banner

শনিবার, ১২ এপ্রিল ২০২৫ ইং, ,

Daily Archives: April 12, 2025

 

গাজার সাহসি কণ্ঠস্বর মাহা হুসাইনি

যুদ্ধের ধুলোবালিতে ঢাকা এক জনপদ, যেখানে প্রতিদিন সূর্য ওঠে ধ্বংসস্তূপের ওপরে, যেখানে শিশুর কান্না মিশে যায় বোমার বিস্ফোরণে, যেখানে জীবন মানে এক অনিশ্চিত অপেক্ষা। গাজার সেই অগ্নিগর্ভ মাটিতে, ভয় আর মৃত্যুর মাঝেও কেউ কেউ দাঁড়িয়ে থাকেন সত্যের জন্য। তাদের হাতেই রচিত হয় ইতিহাসের সেই অধ্যায়, যা দুনিয়ার শক্তিমানরা মুছে ফেলতে চায় বারবার।
এমনই এক সাহসি কণ্ঠস্বর মাহা নাজিহ আল হুসাইনি—একজন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক, একজন
মানবাধিকার কর্মী, এক অকুতোভয় কণ্ঠস্বর, যিনি ভয়কে জয় করে বারবার বলেছেন, “আমার কণ্ঠ যদি স্তব্ধ হয়ে যায়, তোমরা চুপ থেকো না!”

মাহা নাজিহ আল হুসাইনি একজন সাহসী ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী, যিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সংবাদ প্রচার করে আসছেন। জন্ম কায়রোতে হলেও ২০১৪ সালে ইসরায়েলি হামলার সময় থেকে তিনি গাজার ঘটনাবলী কভার করতে শুরু করেন। তার বিশ্বাস, সংবাদ দেখা বা না দেখার ওপর যুদ্ধ থামা-না থামার কোনো সম্পর্ক নেই, বরং সাংবাদিকদের দমন করেই ইসরায়েল গাজার সত্য ঘটনাগুলো আড়াল করতে চায়।

সংবাদ মাধ্যমের শক্তি সম্পর্কে মাহা সচেতন। তিনি জানেন, যে কোনো শাসকগোষ্ঠী খবর ধামাচাপা দিতে প্রচুর শক্তি ব্যয় করে। ফলে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরাসরি সংবাদ পরিবেশনার ঝুঁকি নেওয়া একজন সাংবাদিকের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। তিনি ‘মিডল ইস্ট আই’ ও ‘দ্য নিউ হিউম্যানিটেরিয়ান’-এর মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে লিখেছেন এবং ‘ইউরো মেড মনিটর’-এর নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন।

নারী সাংবাদিকদের ভূমিকা বরাবরই চ্যালেঞ্জিং। বিশ্বজুড়ে আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হলেও, আন্দোলনের পর তাদের ভূমিকা প্রায়শই উপেক্ষিত থাকে। মাহাও ব্যতিক্রম নন। তিনি মার্টিন এডলার পুরস্কার পেয়েছিলেন, আবার ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স মিডিয়া ফাউন্ডেশন সাহসী সাংবাদিকতার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেও তা বাতিল করে, কারণ তার মতামত প্রতিষ্ঠানটির নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল।
এ নিয়ে মাহা বিদ্রূপ করে বলেছিলেন, “সাহসিকতার জন্য পুরস্কার দিল, কিন্তু চাপের মুখে নিজেরাই সাহস হারিয়ে ফেলল!”

তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো গাজার বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। বিশেষ করে হামলার কারণে বেড়ে যাওয়া আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে তার গবেষণা ছিল আলোচিত। তিনি দেখিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে বন্দিত্ব, পরিবার হারানো ও ধ্বংসস্তূপের মাঝে বসবাসের ফলে বহু ফিলিস্তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন। এ প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরীর উক্তি মনে পড়ে, ‘দেহের মৃত্যুর রেজিস্টার রাখা হয়, আত্মার হয় না।’

মাহা মনে করেন, সাংবাদিকতা তার কাছে শুধু পেশা নয়, বরং ফিলিস্তিনি জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠার একমাত্র উপায়। তিনি বারবার বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দেন, যদি তার কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যায়, তবে বাকিরা যেন নীরব না থাকে, বরং প্যালেস্টাইনের মুক্তির জন্য আওয়াজ তুলতে থাকে।
যুদ্ধের নির্মম বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে মাহা বলেছেন, ‘আমি আমার জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে রাজি, শুধু এই একটি মুহূর্তের জন্য—শুভ সকাল গাজা।’

ইতিহাস হয়তো তার মতো সাংবাদিকদের ভুলে যাবে, কিন্তু মাহা লড়ে যাচ্ছেন, সত্য প্রকাশের জন্য, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য।