায়—যা সবকিছু মিলিয়ে স্মৃতিকে জোরদার করে।

বর্জনীয়
শিশুকে অতিরিক্ত পড়ার চাপ দেওয়া যাবে না। এতে শেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যায়।

তার প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হওয়া বা উত্তর না দেওয়া একেবারেই উচিত নয়। এতে সে ভবিষ্যতে জিজ্ঞেস করতে ভয় পায়।

“অমুকের মতো হতে হবে” বলে তুলনা করা থেকে বিরত থাকুন। এতে শিশুর আত্মসম্মানবোধ নষ্ট হয়।

প্রতিযোগিতা বা পরীক্ষার চাপে না রেখে শেখার আনন্দটা উপভোগ করতে দিন।

টিভি, মোবাইল, ট্যাব—এসব ডিভাইসে অতিরিক্ত সময় কাটানো শিশুর মনোযোগ ও স্মৃতির বড় ক্ষতি করে।

বড়দের ঝগড়া বা চিৎকার শিশুর মানসিক স্থিতি নষ্ট করে; তাই ঘরের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ
যদি উপরের সব কৌশল অনুসরণ করেও শিশুর মধ্যে স্মরণশক্তি, মনোযোগ বা আচরণগত সমস্যা লক্ষ করা যায়, তাহলে শিশুবিশেষজ্ঞ বা মনোবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। কখনো কখনো সমস্যার পেছনে শারীরিক বা নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল কারণও থাকতে পারে।

এই পরামর্শগুলো শুধু শিশুদের মেধা বাড়ানোর জন্য নয়, বরং তাদের সুন্দর মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পথও তৈরি করে।