গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ‘নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ২০২৫’ প্রকাশিত হয়েছে। আমি মনে করছি, এই প্রতিবেদনের একটি পর্যালোচনা জরুরি, যাতে এর গ্রহণযোগ্যতা এবং বাস্তবায়নের দিকগুলো যাচাই করা যায়। প্রায় দুইশো পৃষ্ঠার এই বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে মোট ১৭টি অধ্যায় রয়েছে। এটি প্রণয়ন করা হয়েছে বর্তমান নারী নীতির ভিত্তিতে, এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সুপারিশও করা হয়েছে।
যারা সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারীদের নিয়ে কাজ করেন, তারা এই প্রতিবেদনের বড় একটি অংশকে ইতিবাচক হিসেবে দেখবেন বলেই মনে হয়। নারীর উন্নয়ন, মেধার বিকাশ এবং গণমাধ্যমে নারীর উপস্থাপনা—এই বিষয়গুলোতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা এসেছে। প্রতিবেদনটি প্রতিটি খাতের জন্য কেবল বর্তমান নয়, পরবর্তী সরকারগুলোর করণীয়ও তুলে ধরেছে, যা একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয় এবং ভালো পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি করে।
তবে কিছু বিষয় আছে যেগুলো পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে এই প্রতিবেদনকে আরও বিস্তৃত ও গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব।
প্রথমত, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে দেশে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক পালাবদলের সময় নারীদের সক্রিয় ভূমিকা এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। দেশের প্রতিটি স্তরের নারী তখন ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটানোর আন্দোলনে সাহসিকতার সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন। এই অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে, তা যেন পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং একটি আর্কাইভে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়—এমন একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা দরকার।
দ্বিতীয়ত, বর্তমানে শহরাঞ্চলে নারী ও কন্যাশিশুর জন্য সূর্যের আলো, খোলা জায়গায় নিরাপদে হাঁটার সুযোগ এবং প্রাইভেসি সহ শরীরচর্চার ব্যবস্থা কোনো বিলাসিতা নয়, বরং একটি প্রয়োজনীয় বিষয়। স্বাস্থ্যকর প্রজন্ম গঠনে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, অথচ অবহেলিত। এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রতিবেদনটিতে থাকা উচিত।
এবার আসা যাক কিছু নির্দিষ্ট সুপারিশে, যেগুলো পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে:
১। ধারা ৩.২.১.১, ১২.৩.১.১ (জ) ও ১২.৩.২.৩-এ যৌনকর্মীদের সুরক্ষা ও শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হলেও, এই পেশায় বাধ্য হয়ে আসা নারীদের সামাজিক পুনর্বাসনের ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি। এতে করে এই পেশায় থাকা নারীরা যেমন ভবিষ্যতে পুনরায় নিপীড়নের শিকার হতে পারেন, তেমনি আরও নারীদের এই পেশায় ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা উচিত যেন তারা সম্মানের সঙ্গে বিকল্প জীবনে ফিরে যেতে পারেন, তাদের সন্তানদের পড়াশোনার সুযোগ নিশ্চিত হয় এবং দালালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
২। ধারা ৩.২.২.১.২-এ বিবাহ বিচ্ছেদের সময় মোহরানা আদায় নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু ইসলামী পারিবারিক আইনে মোহরানা বিবাহের সময়ই পরিশোধযোগ্য। এটি বিবাহ বিচ্ছেদের সাথে সম্পর্কিত নয়। তাই এখানে আইন অনুযায়ী মোহরানা বিবাহের সময়েই আদায়যোগ্য—এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বলা উচিত এবং তা বাস্তবায়নে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ থাকা দরকার।
৩। ধারা ৩.২.২.১.১১ ও ৩.২.৩.১.১-এ সকল ধর্মের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের প্রস্তাব এসেছে, যা আমাদের সমাজের বহুধর্মীয় বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না। এই সুপারিশ CEDAW-এর একটি প্রভাব হতে পারে, তবে আমাদের দেশে প্রতিটি নাগরিক যেন নিজের ধর্ম অনুযায়ী পারিবারিক ও সম্পত্তির অধিকার পায় এবং প্রয়োজনে আদালতের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করতে পারে—এমন সুপারিশ থাকা উচিত।
৪। CEDAW (Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women) আন্তর্জাতিকভাবে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার একটি সনদ, যা বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালে সংরক্ষণসহ স্বাক্ষর করেছে। সংরক্ষিত ধারাগুলোর মধ্যে রয়েছে ধারা ২ এবং ধারা ১৬(১)(c), যেগুলো ইসলামী শরীয়াহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিবেচনায় সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। কিন্তু এই প্রতিবেদন সংরক্ষণ তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে, যা অপ্রয়োজনীয় এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অসম্মানসূচক। বরং সনদে স্বাক্ষরকালে যেভাবে এই সংরক্ষণ রাখা হয়েছিল, সেটি বজায় রেখেই এর বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানোর সুপারিশ করা উচিত ছিল।
সবশেষে আমি মনে করি, দেশের শিক্ষিত ও সচেতন নারীদের প্রতিনিধিত্বে একটি নতুন কমিশন গঠন করে এই প্রতিবেদনটি সংশোধন করা জরুরি, যাতে এটি সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।
-মারদিয়া মমতাজ