বাংলাদেশের হাজার বছরের গৌরবময় ইতিহাস আর ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো স্থাপত্যশিল্প। এই ভূখণ্ডের নয়নাভিরাম মসজিদগুলো যুগে যুগে বিমোহিত করেছে অগণিত দর্শনার্থী আর ইতিহাসপ্রেমী মানুষকে। তবে এমন একটি মসজিদের কথা কি শুনেছেন, যার গোড়াপত্তন হয়েছিল মাত্র একটি ডিম দিয়ে?
হ্যাঁ, হবিগঞ্জ জেলার এক নিভৃত পল্লী প্রজাতপুরে দাঁড়িয়ে আছে এমনই এক মসজিদ—যার পেছনে লুকিয়ে আছে এক মহীয়সী নারীর অতুলনীয় ত্যাগ, ধৈর্য ও একাগ্রতা।
সরাসরি গল্পে আসা যাক। হবিগঞ্জ সদর থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরের এই প্রজাতপুর গ্রামের এক নারী, যিনি ‘বেঙ্গির মা’ নামে পরিচিত, নিয়ত করেছিলেন নিজের উপার্জিত অর্থেই গড়ে তুলবেন একটি মসজিদ। স্বামীর অঢেল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তিনি সে অর্থ স্পর্শ করেননি।
ঘটনা ১৯০২ সালের। প্রজাতপুর ও লালাপুর গ্রামের মাঝামাঝি একটি স্থানে এই মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন তিনি। শুরুটা ছিল একটি মাত্র ডিম দিয়ে! সেই ডিম মানত করে একটি মুরগির নিচে রাখেন তিনি। ধীরে ধীরে সেই ডিম থেকে ছানা, ছানা থেকে ডিম—এভাবে একসময় একটি মুরগির খামার গড়ে তোলেন বেঙ্গির মা।
খামারের মুরগি বিক্রি করে জমাতে থাকেন টাকা। এক সময়, নিজ চেষ্টায় এক লাখ টাকা জোগাড় করেন এবং তা দিয়েই নির্মাণ করেন মসজিদ। তিনি প্রথমে এর নাম রাখেন ‘এক আন্ডার মসজিদ’। সময়ের সাথে মসজিদটির আসল নাম হয়ে ওঠে—‘বেঙ্গির মায়ের মসজিদ’।
আজও শতবর্ষ পেরিয়ে সেই মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। মসজিদের মূল ভবন এখনো অক্ষত রয়েছে, যদিও ২০০৯ সালে এলাকাবাসী এর বর্ধিত অংশ সংস্কার করেন এবং সম্প্রতি আবার রং করা হয়।
মসজিদের খতিব মাওলানা আলমাছ উদ্দিন বলেন, “আমি মসজিদের ইতিহাস শুনে বিস্মিত। নিয়ত থাকলে মানুষ কী না করতে পারে!”
বেঙ্গির মার উত্তরপুরুষ রাকিল হোসেন বলেন, “আমার দাদির দাদি বেঙ্গির মা শুধুমাত্র একটি ডিম থেকেই যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, তা এখনো আমাদের জন্য গর্বের বিষয়।”
বর্তমানে মসজিদ পরিচালনা কমিটিতে আছেন বেঙ্গির মার বংশধর রূপ উদ্দিন, লন্ডনপ্রবাসী আবদুল হারিছ, ব্যবসায়ী হেলিম উদ্দিন, রাকিল হোসেন ও শামীনুর মিয়া।
এলাকাবাসীর দাবি, এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে উন্নীত করে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়া হোক সরকারের পক্ষ থেকে।
এক ডিম থেকে শুরু হয়ে গড়ে ওঠা এই মসজিদ কেবল একটি ধর্মীয় স্থাপনাই নয়, আত্মনিবেদনের এক চিরন্তন স্মারক।