banner

রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: November 15, 2024

 

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম দুই নারী স্নাতকের একজন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি

 

উনিশ শতকে বাঙলার সমাজে নারীর জীবন যখন ছিল খুবই পশ্চাদপদ এবং বহু প্রতিকূলতায় জর্জরিত, তখন সবরকম সামাজিক বাধার বিরুদ্ধে লড়াই করে ইতিহাস তৈরি করেছিলেন এক বাঙালি নারী, যার নাম কাদম্বিনী গাঙ্গুলি।

কাদম্বিনী গাঙ্গুলি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতেই শুধু নয়, উনবিংশ শতাব্দীতে তিনি ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম দুজন নারী স্নাতকের একজন।

ব্রিটিশ শাসিত দেশগুলো থেকে প্রথম যে দুজন নারী গ্র্যাজুয়েট হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন তারা হলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি (তখন বসু) এবং চন্দ্রমুখী বসু। কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে ১৮৮৩ সালে তারা দুজনে স্নাতক হন।

কাদম্বিনী স্নাতক পাশ করার পর ডাক্তারি পড়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং তিনিই ছিলেন ইউরোপীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পেশাজীবী নারী চিকিৎসক।

কিন্তু কাদম্বিনীর এই ইতিহাস গড়ার পেছনে রয়েছে কঠিন সংগ্রামের ইতিহাস। কিশোরী বয়স থেকে প্রতিপদে রক্ষণশীল সমাজ তাকে এগোনর পথে বাধা দিয়েছে, হেয় করেছে, এমনকি ডাক্তার হবার পরে তিনি যখন রাতে রোগী দেখতে যেতেন তখন এক পত্রিকায় তাকে “বেশ্যা” বলেও কুৎসা ছড়ানো হয়েছে।

অনেক রোগী চিকিৎসা নেবার পরও তাকে চিকিৎসকের মর্যাদা দিতে অস্বীকার করেছে।
কে এই কাদম্বিনী?

কাদম্বিনী বসুর জন্ম ১৮৬১ সালে। বরিশালের চাঁদসি গ্রামে ছিল তাদের পৈতৃক বাসস্থান। বাবা ব্রজকিশোর বসু চাকুরি সূত্রে থাকতেন বিহারের ভাগলপুরে, যেখানে তিনি ভাগলপুর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সেখানেই জন্ম কাদিম্বিনীর।

ব্রজকিশোর ভাগলপুরে নারীমুক্তি আন্দোলন শুরু করেছিলেন এবং ভারতের প্রথম মহিলা সমিতি তিনিই স্থাপন করেন।

ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক পরিবেশের কারণে কাদম্বিনীর পড়াশোনায় ছিল প্রবল আগ্রহ। বাবা তাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ১৪ বছর বয়সে ভর্তি করে দেন মেয়েদের একটি বোর্ডিং স্কুলে।

কাদম্বিনী গাঙ্গুলির জীবন নিয়ে গবেষণা করেছেন বরুণ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ওই কিশোর বয়সেই পরিবারের বাইরে থেকে বড় হয়ে ওঠা কাদম্বিনীর চরিত্রের ওপর একটা বড় প্রভাব ফেলেছিল।

নারী শিক্ষার গুরুত্ব তিনি বুঝতে শুরু করেছিলেন তখন থেকেই। তার স্কুলের শিক্ষক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি ছিলেন নারী শিক্ষার একজন প্রবক্তা। দ্বারকানাথের কাজ কাদম্বিনীর কিশোরী মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যা পরে গভীর প্রেমে রূপ নেয়। দ্বারকানাথকেই পরে বিয়ে করেছিলেন কাদম্বিনী।

বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় নামে যে স্কুলে কাদম্বিনী পড়তেন সেটি বছর দুয়েকের মধ্যে উঠে যাবার উপক্রম হলে স্কুলটিকে কলকাতায় মেয়েদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেথুন স্কুলের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়। কালক্রমে ঐ স্কুল থেকে এন্ট্রাস বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা দেবার জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠেন মাত্র দুজন ছাত্রী, যাদের একজন ছিলেন কাদম্বিনী।

উনিশ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে নারীশিক্ষার চল ছিল না। মেয়েদের ঘরে থাকাটাই ছিল সমাজে বাঞ্ছনীয়

অন্য ছাত্রীটির পারিবারিক কারণে আর পরীক্ষা দেয়া হয়ে ওঠেনি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন একমাত্র কাদম্বিনী।

মেয়েদের উচ্চশিক্ষার কোন চল সেসময় ছিল না, ফলে মেয়েদের পড়ার জন্য কোন কলেজই ছিল না। মি. চট্টোপাধ্যায় বলছেন কাদম্বিনীর লেখাপড়ার জন্যই বেথুন স্কুল প্রথমে এফ.এ. (ফার্স্ট আর্টস- বর্তমানের উচ্চ মাধ্যমিক সমমান) ও পরে বি.এ. ক্লাস চালু করে।

বিশেষ অধ্যাদেশের মাধ্যমে বেথুন স্কুলকে কলেজে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্তে বাংলায় সাড়া পড়ে যায়।

খ্রিস্টান স্কুল থেকে প্রাইভেটে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এক ছাত্রী চন্দ্রমুখী বসু এসে তার সাথে যোগ দেন বেথুন কলেজে বিএ পড়তে এবং ১৮৮৩ সালের জানুয়ারিতে দু’জনে বিএ পাশ করে ইতিহাস গড়েন।

কাদম্বিনী গাঙ্গুলির প্রপৌত্র রাজীব গাঙ্গুলি বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তার মেধার পরিচয় প্রকাশ পেয়েছিল।

“মেয়েদের শিক্ষার জন্য যারা সেসময় আন্দোলন করছিলেন কাদম্বিনীর কাছে একদিকে তাদের বিরাট একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, অন্যদিকে কাদম্বিনীর নিজের মধ্যেও একটা একরোখা ভাব ছিল- আমাকে এগোতেই হবে।”

কাদম্বিনী গাঙ্গুলির জীবন সংগ্রাম নিয়ে স্টার জলসা টেলিভিশনে প্রচারিত সিরিয়ালের লেখিকা শর্বরী ঘোষাল বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, কাদম্বিনীর জীবন কাহিনি মেয়েদের জন্য অসামান্য অনুপ্রেরণার ইতিহাস।

“এই মেয়েটি শিক্ষাজীবনে শুধু নিজেই এগোয়নি, নারীর জন্য শিক্ষাব্যবস্থাও তার কারণেই ধাপে ধাপে এগিয়েছে। তার জন্যই বেথুনের মত নার্সারি স্কুলে এন্ট্রাস ক্লাস চালু হয়েছে, বেথুন কলেজিয়েট স্কুল হয়েছে, কারণ তিনি পড়তে চেয়েছেন এফএ। তিনি স্নাতক পড়বেন, বেথুন স্কুলকে তাই কলেজে রূপান্তরিত করা হয়েছে। তার হাত ধরেই বাংলায় নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পথ তৈরি হয়েছে,” বলেছেন শর্বরী ঘোষাল।

রাজীব গাঙ্গুলি বলছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে এই দুজন নারীর ডিগ্রি নেওয়া দেখতে কীভাবে লোক ভেঙে পড়েছিল।

“ইংল্যান্ডেও তখন নারী শিক্ষার প্রসার সবে ঘটতে শুরু করেছে। কাজেই ইংল্যান্ডের বাইরে এই দুই নারীর সমাবর্তনে ব্যাপক উৎসাহ দেখিয়েছিলেন ভারতে ঔপনিবেশিক শাসক সমাজের বহু মানুষ।”

তবে গবেষক বরুণ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, সবাই যে উৎসাহ নিয়ে তাদের অভিনন্দন জানাতে এসেছিলেন তা নয়, অনেক রক্ষণশীল মানুষ এসেছিলেন দুই নারীর স্নাতক উপাধি নেওয়া ভণ্ডুল করতে। তবে শেষ পর্যন্ত নির্বিঘ্নেই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
উচ্চশিক্ষার জন্য লড়াই

কাদম্বিনীর জন্য উচ্চ শিক্ষার পথ ছিল কঠিন সংগ্রামের। স্নাতক হবার আগেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মেডিকেল পড়বেন। আবেদনও করেছিলেন, কিন্তু তার আবেদন নাকচ হয়ে যায়।

সমাজেও নানাভাবে ব্যঙ্গবিদ্রূপের শিকার হলেন তিনি। নারীরা চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়বে এটা সেসময় সমাজ ভাবতেও পারত না। বিশেষ করে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে মেয়েদের সামনে বিস্তারিত আলোচনা ও পাঠদান তখন শিক্ষকদের জন্য ছিল খুবই অস্বস্তিকর। আর ক্লাসে একমাত্র ছাত্রী ছিলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি।

তার প্রথম আবেদন নাকচ হয়ে যায় তিনি তখনও স্নাতক হননি সেই যুক্তিতে। কিন্তু স্নাতক হবার পর কাদম্বিনী যখন দ্বিতীয়বার চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ার আবেদন জানালেন, তখন আপত্তি জানাল মেডিকেল কাউন্সিল, পাশাপাশি তার মেডিকেল কলেজে ঢোকা বন্ধ করতে উঠে পড়ে লাগল কলেজের শিক্ষকদেরই একাংশ।

বহু প্রতিরোধের দেয়াল ডিঙিয়ে এবং রক্ষণশীল সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত কাদম্বিনী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার সুযোগ পেলেন মূলত সেসময় বাংলার লেফটন্যান্ট গর্ভনর রিভার্স টমসনের আগ্রহ ও ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপের কারণে।

তার হস্তক্ষেপে মেডিকেল কলেজ কাউন্সিল কাদম্বিনীকে ডাক্তারিতে ভর্তি করতে বাধ্য হয়।

দ্য ওম্যান্স হেরাল্ড নামে ইংরেজি একটি পত্রিকায় অগাস্ট ১৮৯৩ সালে কাদম্বিনীর শিক্ষাজীবনের সংগ্রাম নিয়ে এক নিবন্ধে লেখা হয়, কাদম্বিনীকে ডাক্তারি না পড়ার কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল ডাক্তারি পড়তে গেলে পুরুষদের কাছ থেকে তাকে অপমান সহ্য করতে হতে পারে।

পত্রিকায় লেখা হয়, কাদম্বিনী বলেছিলেন তিনি সবরকম অপমান সহ্য করতে প্রস্তুত আছেন। ঐ রিপোর্ট অনুযায়ী এক বছর ক্লাসে তিনি ২০০ জন পুরুষের মধ্যে ছিলেন একমাত্র নারী।

গবেষক বরুণ চট্টোপাধ্যায় বলছেন তার ডাক্তারি পড়াকে রক্ষণশীল বাঙালি সমাজ একেবারেই মেনে নিতে চায়নি। সমাজে যারা উদারমনস্ক ও নারী শিক্ষার সমর্থক ছিলেন, এমনকি তারাও চাননি একজন মেয়ে ডাক্তারি পড়ুক।

“এমনকি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কাদম্বিনীর এত বড় অর্জনে নিশ্চুপ ছিলেন। তিনি চন্দ্রমুখীকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন, উপহারে পুরস্কৃত করেছিলেন, কিন্তু কাদম্বিনীর সাফল্য নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। তার উচ্চশিক্ষার তিনি বিরোধিতা করেননি, কিন্তু বিদ্যাসাগরের বিস্ময়কর নীরবতা থেকে মনে হয়েছে কাদম্বিনীর ডাক্তারি পড়াকে তিনি সমর্থন করতে পারছেন না।

“মেয়েদের বিজ্ঞান পড়া, সর্বোপরি ডাক্তারি পড়ে সক্রিয় পেশাজীবী জীবন বেছে নেওয়াকে কি তিনি সমর্থন করতে পারেননি। না হলে এমন আশ্চর্যজনকভাবে নীরব ছিলেন কেন?” মন্তব্য করেছেন বরুণ চট্টোপাধ্যায়।
চরিত্রের ওপর আঘাত

সেসময়কার একটি পত্রিকা বঙ্গনিবাসীতে একটি লেখায় তার পেশা নিয়ে তির্যক ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা হয়েছিল। একটি ঘটনার খবর প্রসঙ্গে তার রাতে রোগী দেখতে যাওয়ার বিষয়ে কটাক্ষ করে তাকে “নটী” উল্লেখ করে ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করা হয় “তিনি কি ডাক্তারি করেন না কি বেশ্যাবৃত্তি করেন?”

তবে তেজস্বিনী নারী কাদম্বিনী পত্রিকার সম্পাদককে ছেড়ে দেননি। তিনি ও তার স্বামী দ্বারকানাথ আদালতে অভিযোগ জানান । বিচারে সম্পাদকের ছয় মাসের জেল ও জরিমানা হয় এবং মানহানির ক্ষতিপূরণ হিসাবে কাদম্বিনীকে দেয়া হয় তিন হাজার টাকা। একজন নারীর এই সাহস সমাজে রীতিমত তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল।

তেজস্বিনী কাদম্বিনী সমাজের নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছেন আজীবন

মেডিকেল কলেজের একজন অতি রক্ষণশীল বাঙালি অধ্যাপক যিনি গোড়া থেকেই কাদম্বিনীর ডাক্তারি পড়ার বিষয়ে খোলাখুলি প্রতিবাদ করেছিলেন, তিনি কাদম্বিনীকে পরীক্ষা পাশের জন্য প্রয়োজনীয় নম্বর দেননি বলে কথিত আছে।

বরুণ চট্টোপাধ্যায় বলছেন কাদম্বিনীকে এক নম্বর কম দিয়ে পাশ না করানোর বিষয়টি নিয়ে সেনেটের বৈঠকে তখন যে আলোচনা হয়েছিল, তার দালিলিক প্রমাণও রয়েছে।

ব্রিটিশ একজন চিকিৎসক ডা. জে এম কোটস যিনি তখন ছিলেন মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ এবং মেডিসিনের অধ্যাপক, তিনি বুঝেছিলেন যে, কাদম্বিনীর সঙ্গে অন্যায় হচ্ছে। তার উদ্যোগে সিন্ডিকেটে আলোচনার মাধ্যমে কাদম্বিনীকে ‘লাইসেনসিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি’ বা এলএমএসের সার্টিফিকেট দেওয়া হয় ১৮৮৬ সালে।

কিন্তু দু’বছর এলএমএস পড়ার পরে ফাইনালে ফের কাদম্বিনীকে অকৃতকার্য দেখানো হয়।

এরপর অধ্যক্ষ কোটস নিজের অধিকার প্রয়োগ করে কাদম্বিনীকে ‘গ্র্যাজুয়েট অফ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ’ বা জিবিএমসি উপাধি দেন, যার ফলে ডাক্তার হিসাবে প্র্যাকটিস করার ছাড়পত্র পান কাদম্বিনী গাঙ্গুলি।
পেশা জীবনের সংগ্রাম

ইডেন হাসপাতালে তাকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছিলেন মি. কোটস। কিন্তু সেখানে ডাক্তার হিসাবে তাকে গণ্য করা হত না, সেখানে তাকে নার্সের মর্যাদা দেওয়া হত। রোগ নির্ণয় বা অস্ত্রোপচার করতে দেওয়া হত না।

এরপর লেডি ডাফরিন হাসপাতালে তার চিকিৎসার সুযোগ হয় ১৮৯০ সালে। সেই কাজ পেতে কাদম্বিনীর জন্য তদ্বির করেছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গল।

রাজীব গাঙ্গুলি বলছেন, “কাদম্বিনীর কথা কীভাবে পৌঁছেছিল ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের কাছে। তিনি লেডি ডাফরিনকে লিখে কাদম্বিনীকে সেখানে কাজ দেবার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সেই হাসপাতালে তখন ইংল্যান্ডের ডাক্তারদেরই প্রতিপত্তি। কাজ করার সুযোগ পাননি কাদম্বিনী।”

কাদম্বিনী ১৮৮৮ থেকেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন। তিনিই প্রথম মহিলা চিকিৎসক, যিনি সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রাইভেটে রোগী দেখতেন। ঘোড়ার গাড়িতে চেপে রাতবিরেতে রোগী দেখতে যেতেন, প্রাইভেট চেম্বার খুলেছিলেন এবং নিয়মিত অস্ত্রোপচারও করতেন, বলেছেন রাজীব গাঙ্গুলি।

কিন্তু তার ডাক্তারি ডিগ্রি নিয়ে, তার যোগ্যতা নিয়ে বিরোধীরা প্রতি পদক্ষেপে তাকে বিদ্রূপ করতেন, তাকে চিকিৎসকের দায়িত্ব দেওয়ার প্রতিবাদ করতেন, এবং বলতেন তিনি একজন ধাত্রী বা নার্স, আদতে কোন চিকিৎসকই নন।

বরুণ চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, এই বিষয়টি কাদম্বিনী মেনে নিতে পারছিলেন না। এ সময়ই বিদেশে গিয়ে তিনি ডাক্তারি ডিপ্লোমা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এবং এ ব্যাপারে তার পেছনে ছিলেন তার স্বামী দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি।

স্নাতক হবার কিছুদিনের মধ্যেই তার থেকে বয়সে অনেক বড়, বিপত্নীক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলিকে কাদম্বিনী বিয়ে করেছিলেন, যিনি ছিলেন একজন ব্রাহ্ম সমাজ সংস্কারক, এবং নারী শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম একজন কর্ণধার।
কলকাতার ইডেন হাসপাতালের আঁকা ছবি

ইডেন হাসপাতালে কাদম্বিনীকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছিলেন ডা. কোটস, কিন্তু চিকিৎসকের সম্মান সেখানে তার জোটেনি

তাদের এই বিয়ে নিয়েও সমাজে নানা কথাবার্তা উঠেছিল, তৈরি হয়েছিল তুমুল আলোড়ন।

আট সন্তানকে কলকাতায় রেখে স্বামীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় কাদম্বিনী ১৮৯৩ সালে ইংল্যান্ডে যান চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা নেবার জন্য। এক বিদেশি মহিলার সঙ্গিনী হয়ে জাহাজে একা বিদেশযাত্রা করেন।

ক্লাস করতেন তিনি স্কটল্যান্ডে। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ১৮৯৩ সালের জুলাই মাসে স্কটিশ কলেজের তিনটি ডিপ্লোমা অর্জন করে তিনি দেশে ফিরে যান।

কাদম্বিনী গাঙ্গুলির রোগীদের সিংহভাগ ছিলেন গরীব ও প্রান্তিক মুসলিম ও নিম্নবর্গীয় হিন্দুরা।

“ধনী পরিবারের, রাজপরিবারের মেয়েদের চিকিৎসা করে তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করতেন কাদম্বিনী। নেপালের রাজপরিবারের চিকিৎসা করে প্রচুর অর্থ তিনি আয় করেছিলেন। প্রচুর উপহার পেয়েছিলেন তাদের কাছ থেকে। গরীব ও সমাজের অবহেলিত সম্প্রদায়ের মানুষের চিকিৎসাই ছিল তার জীবনের একটা বড় ব্রত,” বলছিলেন গবেষক বরুণ চট্টোপাধ্যায়।

তবে শর্বরী ঘোষাল বলেছেন, এত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ডাক্তার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার পরেও কাদম্বিনীকে সমাজ এমনকি একজন চিকিৎসকের যোগ্য সম্মানও দেয়নি।

“সন্তান প্রসব করানোর জন্য তিনি যখন সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বাড়িতেও গেছেন, তাকে ‘দাই’ বলে ডাকা হয়েছে। খেতে দিয়ে নিজের থালাবাসন তাকে ধুয়ে দিয়ে যেতে বলা হয়েছে।”

কদিম্বিনীর প্রপৌত্র রাজীব গাঙ্গুলি বলছিলেন: “ঠাকুমার কাছে শুনেছি, কঠিন কেসে সফলভাবে প্রসব বা অস্ত্রোপচারের পর কাদম্বিনীকে যখন খেতে দেয়া হয়েছে, তাকে ঘরের ভেতর আসন দেয়া হয়নি। এমন একটা বাড়িতে কাদম্বিনীর সাথে গিয়েছিলেন আমার ঠাকুমা।

“কাদম্বিনীকে বাইরে বসে খেতে বলেছিল, থালাবাটি ধুয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে দিয়ে যেতে বলেছিল। অপমানে আমার ঠাকুমার চোখে জল এসেছিল। তখন কাদম্বিনী ইংল্যান্ড ফেরত ডাক্তার।”

রাজীব গাঙ্গুলি বলেন, ইউরোপীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এই পেশাজীবী নারী চিকিৎসক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পুরুষশাসিত সমাজে আত্মমর্যাদা পেতে লড়াই চালিয়ে গেছেন, নিজের যোগ্যতা প্রমাণে শেষ দিন পর্যন্ত পরীক্ষা দিয়ে গেছেন।

আনন্দীবাঈ যোশী নামে আরেকজন ভারতীয় নারী একই বছর অর্থাৎ ১৮৮৬ সালে ডাক্তারি পাশ করেন আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ থেকে। বম্বের মেয়ে আনন্দীবাঈকে তার স্বামী ডাক্তারি পড়তে আমেরিকা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে ভারতে ফেরেন, প্র্যাকটিস করার সুযোগ তার আর হয়নি। পুনায় ২১ বছর বয়সে তিনি মারা যান। বিবিসি বাংলা

 

গ্রামের নারীদের তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে

জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এমপি বলেছেন, তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক প্রশিক্ষণ তৃণমূলের নারীদের জন্য অবারিত করতে হবে। এতে তারা নিজেদের জীবনমান উন্নয়নে তা কাজে লাগাতে পারবেন।

বুধবার (১০ মার্চ) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২১ উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এসব কথা বলেন তিনি।

নারীবান্ধব নীতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে স্পিকার বলেন, নারীদের আরও এগিয়ে নিতে অবকাঠামোগত সকল সুবিধা নিশ্চিত জরুরি। নারীবান্ধব রাজস্বনীতি গ্রহণের পাশাপাশি করারোপ প্রক্রিয়ার সহজীকরণ প্রয়োজন শ্রমবাজারে নারীদের অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সকলকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান স্পিকার।

শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা সঙ্কট মোকাবিলায় ঘোষিত প্রণোদনা মাঝারি ও ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারা যেন সহজে পেয়ে উপকৃত হতে পারেন, সেজন্য সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা দরকার। ডিজিটাল ডিভাইডের শিকার হয়ে নারীরা যেন তথ্য-প্রযুক্তিতে পিছিয়ে না পড়ে সেদিকে সকলকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।

স্পিকার বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের নারী-পুরুষ সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার আইনী কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানিক ভিত দিয়ে গেছেন। নারী-পুরুষ সকলের মৌলিক অধিকার তিনি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে গেছেন। এই আইনি কাঠামোর ভিতের উপর দাঁড়িয়ে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের নারী সমাজ।

তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরেই আজ নারীদের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতি। কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রেই নারীদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের নজির দৃশ্যমান। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ জাতীয় সংসদে ৫০ জন সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্যের পাশাপাশি ২৩ জন নারী সরাসরি নির্বাচিত, যা জাতির পিতার সুগভীর প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তার ফল।

স্পিকার বলেন, প্রধানমন্ত্রী নারীর ক্ষমতায়নে যে কাজ করছেন, তা সমগ্র বিশ্বে প্রশংসিত। এর স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড, প্ল্যানেট ফিফটি চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড, গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড ২০১৮, এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ডসহ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

‘কোভিড মোকাবিলায় অসাধারণ নেতৃত্বের জন্য সম্প্রতি কমনওয়েলথ কর্তৃক বিশ্বের তিনজন প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে অন্যতম হিসেবে ইন্সপাইরেশনাল লিডারশিপ সম্মাননা তিনি অর্জন করেছেন। যা সমগ্র জাতির জন্য গৌরবের’ বলেন স্পিকার।

অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক ছিলেন মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি ছিলেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমীন, মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাফিয়া খাতুন এবং সাধারণ সম্পাদক মাহবুবা বেগম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরিন অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন। এতে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ড. সুলতানা শফি। সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ চুমকি।

 

করোনায় ই-কমার্সে নারীরা ভালো অবদান রেখেছে : স্পিকার

নারীদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।

তিনি বলেন, যোগ্যতা দিয়ে নিজের অবস্থান তৈরি করতে পারলে নারীদের পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি আর আসবে না।

বুধবার (১০ মার্চ) সিরডাপ মিলনায়তনে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটি আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন। এতে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন স্পিকার।

তিনি বলেন, করোনায় ই-কমার্স বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এতে নারীরা ভালো অবদান রেখেছে। ই-কমার্স আরও নারী বান্ধব করা প্রয়োজন। কর আরোপসহ নানা বিষয়গুলি সহজীকরণ করা দরকার।

ভারতের একটি আঁকা ছবির কথা উল্লেখ করে স্পিকার বলেন, সেখানে একটা ছেলে তার মায়ের সারাদিনের কাজের চিত্র তুলে ধরে। অথচ তার বাবা বলে মা কোনো কাজ করে না। আমরা নানা যায়গায় গিয়ে দেখেছি, গৃহিণীরা নিজেও মনে করেন তিনি কিছু করেন না। স্বামীরাও মনে করে তাই। বিষয়টি কিন্তু উল্টো; কাক ডাকা ভোর থেকে রাত অবধি নারীরা কাজ করেন।

তিনি বলেন, নারী-পুরুষের সমতার বিষয়টি আইনি কাঠামোয় এবং সংবিধানে সংযোজন করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার বাস্তবায়ন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নারীদের অধিকার নিশ্চিত করা ও জীবন মান উন্নতকরণে বিশেষ অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কারও পেয়েছেন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, নারীদের ক্ষমতায়ন তৃনমূল থেকে হতে হবে। তৃণমূলে আগে ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্য চেয়ারম্যান বা নির্বাচিত সদস্যদের ইচ্ছায় মনোনীত হতো। তারা (পুরুষ) চাইলে কাজ করতে পারতো, না হয় না। অথচ ইউনিয়ন পরিষদে নারীদের নির্বাচন করে তুলে আনার মধ্য দিয়ে তাদের ক্ষমতায়ন করেছেন শেখ হাসিনা। এখন তারা নিজের ও নারীদের দাবি তুলে ধরতে পারছেন।

তিনি আরও বলেন, প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারলে মানুষ এক সময় না এক সময় তার অধিকার নিতে পারে। শেখ হাসিনা নারীদের এগিয়ে যাওয়া, ক্ষমতায়ন ও অধিকার আদায়ের সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে দিয়েছেন।

মতিয়া চৌধুরী বলেন, নারী শুধু মেয়ে মানুষ নয়, নারীও মানুষ এটিই হোক আমাদের পরিচয়। এতেই দূর হয়ে যায় অনেক বাধা।

আয়োজক কমিটির চেয়ারম্যান ড. সুলতানা শফির সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব মেহের আফরোজ চুমকির সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাফিয়া খাতুন, সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম কৃক প্রমুখ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরিন।

 

প্রধানমন্ত্রী প্রশাসনিক ও উচ্চপদে নারীদের পদায়ন করেছেন

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশাসনিক এবং অন্যান্য উচ্চপদে নারীদের পদায়ন করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা।

বুধবার (১০ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেলে জাতিসংঘের কমিশন অন দ্য স্ট্যাটাস অব উইমেনের ৬৫তম সেশনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং ইউএন উইমেন বাংলাদেশের আয়োজনে এই সভা হয়।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, রাজনীতিতে আমাদের দেশের নারীরা অবহেলিত। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীরা রয়েছেন। বাংলাদেশে যারা বড় রাজনীতিবিদ বলে দাবি করেন তাদের দলে কিন্তু নারীদের এ ধরনের অবস্থান নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের নারীরা আজ এমন এক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে যে বঙ্গবন্ধুর কন্যা সর্বপ্রথম এদেশে প্রশাসনিক এবং অন্যান্য উচ্চপদে নারীদের পদায়ন করেছেন।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নারীদের উচ্চপদে পদায়ন করেছেন। বর্তমানে আদালতে ১৮৪৫ জন জজ আছেন, তারমধ্যে নারী ৫৪৪ জন। বাংলাদেশের মেজর জেনারেল নারী; আগে কখনো নারী এসপি ছিলে না, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় এসে নারী এসপি নিয়োগ দিয়েছেন। দেশে ১৫ হাজার নারী পুলিশ রয়েছে, তার মধ্যে অনেকেই পুলিশ কর্মকর্তা। বর্তমান নারী ইউএনও’র সংখ্যা ১৩৪ জন।

বাংলাদেশ আজ নারীর ক্ষমতায়নে উন্নয়নশীল বিশ্বের রোল মডেল বলে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের পুনর্বাসন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠনের মাধ্যমে নারী উন্নয়নের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নারী-পুরুষ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন সুসংহতকরণে গৃহীত কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত।

তিনি বলেন, গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ প্রতিবেদন ২০২০ অনুযায়ী ১৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০তম। ভিশন ২০২১ এবং ২০৪১-এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে ক্রমান্বয়ে একটি মধ্যম এবং উচ্চআয়ের দেশের পরিণত করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সকল আন্তর্জাতিক ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা সকলেই এখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বাস্তবায়নে কাজ করছি। এক্ষেত্রে ৫ নং গোল সরাসরি নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সকল ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধ, বাল্যাবিয়ে নিরোধ, নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে এসডিজি অর্জনে বাংলাদেশ সক্ষম হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা।

তিনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন, সমসুযোগ, সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় উন্নয়নের মূলধারায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে দারিদ্রমুক্ত সুখী-সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব।

সভায় সভাপতির বক্তব্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: সায়েদুল ইসলাম নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, সুরক্ষা প্রদান এবং নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সামগ্রিক উন্নয়নের মূলস্রোত ধারায় সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেন।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘের উদ্যোগে আগামী ১৫-২৬ মার্চ ২০২১ সময়ে কমিশন অন দ্য স্ট্যাটাস অব উইমেনের ৬৫তম সেশন অনুষ্ঠিত হবে। মহামারির কারণে এবছর সেশনটি ভার্চুয়ালি হবে।

 

বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ নারী সহিংসতার শিকার

বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ নারী সারাটা জীবন ধরেই যৌন হেনস্তা বা শারীরিক সহিংসতার শিকার হন। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক নতুন প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

মঙ্গলবার ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানকে আহ্বান জানানো হয়েছে। নারীদের প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করা, ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য বিভিন্ন সেবার উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবিলা করা যার কারণে প্রায়ই নারী ও মেয়ে শিশুরা অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে।

১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ৩১ শতাংশ নারী অর্থাৎ বিশ্বের ৮৫ কোটির বেশি নারী শারীরিক বা যৌন হেনস্তার শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তারা বলছে, এ পর্যন্ত নারীদের ওপর সহিংসতার বিষয়ে করা এটাই সবচেয়ে বড় গবেষণা। ২০০০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ জরিপ এবং তথ্যও এতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতি সম্মান এবং যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে সঙ্গীর মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি স্কুলজীবনেই ছেলে শিশুদের শেখানো উচিত।

বিভিন্ন দেশ এবং সংস্কৃতিতে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় লাখ লাখ নারী এবং তাদের পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কোভিড-১৯ মহামারি পরিস্থিতিতে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বিশ্বব্যাপীই অনেক বেড়ে গেছে।

এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরিদ্র দেশগুলোতে একজন স্বামী বা নারীর অন্তরঙ্গ সঙ্গীর দ্বারাই তারা সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন। সেখানে বলা হয়েছে, এক চতুর্থাংশ নারী তাদের সঙ্গীর হাতে হেনস্তা বা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। অনেক সময় একজন মেয়ে তার ১৫ বছর বয়স থেকেই বিভিন্ন ধরনের মানুষের কাছে হেনস্তার শিকার হয়ে থাকেন এবং এটা তাকে সারাজীবন বয়ে নিয়ে যেতে হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, কিরিবাতি, ফিজি, পাপুয়া নিউ গিনি, বাংলাদেশ, কঙ্গো এবং আফগানিস্তানে মেয়েদের সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হতে হয়। এই সংখ্যা সবচেয়ে কম ইউরোপে। সেখানে সহিংসতার শিকার ২৩ শতাংশ নারী।

করোনা মহামারিতে বিভিন্ন দেশেই নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিশেষ করে নারীরা বাড়ির বাইরে যেতে না পারায় তারা তাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বা কাছের কারও কাছ থেকে সহায়তা নিতে পারেননি। তাদেরকে নিজেদের নির্যাতনকারীর সঙ্গে একই স্থানে অনেক বেশি সময় ধরে থাকতে হয়েছে। ফলে নির্যাতনের মাত্রাও বেড়ে গেছে।

প্লান ইন্টারন্যাশনালের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, কলম্বিয়ায় লকডাউন শুরুর পর সেখানে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা অন্যান্য বছরের তুলনায় ১৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে যা সত্যিই খুব আশঙ্কাজনক।