১.
চোখ খুলতেই গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেল নাসর। ধোঁয়ার গন্ধে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার। তবুও উঠে বসার চেষ্টা করলো সে। মাথাটা মনে হচ্ছে কয়েক টন ওজনের। চুপচাপ পড়ে রইলো খানিকক্ষণ। বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল। কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করলো সে। হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো।
: শিহাদাহ… হান্না… শামআহ… কিন্তু কন্ঠনালী থেকে ঘরঘরে আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বের হলো না ওর। অন্ধকারেরই বাচ্চাদের মতো চারপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে খানিকটা এগোলে সে।
হঠাৎ পায়ে কি যেন ঠেকলো। অনুমানে হাত বাড়িয়ে দিতেই ছোট্ট একটা শরীরে হাতে ঠেকলো ওর। ঘোরগ্রস্ত লোকের মতো সামনে এগোলো। তারপর উন্মত্তের মতো বুকে চেপে ধরলো শরীরটাকে। কাঁধ ছড়ানো এক রাশ চুলে ভরা মাথাটা কেমন আঠালো পানীয়তে ভরে রয়েছে অনুভব হতেই চোখ বেয়ে এক সমুদ্র যন্ত্রণা ঝরে পড়তে লাগলো নাসরের । মেয়ের খানিক দূরেই নাজের নিথর দেহ।
: হানা.. আমার ছোট্ট পাখি! অন্ধকারেই মেয়েকে বুকে চেপে টলতে টলতে এলোমেলো পদজোড়া নিয়ে এগোতে লাগলো।
: আহ.. হঠাৎ দেয়ালের ভাঙা ইটের টুকরোতে ধাক্কা খেলো সে। কোনমতে পতন ঠেকাতে ঠেকাতে রুমের বাইরে এলো সে। অন্ধকারেই অন্য রুমে এসে পৌঁছালো সে। পা বাড়াতেই কঁকিয়ে উঠলো কেউ।
:শিহাদাহ… ছোট ছেলের কন্ঠ চিনতে মূহুর্তও লাগলো না তার।
মেয়েকে পাশে নামিয়ে ছেলেকে উঠাতে এগিয়ে গেল। শিহাদাহর গায়ের উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে কে যেন! মাথার পাগড়িতে হাত লাগতেই বড় ছেলেকে চিনতে এতটুকুও ভুল হলো না নাসরের। তার হাফেজ ছেলেটা! ছোট ভাইকে বাঁচাতে নিশ্চয়ই নিজেকে ঢাল বানিয়েছিল সে। কষ্টে কাঁদতেও ভুলে গেল সে। বড় ছেলের গায়ের নিচে চাপা পড়া শিহাদাহকে বের করলো। পড়নের জোব্বাটা সম্পূর্ণ ভেজা। ওকে তুলতেই চিৎকার করে উঠলো।
ছেলের অমন চিৎকারে আতংকিত হলো সে। মনে হলো কোথাও ভেঙে গিয়েছে হয়তো বা।
: আব্বু….. কান্নার গমকে হারিয়ে গেল বাকি কথাগুলো।
২.
অক্টোবরের সন্ধ্যা। শীত আসি আসি করছে। শীতকাল বড্ড পছন্দ এখানকার বাসিন্দাদের। তবে এবারের সময়টা একেবারে অন্যরকম।
:আবু হানা! বাচ্চাদের নিয়ে খেতে আসুন। ভর সন্ধ্যাতেই টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে নাজওয়া।
গরম গরম মাকলৌবা, দই, সালাদ, মাফতুউল, আখরোট, খুরমা। টেবিলের মাঝ বরাবর রূপার মোমদানিতে টিম টিম জ্বলছে মোমবাতি।
বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন গত দু’দিন যাবত। মোমবাতির স্টকও ফুরিয়ে আসছে। তাই তাড়াহুড়ো করে কাজ শেষ করছে নাজওয়া।
স্ত্রীর ডাকে বাচ্চাদের নিয়ে টেবিলে আসে নাসর। এ সময়ে ওরা কেউ বাসায় থাকে। সন্ধ্যার পরও মাদরাসাতে ক্লাস থাকে। নাসরেরও ফিরতে যথেষ্ট দেরী হয়। কিন্তু এখন দৃশ্যপট অন্য।
গত তিন-চারদিন যাবত আবারো উত্তপ্ত শহর। তবে এবারের পরিবেশ একবারে ভিন্ন।
সবাই এসে বসতেই গরম গমে মাকলৌবা বেড়ে দিতে থাকে নাজওয়া। হানার জন্য একবাটি মাফতুউল (সুপ্য জাতীয় খাবার) বেড়ে নেয়। চামচে করে খাইয়ে দিতে থাকে মেয়েকে।
: আব্বিজান! আমি ইয়াসিন ভাইয়ের সাথে যেতে চাই। দেমিরও গতকাল চলে গেল। সভয়ে বাবার উদ্দেশ্যে বলে শামআহ।
খাওয়া থামিয়ে ছেলের দিকে তাকায় নাসর। পরিবারকে নিরাপদ স্থানে রেখে ছত্রীসেনাদের সাথে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছিলো সে নিজেও।
: অবশ্য যাবে বেটা। আমিও যাবো। তবে তোমার মা ও ভাই-বোনদের জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে আগে।
বাবার কথা শুনে খুশী হয় শামআহ।
গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টির মত সমানে ফসফরাস বোমা ফেলছে শত্রু বাহিনী। জয়তুন বাগান, আঙুরের খেত, বসবাসের বাড়ী-ঘর সব গুড়িয়ে দিচ্ছে তারা। আকাশ পথের হামলা শেষ হওয়ার আগেই বাড়ী বাড়ী এসে হাজির হয় ওরা। প্রতিবারই এমন করে।
তবে এবার গাজাবাসীও চুপ করে নেই। প্যারাসুটের ডানায় ভর করে আবাবিলের মতো প্রিয়ভূমিকে রাহু মুক্ত করতে আকাশসীমা ছুঁয়েছে তারা। খেজুর গাছের শাখাগুলোও ডানা নেড়ে ওদেরকে সমর্থন জানিয়েছে। প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্ববাসী ছত্রীসেনাদের উড়ার দৃশ্যে চমৎকৃত। আর ওদিকে সেনাদের অতর্কিত হামলায় দিশেহারা তেল আবিব।
হঠাৎ দ্রুম দ্রুম শব্দে কেঁপে উঠলো পুরো এলাকা। সমানে বোমা পড়ছে।
: লা হাওলা ওলা কুয়াতা…
:বাচ্চারা দ্রুত করো। শেল্টার নিতে হবে। চিৎকার করে বলে নাসর।
বোম্ব শেল্টারে যাওয়ার সুযোগও পায় না তারা। আধ খাওয়া খাবারের প্লেট টেবিলেই পড়ে থাকে। এলোমেলো।
৩.
ধসে পড়া বাড়ী থেকে অতিকষ্ঠে বের হয় নাসর। বুকের সাথে মেয়ে আর পিঠে বড় ছেলে আর স্ত্রীকে কাপড় দিয়ে শক্ত করে বাঁধে। মনের কোণে ক্ষীণ আশা। চিকিৎসা পেলে হয়তো কথা বলবে ওরা।
তারপর ছোট ছেলেকে কাঁধে তুলে নিয়ে পথে নামে। ধুকতে ধুকতে বাড়ী থেকে মাইল তিনেক দূরে আশ-শিফা হাসপাতাল পানে ছুটতে শুরু করে।
আলোহীন সমগ্র শহর। অন্ধকার যেন গিলে খাচ্ছে পুরো শহর। ভয়ানক এক মৃত্যুপুরী যেন! ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে চলেছে। কয়েক দশক ধরে শহরটাকে অক্টোপাশের থাবার মতো জীবন্ত কারাগারের পরিণত করে রেখেছে ওরা। চাইলেও কোথাও যাওয়ার জো নেই এখানকার অধিবাসীদের।
:পরিত্যক্ত হয়ে যাবে কি শহরটা!
নাকি ভূ-মধ্যসাগরের পানিতে মিশে যাবে!
বুকের ভেতর প্রচন্ড এক ভয় জাগে নাসরের।
চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে ওর। পূর্বপুরুষের বাসভূমি কোন আগুন্তকের জন্য একচুলও ছাড়বে না সে। হঠাৎই অজানা সাহসে ভরে ওঠে ওর হৃদয়।
হয়তোবা হাসপাতালে এখনও জেনারেটর চালু রয়েছে। ডাক্তার সালেহী ও তার টিমেরাও আছে। প্রতিনিয়ত নিরাপধ মানুষের প্রতি নিষ্ঠুর হামলার সাক্ষী হচ্ছে যারা।
আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলতে দুলতে নিশ্চিদ্র অন্ধকারে ইসরাঈলী হিংসার আগুনে পোড়া রুটির মতো ঝলসানো গাজার সড়ক বেয়ে গন্তব্য পানে এগিয়ে যেতে থাকে নাসর।
লেখক পরিচিতি: শিক্ষক ও সাহিত্যিক