‘মা’ এই ছোট্ট শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে বিশাল এক পৃথিবী। মা শুধু একটি সম্পর্ক নয়, ভালোবাসা, মমতা, ত্যাগ ও আত্মনিবেদনের অপর নাম। একজন নারীর জীবনে মাতৃত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ ও পরিপূর্ণ অভিজ্ঞতা। আর এই মাতৃত্বকাল যেন নিরাপদ হয়, সে দায়িত্ব সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্র-সবার।
বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর প্রায় ২১ কোটি নারী গর্ভধারণ করেন। তাদের মধ্যে দুই কোটির বেশি নানা ধরনের জটিলতায় ভোগেন, এবং প্রায় ৮০ লাখ নারীর জীবন প্রসবজনিত কারণে হুমকির মুখে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে ৮০০ নারী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। এর বাইরেও ৭০ লাখ নারী প্রসব পরবর্তী গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতায় আক্রান্ত হন এবং আরও প্রায় ৫ কোটির বেশি নারী ভোগেন দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যায়।
বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি আরো উদ্বেগজনক। প্রতি বছর প্রায় ১২ হাজার নারী গর্ভধারণ ও সংশ্লিষ্ট কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি লাখ জীবিত সন্তানের জন্মে ১২৩ জন মায়ের মৃত্যু হয়। আর প্রতিদিন গড়ে ১৫ জন মা প্রাণ হারান প্রসবজনিত জটিলতায়।
দেশের প্রান্তিক এলাকাগুলোর চিত্র আরও করুণ—প্রায় ৫৩ শতাংশ নারী এখনও বাড়িতেই সন্তান প্রসব করেন, যেখানে নিরাপদ ও মান-সম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি দুর্লভ। এছাড়া নবজাতকের মৃত্যুহারও উদ্বেগজনক—প্রতি এক হাজার নবজাতকের মধ্যে ২১ জন মারা যাচ্ছে।
নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতের লক্ষ্যে ১৯৮৭ সালে নাইরোবিতে প্রথম বিশ্ব নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাংলাদেশে ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতিবছর ২৮ মে ‘জাতীয় নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
এই দিবস পালনের উদ্দেশ্য হলো—
মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস,
নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা,
গর্ভাবস্থায় প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও চিকিৎসা নিশ্চিতকরণ,
নারীর মাতৃত্বকালীন অধিকার প্রতিষ্ঠা।
২০২৫ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে: “মাতৃস্বাস্থ্যে সমতা; বাদ যাবেনা কোনো মা”। এটি একটি সময়োপযোগী বার্তা, যা সকল শ্রেণি-পেশার নারীদের জন্য নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করার আহ্বান জানায়।
মাতৃত্বকালীন সংকটের কারণসমূহ
নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতে দেশে কিছু মৌলিক চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে:
দক্ষ মিডওয়াইফ ও প্রশিক্ষিত চিকিৎসাকর্মীর অভাব
জরুরি ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর ঘাটতি
প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের অভাব ও অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অপারেশনের বেড়ে চলা
গর্ভকালীন স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও টিকাদানের প্রতি উদাসীনতা
দরিদ্রতা ও পুষ্টিহীনতা
কর্মজীবী নারীদের উপর গর্ভকালেও কঠিন শ্রমের চাপ
পরিবার ও সমাজের অসচেতনতা
বর্তমানে দেশে প্রায় ২২ হাজার প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ প্রয়োজন, অথচ রয়েছেন মাত্র এক হাজারের মতো। ফলে নারীরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে করণীয়
নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি:
✅ গর্ভকালীন সময়ে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
✅ পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ
✅ প্রয়োজনীয় টিকা ও ওষুধ গ্রহণ
✅ ভারী কাজ ও মানসিক চাপ থেকে বিরত থাকা
✅ গর্ভকালীন জটিলতা দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে যোগাযোগ
✅ দক্ষ মিডওয়াইফ ও চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব
✅ প্রসব-পরবর্তী পর্যাপ্ত সেবা ও বিশ্রাম নিশ্চিত করা
সঙ্গে থাকতে হবে পরিবার ও সমাজের সহানুভূতি, সচেতনতা এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ।
মাতৃত্বকালীন সময়ে নিরাপত্তা নারীর অধিকার—এটি যেন বিলাসিতা নয়, বরং মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়। নিরাপদ মাতৃত্ব কেবল একজন মায়ের জীবন নয়, একটি প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করে। তাই ‘মাতৃত্ব হোক নিরাপদ, অধিকার হোক সুরক্ষিত’—এই শ্লোগান হোক আমাদের সকলের অঙ্গীকার।
রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার একত্রিত হয়ে যদি সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করে, তবে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী মাতৃমৃত্যুর হার ৭০-এ নামিয়ে আনা সম্ভব।
আমরা চাই, প্রতিটি মা যেন তার মাতৃত্বকালীন সময়টি কাটাতে পারেন সম্মান, সেবা ও নিরাপত্তার সঙ্গে।