banner

সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: November 15, 2024

লকডাউনে ৩১৭টি সার্টিফিকেট অর্জন তরুণীর

লকডাউনের দিনগুলোতে অখণ্ড অবসরের ‘সর্বোচ্চ’ ব্যবহার করে ৩১৭টি সার্টিফিকেট অর্জন করেছেন ভারতের এক পিএইচডি স্কলার। টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, সুধন্যা নাথ নামের ওই তরুণী বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল এবং পাকিস্তানের মতো দেশ থেকে বিভিন্ন কোর্স করে এই সনদগুলো পেয়েছেন।

‘লকডাউনের দিনগুলোতে বাড়িতে থাকার সময় কিছু অনলাইন কোর্সে অংশ নেই। সবগুলো কোর্স ছিল আমার সাবজেক্ট-ভিত্তিক: অ্যানিমেল নিউট্রেশন,’ জানিয়ে সুধন্যা ইংরেজি গণমাধ্যমটিকে বলেন, ‘এরপর অন্য বিষয়ের ওয়েব সেমিনারেও অংশ নেই। এতে অনেক নতুন কিছু জানতে পেরেছি।’

২৫ বছর বয়সী এই তরুণীর অল্প বয়স থেকেই নানা বিষয়ের প্রতি ঝোঁক ছিল। সেই অভ্যাসটা তিনি এখনো ধরে রেখেছেন, ‘অনেক শখর বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাইলেও সময়ের অভাবে পারিনি। কিন্তু লকডাউন আমাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে। সঙ্গে ছিল প্রযুক্তির আশীর্বাদ।’

কোর্সের পাশাপাশি তিনি ক্রিয়েটিভ রাইটিং এবং ভিডিওগ্রাফির কয়েকটি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছেন।

‘আমি শুধু সার্টিফিকেটের জন্য বসে থাকিনি। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে অনেক কুইজ খেলেছি। বই পড়েছি। লেখালেখি করেছি।’

যুক্তরাষ্ট্রে সফল বাংলাদেশি রুদমীলা নওশীন

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো তাদের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করছে। তাদের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে গিয়ে একজন দেশকে তুলে ধরেছেন বিশ্বের প্রতাপশালী কোম্পানিগুলোর সামনে। তিনি হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি উদ্যোক্তা রুদমীলা নওশীন।

বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান স্কলাসটিকা থেকে এ লেভেল শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে যান আন্ডারগ্র্যাডের জন্য। ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান জোস স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্রাজুয়েশন করেন। পরবর্তীতে মাস্টার্স অব সায়েন্স ইন ডিজিটাল কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। অধ্যয়নরত অবস্থায়ই পেয়েছেন ‘স্যুমা কাম লড’র মতো বিশেষ সাফল্য। সম্প্রতি তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক মিডিয়া কোম্পানির ‘হেড অব প্রডাকশন’। তার কোম্পানি সিলিকন ভ্যালি ট্যালি- পোডকাস্ট শুরু করার পরিকল্পনা করছে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক জোড়া প্রতিষ্ঠান কনফিগ ভিআর ও কনফিগ রোবটের ফাউন্ডার ও সিইও। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে তার প্রতিষ্ঠান কাজ করছে অগমেন্টেড রিয়েলিটি, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, মিক্সড রিয়েলিটি, থ্রিডি মডেলিং, অ্যানিমেশন ও কন্টেন্ট নিয়ে। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কোম্পানির মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘ভার্চুয়ালাইজ ইওর ভিশন’। যার লক্ষ্যই হচ্ছে মানুষের বিভিন্ন ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রযুক্তির মাধ্যমে বাস্তবে রূপ দেওয়া। কনফিগ ভিআর মূলত এআর (অগমেন্টেড রিয়েলিটি), ভিআর (ভার্চুয়াল রিয়েলিটি) এবং মিক্সড রিয়েলিটির ওপর ভিত্তি করে কাজ করে। এ সম্পর্কে রুদমীলা নওশীন বলেন, ‘আমাদের মূলত রিয়েল স্পেসের ওপর কাজ। এটি কম্পিউটার জেনারেটেড স্টিমুলেশন, যা ক্যামেরার ডেপথ সেন্স ব্যবহার করে এবং যেকোনো অবজেক্ট রিয়েল স্পেসে প্রজেক্ট করতে সহায়তা করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের প্রজেক্টগুলো নিকট ভবিষ্যতে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি তৈরি করে মানুষের বিভিন্ন বিষয়ে ফোবিয়া বা ভয়-ভীতি দূর করতে সক্ষম হবে। অন্যদিকে কনফিগ রোবট অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, চ্যাটবট, সাইবার নিরাপত্তা, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) এবং দক্ষতা উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে থাকে। আমেরিকা, ইউরোপ ও বাংলাদেশে টিমে আছে।’ এ ছাড়া তারা বিভিন্ন উদ্যোক্তা ক্লাবের সাথে যুক্ত আছেন এবং বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের সংগঠনের সঙ্গেও কাজ করছেন। তিনি ইউএস-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে দুই দেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও জোরালো করতে চান।

ছোটবেলা থেকে বাবা-মা দু’জনকেই দেখে এসেছেন সফল প্রযুক্তিগত উদ্যোক্তা হিসেবে। তার বাবা ফজলে সেলিম বাংলাদেশের অন্যতম সফল ব্যবসায়ী। আর মা রুকসানা সেলিমের অবদান তার জীবনে অনেক। তার বড় চাচা ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী ফজলে রাব্বী। দেশপ্রেম তাই তার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শৈশব থেকেই বাবার অফিসে সিলিকন ভ্যালির নামকরা সব কোম্পানির ম্যাপ দেখতেন। তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতেন, একদিন তার গড়ে তোলা কোনো প্রতিষ্ঠানও সেখানে জায়গা করে নেবে।

ছোটবেলার সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়া রুদমীলা জানান, বিদেশের মাটিতে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা তার জন্য সব সময়ই গর্বের। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে আসার শুরুটা পরিবারের ইচ্ছাতে হলেও এখন তিনি সেই সিদ্ধান্তকে নিজের জন্য আশীর্বাদ মনে করেন।

বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে জানান, ‘এখানকার রিটেইল, উৎপাদন, শিক্ষা, সরকারি কর্মক্ষেত্র ও মিলিটারির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে এআর, ভিআর ও মিক্সড রিয়েলিটির ব্যবহার দেশকে কয়েকগুণ এগিয়ে নিয়ে যাবে।’

তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন অ্যানিমেশন, সিনেমা, ওয়েব সিরিজ, ডকুমেন্টেশনকে নেটফ্লিক্স ও অ্যামাজনে প্রচার করতে চান। এর জন্য তিনি তার প্রফেশনাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। অবসরে কী করা হয় জানতে চাইলে জানান, তিনি একজন ক্ল্যাসিক্যাল ড্যান্সার। হাইকিং ছাড়া হারমোনিয়াম ও তানপুরায় রয়েছে বিশেষ দক্ষতা। পেইন্ট আর ভ্রমণপিপাসু একজন মানুষ তিনি। স্বভাবতই সৃজনশীল কাজের প্রতি ঝোক রয়েছে তার।

ছাত্রাবস্থায় শিক্ষার্থী হিসেবে অধ্যয়নরত ছিলেন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। কিন্তু দমে যাননি। তার দৃঢ় ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ অবস্থানের কারণেই আজকের এ সফলতা। তার ইচ্ছা, কয়েক বছরের মধ্যে তিনি বাংলাদেশে রোবট তৈরির কোম্পানি খুলবেন। অথবা তার কিছু যন্ত্রপাতির উৎপাদন স্থল বানাবেন। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে কনফিগ রোবটের প্রতিষ্ঠা পরবর্তী কাজ শুরু হয়ে গেছে। এতে দেশীয় শিল্পে যেমন বিপ্লব ঘটবে, তেমন প্রযুক্তিতে আগ্রহীদের কর্মস্থলও সম্প্রসারিত হবে।

তিনি আশা করেন, ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে ধীরে ধীরে নারীরা আরও এগিয়ে আসবে। সর্বোপরি দেশের সব তরুণ প্রযুক্তিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে দেশকে বিশ্বের দরবারে সমাদৃত করবে। ১২ কোটি স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর দেশে অপার সম্ভাবনা দেখছেন বাংলাদেশি এ প্রযুক্তিকন্যা। তিনি বিশ্বাস করেন, তার রোবট মানুষের চাকরি নেবে না বরং জীবন-মান করবে সহজ। জাগো নিউজ

 

ডাক্তার আর সংযোগের প্রচেষ্টায় রিমুর নতুন জীবন

তাসলিমা সিদ্দিকা রিমু। গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) লাইভ স্টক সায়েন্স অ্যান্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। বাবা নেই। সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ দুই মাস আগে রিমু জানলেন হার্টের একটি ভাল্ব নষ্ট। জন্ম থেকে বয়ে বেড়াচ্ছেন জন্মগত হার্টের এক কঠিন রোগ। যার নাম এবস্টেইন এনোমালি। হৃদযন্ত্রের সমস্যা নিয়ে প্রথমে নিজ জেলা কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ডাক্তার দেখালো রিমুর পরিবার। তারপর ঢাকায়।

চিকিৎসা করতে অনেক টাকা লাগবে। কিন্তু এতো টাকা রিমুর পরিবার কোথায় পাবে? তারপর খুব জটিল অপারেশন। কোথায় করবে এই অপারেশন। সাধারণত ১ লাখ ভাল্ব অপারেশনের রোগীর মধ্যে একজনের এ ধরনের সমস্যা হয়। বন্ধু আর পরিবারের সদস্যরা মিলে কিছু টাকা জোগাড় করলেন। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে যে রিমুর পরির্পূণ অপারেশন সম্ভব নয়।

এ বাস্তবতায় রিমুর চিকিৎসার অর্থ সংগ্রহ করতে এগিয়ে এলো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সংযোগ : কানেক্টিং পিপল’। সংযোগ প্লাজমা ও ব্লাড ডোনেশন টিমের নিরন্তর চেষ্টা আর গ্রুপের সদস্যসহ দেশ-বিদেশের কিছু মানুষের সহযোগিতায় অর্থের সংস্থান হলো। সংযোগের স্বেচ্ছাসেবী ডাক্তারদের সহযোগিতায় রিমুর অপারেশনের জন্য খুঁজে বের করা হলো ডাক্তার। অপারেশনের ঝুঁকি আর জটিলতা জানা সত্ত্বেও রিমুকে ভর্তি নিলেন মিরপুরের আল হেলাল হাসপাতালের সিনিয়র কার্ডিয়াক সার্জন সামির আযম। ডা. সামির আযমের নেতৃত্বে গত ৭ সেপ্টেম্বর দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার অপারেশনের পর রিমুর হৃদযন্ত্র নতুন ভাল্ব পায়। পায় স্বাভাবিক ছন্দ।

এত দীর্ঘ সময়ের জটিল অপারেশন সত্ত্বেও কোনো অপারেশন চার্জ নেননি ডা. সামির আযম। রিমু গতকাল হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়েছেন। একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠছেন। অপারেশনের ধকল কাটিয়ে একটি সুস্থ হৃদযন্ত্রে নতুন জীবনের প্রহর গুনছেন। তাসলিমা সিদ্দিকা রিমুর অপারেশন বিষয়ে জানতে চাইলে ড. সামির আযম বলেন, ‘খুব গুরুতর হয়ে উঠেছিল রিমুর অবস্থা। দ্রুত অপারেশন করানোয় ঝুঁকি অনেকটা মোকাবিলা করা গেছে। রিমু এখন সুস্থ। সংযোগসহ সবার প্রচেষ্টাই রিমুকে নতুন জীবন দিয়েছে।’

সংযোগের ডাক্তার টিমের অন্যতম সদস্য ও ফেসবুক গ্রুপ অ্যাডমিন ডা. ফারজানা নাসরিন ইনা বলেন, ‘বাংলাদেশে সঠিক চিকিৎসা পরামর্শ পাওয়া অনেক সময় সাধারণ মানুষের জন্য মুশকিল হয়ে যায়। আমরা সংযোগের মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকদের কোভিডকালীন সঠিক চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে আসছি। পাশাপাশি রিমুসহ কয়েকজন রোগীর জন্য কম খরচে ভালো চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের চেষ্টা করছি। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছি, যাতে মানুষ অক্সিজেন পায়।’

সংযোগ: কানেক্টিং পিপল ফেসবুক গ্রুপের মডারেটর বুয়েট প্রকৌশলী মেহেদি হাসান বলেন, ‘সংযোগের কাজই হচ্ছে মানুষের সাথে মানুষকে যুক্ত করা। মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আমরা নানাভাবে সবাই মিলে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।’

তিনি ডা. সামির আযম, সংযোগ ফেসবুক গ্রুপের ২৪ হাজার সদস্যসহ সংযোগের ডাক্তার ও প্লাজমা টিমের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

৫০০ টাকার যবের ছাতু ও আটায় লাখপতি নিপা

তরুণ উদ্যোক্তা নিপা সেনগুপ্ত (২৩) কাজ শুরু করেন বরেন্দ্র অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী যবের ছাতু ও যবের আটা নিয়ে। তিনি শুরু করেন মাত্র ৫০০ টাকা মূলধন দিয়ে। আস্তে আস্তে পরিচিতি বাড়তে থাকে। আসতে থাকে পজিটিভ রিভিউ। কাস্টমারের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে পণ্যতালিকায় যুক্ত হয় গম, চাল, মসুর ও ছোলার মিশ্রণে ‘পঞ্চ-ব্যাঞ্জন ছাতু’।

এরপর ধীরে ধীরে যুক্ত হতে থাকে ভেজালমুক্ত আখের গুড়, পাবনার ঘি, গমের লাল আটা, দেশি ধানের চাল, মৌসুমী আচার, দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় ফলের গাছ। ব্যবসা শুরুর ৩ মাসের মধ্যে সব পণ্য মিলিয়ে নিপার আয় হয় প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার টাকার উপরে। সাথে সাথে উই গ্রুপেও পরিচিতি বাড়ে।

তরুণ নারী উদ্যোক্তা নিপা সেনগুপ্ত বলেন, ‘অনার্স শেষ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। পাঁচটি পরীক্ষাও শেষ হয়েছিল। এরমধ্যেই করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। আমিও বাসায় বন্দি হয়ে গেলাম। এসময় এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে উই গ্রুপে যুক্ত হই। এখানকার নারীদের কাজ দেখে আমি অভিভূত হয়ে যাই।’

সফল এ নারী আরও বলেন, ‘প্রথমেই ভালো লাগা তৈরি হয়। আস্তে আস্তে নিজের প্রতি বিশ্বাস তৈরি হয়। স্বামীর সহযোগিতায় রাজশাহী অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী যবের ছাতু নিয়ে কাজ শুরু করি। কিন্তু ভাবিনি, এই ছাতু নিয়েই আমি লাখপতি হতে পারব। বর্তমানের উই থেকে আমার সেল প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার টাকারও উপরে।’

নিপা সেনগুপ্তের কাজের সাথে এ অঞ্চলের দু’জন নারী যুক্ত হয়ে পরিবারকে সহযোগিতা করছেন। রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামের আবেদা বেগম (৪৮) বলেন, ‘নিপা বাজার থেকে যব কিনে আমাদের কাছে দেয়। আমরা যবগুলো পরিষ্কার করে শুকিয়ে বালুতে ভেজে দেই। এর জন্য নিয়মিত টাকা পাই। যাতে সংসারের অনেক উপকার হয়। বাড়তি আয় করতে পারি।’

 

ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে সাইকোলজি কী বলে

 

ডা. মাহাবুবা রহমান

নারীর প্রতি সহিংসতা বিশ্বের ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। উনিশ শতকের সতীদাহ প্রথা থেকে শুরু করে একবিংশ সমাজের ডমেস্টিক ভায়োলেন্স, যুগে যুগে এভাবেই সহিংসতার রূপ বদলেছে। তবে সব যুগের সব সহিংসতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বর্তমান যুগের ধর্ষণ। হ্যাঁ, ধর্ষণ শব্দটি নতুন কিছু নয়। তারপরও ‘বর্তমান যুগের ধর্ষণ’ বলার কারণ এখন প্রতিনিয়ত যেসব ধর্ষণের খবর পাচ্ছি- এতটা বিকৃত, এতটা পাশবিক যৌনাচারের খবর কি আগে কখনো শুনেছেন?

আগে কয়টা ধর্ষণের খবর এমন শুনতেন, যেখানে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়? দুলাভাই তার নিজের ভাইদের নিয়ে শালীকে গণধর্ষণ করে? ৭২ বছরের বৃদ্ধা গোসল করতে গিয়ে ধর্ষিত হয়? সন্তানের বয়সী ছেলেরা মায়ের বয়সী নারীকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে, উল্লাস করে, আঘাত করতে করতে ধর্ষণ করে?

এমন একটি দিন নেই; যেদিন সোশ্যাল মিডিয়া বা পত্রিকা খুললে একটি ধর্ষণের খবর পাওয়া যায় না। ক্রমবর্ধমান হারের এ অপরাধ সম্পর্কে অনেকের অনেক মত, কেউ বলেন সামাজিক অবক্ষয়, কেউ বলেন ক্ষমতার অপব্যবহার। কিন্তু নিকৃষ্টতম এ আচরণের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা কী? একটু বোঝার চেষ্টা করি চলুন।

নারীর প্রতি সহিংসতার সাইকোলজি বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে ‘সহিংসতা’ বা সাইকোলজিতে আমরা যেটা পড়ে থাকি, ‘Aggression’ তার পেছনের তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা। সাইকো অ্যানালাইসিসের জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েড একটি সময় পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন, মানবচরিত্রে জন্মগতভাবে একটি গুণ বিদ্যমান- যার অর্থ ভালোবাসা। এ ভালোবাসা আছে বলেই মানুষে মানুষে প্রেম হয়, তারা একে অপরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, একসাথে থাকে, বংশবৃদ্ধি করে। মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখতে যার ভূমিকা অপরিহার্য। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে ফ্রয়েডের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসে। তিনি তখন দ্বিতীয় আরেকটি ড্রাইভের অবতারণা করেন, যার নাম দেন ‘থানাটস’।

থানাটস শব্দের অর্থ আত্মধ্বংসী মনোভাব। ফ্রয়েডের মতে, প্রতিটি মানুষের মাঝে জন্মগতভাবেই এ দুটি ড্রাইভ পাশাপাশি বিদ্যমান। মানবজাতি একইসাথে ভীষণ রকমের সৃষ্টিশীল এবং বিধ্বংসী। তার মতে, সময়ে সময়ে মানুষের এ বিধ্বংসী মনোভাব প্রকাশ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ঠিক যেমনইভাবে প্রয়োজন পড়ে তার ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং যৌন চাহিদা প্রকাশের।

পরবর্তীতে অনেক সাইকোলজিস্ট এবং সোশ্যিওলজিস্ট অ্যাগ্রেশন নিয়ে কিছু থিওরি দেন। উল্লেখযোগ্য থিওরিগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করছি-

ইন্সটিঙ্কট থিওরি: নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, জন্মগতভাবে মানুষের মাঝে যে অ্যাগ্রেশন থাকে, সেটাই ইন্সটিঙ্কট থিওরির আলোচ্য বিষয়। সে হিসেবে ফ্রয়েডের থিওরিটির অন্তর্ভুক্ত। পরবর্তীতে ইথিওলজিস্ট কোনার্ড লরেঞ্জ তার বই ‘অন অ্যাগ্রেশনে’ও এ থিওরি নিয়ে আলোচনা করেন।

ফ্রাস্টেশন-অ্যাগ্রেশন হাইপোথিসিস: ফ্রয়েডীয় ইন্সটিঙ্কট থিওরি দিয়ে প্রভাবিত সাইকোলজিস্ট জন ডলার্ড এবং তার কয়েকজন কলিগের সমন্বয়ে প্রকাশিত বই ‘ফ্রাস্টেশন অ্যান্ড অ্যাগ্রেশনে’ সর্বপ্রথম এ থিওরির প্রকাশ। এ থিওরি অনুযায়ী, জন্মগতভাবে মানুষ যে অ্যাগ্রেশন নিয়ে আসে, সেই অ্যাগ্রেশনের প্রকাশ ঘটে কিছু নির্দিষ্ট পরিবেশ বা পরিস্থিতিতে। তেমনই এক পরিস্থিতি হলো ‘হতাশা’। জন ডলার্ডের মতে, ফ্রাস্টেশন সব সময়ই অ্যাগ্রেশনে রূপ নেয়, মতান্তরে অ্যাগ্রেশন হল ফ্রাস্টেশনের একটি ফলাফল।

এ হতাশা বা ফ্রাস্টেশনের উৎস হতে পারে জীবনের মৌলিক চাহিদার অভাব কিংবা অন্য যেকোনো কিছু। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয়টি হচ্ছে, ফ্রাস্টেশন থেকে উদ্ভুত এ অ্যাগ্রেশন সব সময় ফ্রাস্টেশনের মূল উৎসের প্রতি না হয়ে হতে পারে অন্য কোনো বস্তুর প্রতি। একে বলে, ‘ডিসপ্লেসড অ্যাগ্রেশন’। সমাজে এটিই বরং অহরহ দেখা যায়।

উদাহরণস্বরূপ, অন্যান্য দিনের মত সকালে অফিসে যাওয়ার পর আপনি জানতে পারলেন, আগামী মাস থেকে আপনার চাকরিটা আর থাকছে না। আকস্মিক এ চাকরিচ্যুতির ঘোষণা আপনাকে ভয়াবহ রকমের ফ্রাস্টেশনে ফেলে দিলো। মনে মনে তৈরি হলো বসের প্রতি তীব্র ক্ষোভ। কিন্তু আপনার পক্ষে তো আর সম্ভব না বসের প্রতি ক্ষোভ দেখানো। তাই ক্ষোভটা ডিসপ্লেসড করলেন বাসায় ফিরে আপনার স্ত্রী বা সন্তানের ওপর। অর্থাৎ ফ্রাস্টেশন থেকে সৃষ্ট অ্যাগ্রেশনটি আপনি দেখালেন আপনার জন্য মোটামুটিভাবে নিরাপদ এবং আপনার চেয়ে কম ক্ষমতার অধিকারী একটি জায়গায়।

আরেকটি উদাহরণ দেই, প্রায়ই আমরা শুনি বা অনেকসময় নাটক-সিনেমায়ও দেখি, গ্রামের প্রতাপশালী চেয়ারম্যানের কুলাঙ্গার ছেলে অমুক বাড়ির দরিদ্র বাবার মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এ ছেলে তার বাবার কাছে উঠতে-বসতে অপমানিত হয় এবং এরকম একটি ছেলে কখনো তার থেকে মোটামুটি ক্ষমতাবান কোনো পরিবারের মেয়েকে অত্যাচার করার সাহস দেখাবে না। তাহলে আপনারাই এখন ভাবুন, ফ্রাস্টেশন-অ্যাগ্রেশন থিওরি অনুযায়ী, এ ঘটনাটাকে ব্যাখ্যা দেওয়া যায় কি না। শিশুদের প্রতি যৌন সহিংসতাকেও আমি এর অন্তর্ভুক্ত করব।

অ্যারোস্যাল অ্যান্ড অ্যাগ্রেশন: ডলফ জিলম্যানের এ থিওরি বেশ ইন্টারেস্টিং। এর মূল বক্তব্য হলো, একটি উৎস থেকে সৃষ্ট উদ্দীপনা অন্য একটি বস্তুতে প্রবাহিত করা। উদাহরণস্বরূপ, রাস্তা-ঘাটে আসতে-যেতে দেখবেন চলন্ত অবস্থায় এক রিকশার সাথে আরেক রিকশার সামান্য একটু ধাক্কা লাগতেই রিকশাওয়ালা দুজনের মধ্যে গালাগালের ধুম পড়ে যায়। পারলে একজন আরেকজনকে মেরেই ফেলেন এমন অবস্থা আর কি। অথচ ঘটনা খুবই সামান্য। এর কারণ হলো, অলরেডি শারীরিক পরিশ্রমের দরুণ তারা ফিজিক্যালি অ্যারোসড বা এক্সাইটেড হয়ে আছেন। এমতাবস্থায় ধাক্কা লাগা বিষয়টি তাদের একটি সুযোগ এনে দিলো নিজের ফিজিক্যাল অ্যারোস্যালকে আরেকজনের ওপর চ্যানেলাইজ করার।

অন্যভাবে আরেকটি উদাহরণ দেই, ধরুন, আপনি রেস্টুরেন্টে বসে আপনার প্রিয় মানুষের জন্য অপেক্ষা করছেন। এ অপেক্ষা আপনার জন্য বিরক্তিকর নয়, আনন্দের। অর্থাৎ আপনি অলরেডি খুব রোমান্টিক মুডে আছেন। এমতাবস্থায় রেস্টুরেন্টে বাজতে থাকা একটি রোমান্টিক গান আপনার মাঝে এত বেশি ভালো লাগা তৈরি করবে, যেটি হয়তো এর আগে হাজারবার শুনেও আপনার মধ্যে তৈরি হয়নি। এখানে আপনার রোমান্টিক মুডটা চ্যানেলাইজড হয়ে গেল গানের প্রতি।

ধর্ষণের সাথেও অ্যাগ্রেশনের এ থিওরিকে খুব চমৎকারভাবে রিলেট করা যায়। যেমন ধরুন, যে ছেলে ইতোমধ্যে মাদক সেবন করে অথবা পর্নোগ্রাফিক মুভি দেখে ফিজিক্যালি অ্যারোসড হয়ে আছে, সেই ছেলে সুযোগ পাওয়া মাত্রই তার এই ফিজিক্যাল অ্যারোস্যালটি চ্যানেলাইজড করে দেবে একজন নারীর ওপর। সেক্ষেত্রে সেই নারীর সাথে তার পূর্বপরিচয়, ভালো লাগা, নারীর বয়স, নারীর কাপড় (যেহেতু সমাজের একটি বড় অংশ ধর্ষণ প্রসঙ্গে নারীর কাপড় টেনে আনেন) এসবের কিছুরই প্রয়োজন নেই।

সোশ্যাল লার্নিং অ্যান্ড অ্যাগ্রেশন: অ্যাগ্রেশনের সবগুলো হাইপোথিসিসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হাইপোথিসিস এটি। লার্নিং সাইকোলজির একেবারেই বেসিক একটা বিষয়। একটা শিশু বড় হয়ে কেমন মানুষ হবে, তার ব্যক্তিত্ব কেমন হবে, আচরণ কেমন হবে- সেই সবকিছু যতটা তার জেনেটিক মেকাপের ওপর নির্ভর করে, ততটাই নির্ভর করে লার্নিংয়ের ওপর। এ থিওরি অনুযায়ী, অ্যাগ্রেসিভ আচরণ গড়ে ওঠে রিইনফোর্সমেন্ট এবং অ্যাগ্রেসিভ মডেলদের অনুকরণের মাধ্যমে।

এখানে আলোচ্য বিষয় তাহলে দুটি-

লার্নিং থ্র রিইনফোর্সমেন্ট: রিইনফোর্সমেন্ট মানে সোজা বাংলায় যে জিনিস আপনার একটি আচরণকে বৃদ্ধি করে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু কিছু বাচ্চা আপনি দেখবেন যে কোনো কিছু চাইতে হলে চিৎকার-চেচামেচি করে চায়। এর কারণ হলো সে স্বাভাবিকভাবে হয়তো কখনো একটি জিনিস চেয়েছে, পায়নি। কিন্তু যখন সে চিৎকার করে মাটিতে গড়াগড়ি করেছে, তখন বাবা বা মা তাড়াতাড়ি তাকে থামানোর জন্য ওই জিনিসটি কিনে দিয়েছে। এখানে তার অভিভাবক যে তাকে ওই জিনিসটি কিনে দিলো, এটা হলো রিইনফোর্সমেন্ট। বাচ্চা যে চিৎকার করছিল, এটা বাচ্চার আচরণ এবং বাচ্চার লার্নিংটি হলো এরপর থেকে কিছু পেতে হলে অবশ্যই চিৎকার করতে হবে।

এবার আসি ধর্ষণের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি কিভাবে কাজ করে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেই বলি। প্রথমত, আমাদের দেশে ম্যাক্সিমাম মেয়েরা সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের কথা প্রকাশ করে না, ধর্ষণও না। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের কেসটার কথাই ধরুন। ধর্ষণের ৩২ দিন পর ঘটনাটি প্রকাশিত হয়। তাও প্রকাশিত হয় সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে, কয়েকজনের লেখালেখির মাধ্যমে।

তার আগ পর্যন্ত কিন্তু ধর্ষিতা বা ধর্ষিতার পরিবার কোনো মামলা করেনি। এখানে ধর্ষিতাকে আমি দোষ দেব না। আমাদের সমাজব্যবস্থাই এমন। এখানে মেয়েরা ধর্ষিতা হলে তাদের সম্মানহানি(!) হয়, মামলা করতে গেলে থাকে ক্ষমতাশীলদের হাতে প্রাণ হারানোর ভয়। সে যাই হোক, আমি আমার সাইকোলজিতে ফিরে আসি। এই যে চুপ থাকা, ব্যাপারটা ধর্ষকদের ক্ষেত্রে রিইনফোর্সমেন্ট হিসেবে কাজ করে। তাদের জানা হয় যে, এরকম কাজ বারবার করাই যায়, কেউ তো আর মুখ খুলবে না। দ্বিতীয়ত, বিচারহীনতা বা বিচার হলেও সুষ্ঠু বিচার না হওয়া এটাও ধর্ষকদের জন্য রিইনফোর্সমেন্ট। এতেও তাদের বারবার ধর্ষণ করার শিক্ষা হচ্ছে।

লার্নিং থ্র দ্য ইমিটেশন অব অ্যাগ্রেসিভ মডেলস: এটি আরেকটি ভয়ানক এবং আমি মনে করি, ধর্ষণের প্রথমসারির কারণগুলোর একটি। আমাদের দেশে ছোটবেলা থেকে একটা ছেলে এটা দেখে দেখে বড় হয় যে, তার বাবা তার মাকে উঠতে-বসতে গায়ে হাত তোলে, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। পাড়ার সো কল্ড বড় ভাই পাড়ার মেয়েদের দেখলেই শিষ দেয়, ওড়না ধরে টান দেয়, অশালীন অঙ্গভঙ্গি করে। এখানে যে ফাদার ফিগারের কথা বললাম, তিনি এবং এলাকার সেই বড় ভাই হচ্ছেন মূলত অ্যাগ্রেসিভ মডেলস।

যাদের ছোটবেলা থেকেই দেখে দেখে ছেলেটি শিখে নেয়, সমাজে মেয়েদের সাথে যা ইচ্ছা করা যায়, চাইলেই তার বুকে হাত দেওয়া যায় কিংবা তার সাথে যৌনক্রিয়া সম্পাদন করা যায়। এতে কোনো অসুবিধা নেই। এটাই নিয়ম।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যাগ্রেসিভ মডেল হচ্ছে পর্নোগ্রাফি। পর্নোগ্রাফিতে যে রোলগুলো দেখানো হয়, সেখানে কী হয়? মেইল রোলগুলো থাকে প্রচণ্ড রকমের ডমিনেটিং এবং ভায়োলেন্ট। যারা তাদের ফিমেল পার্টনারের সাথে ইচ্ছামত বিকৃত যৌনাচার চালিয়ে যায়। আর ফিমেল পার্টনারটিও যেন সেসব বিকৃতি বেশ উপভোগ করছে এমনটিই দেখানো হয়। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে একজন ছেলে যখন তার জীবনের প্রথম সেক্স এডুকেশনই পায় এধরনের পর্নোফিল্ম দেখে, তখন তার এটাই লার্নিং হয় যে, এখানে এ মডেলরা যা করছে, এটাই স্বাভাবিক। যৌনসঙ্গম ব্যাপারটা এমনই। মেয়েদের সাথে এটাই করতে হয়। এমনকি একটি শিশুর সাথেও এগুলো করা যায়। এতে মেয়েদের কোনো কষ্ট হয় না বরং তারাও ব্যাপারটা এনজয় করে (যেটা একদমই সঠিক না)। মেয়েদের ক্ষেত্রে সেক্স ব্যাপারটা যতটা না ফিজিক্যাল তার থেকে অনেক অনেক বেশি মেন্টাল।

আমি যে শুরুতে বলেছিলাম, বর্তমান যুগের ধর্ষণ; যেখানে বিকৃত যৌনাচারের হার অনেকগুণ বেশি, তার পেছনে পর্নোগ্রাফি বা চটি বইয়ের বিকৃত যৌনাচারই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী বলে আমি মনে করি।

এতক্ষণ তো বললাম শুধু অ্যাগ্রেশন হাইপোথিসিসের কথা। কিন্তু শুধু অ্যাগ্রেশন দিয়েই ধর্ষণকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না। যেকোনো অপরাধের পেছনে একজন মানুষের পার্সোনালিটির বিরাট গুরুত্ববহন করে। আর পার্সোনালিটি বা ব্যক্তিত্বের কথা বলতে গেলেই চলে আসে মেন্টাল স্ট্রাকচার নিয়ে ফ্রয়েডের সেই চমৎকার কনফিগারেশনের কথা-

ইড: ইড হচ্ছে সোজা বাংলায় মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। যেখানে কোনো সামাজিক মূল্যবোধ, বিবেকবোধ এসবের বালাই নেই। যেমন আপনার প্রচণ্ড খিদা পেয়েছে এবং আপনার কাছে কোনো খাবার নেই, খাবার কেনার মত টাকাও নেই। কিন্তু আপনি দেখলেন একটু সামনেই একটা খাবারের দোকান। আপনি সেই দোকানে ঢুকলেন, দোকানিকে কিছু না বলেই একটা খাবারের প্যাকেট তুলে নিয়ে হাঁটা দিলেন। কাজটা ঠিক না বেঠিক সেসব চিন্তা আপনার মাথায় আসবে না। আপনার খিদা পেয়েছে, সেটা নিবারণ করাই এখন আপনার কাছে মুখ্য।

ইগো: ইগো হচ্ছে ইড এবং সুপার ইগো এ দুয়ের মধ্যে ব্যালেন্স। ইগো আমাদের বাস্তবধর্মী সিদ্ধান্ত নিতে শেখায়। বস্তুত, যে মানুষের ইগো যত ভালো; সে সামাজিকভাবে তত বেশি খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। ইগো আমাদের শেখায় খিদা পেলে যদি আমার খাবার কেনার সামর্থ না থাকে, সেক্ষেত্রে আমরা কী কী করতে পারি। আমরা কোনো বন্ধুর থেকে ধার নিয়ে খাবার কিনতে পারি, কিংবা দোকানি পরিচিত হলে অনুরোধ করতে পারি, আমাকে এক প্যাকেট খাবার আপাতত বাকিতে দিতে, আমি পরে পরিশোধ করে দেব।

সুপার ইগো: এটি হচ্ছে আমাদের নীতিবোধ বা বিবেকবোধ। এ বিবেকবোধ সামাজিক অথবা ধর্মীয় মূল্যবোধ যেকোনোটি থেকেই আসতে পারে। সুপার ইগো আমাদের শেখায় খিদা পেলেই একটি দোকানে ঢুকে নিজের ইচ্ছামত খাবার তুলে নিয়ে চলে যাওয়া যায় না। এটি নীতিগতভাবে সঠিক নয়।

ধর্ষকদের মাঝে এই ইগো বা সুপার ইগো কোনটিই কাজ করে না। তাদের সব কিছুকে ছাড়িয়ে যায় তাদের ইড। একজন নারীর শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার চেয়ে তার নিজের সেক্সুয়াল প্লেজার পাওয়ার বিষয়টিই তার কাছে মুখ্য।

সবশেষ আরেকটি ভিন্ন বিষয় নিয়ে একটু বলি। হিউম্যান সেক্সুয়াল রেসপন্স সাইকেলের অনেকগুলো সেক্সুয়াল মডেলের মধ্যে একটি হলো জন ব্যানক্রফটের ডুয়াল কন্ট্রল মডেল। মডেলের বিস্তারিত আলোচনায় আমি যাব না। এখানে যেটি মূলকথা সেটি হচ্ছে, সেক্সুয়াল অ্যাক্টিভিটি আমাদের নার্ভাস সিস্টেমের এক্সিটেটরি এবং ইনহিবিটরি দুই মেকানিজমের ব্যালেন্সের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। এখন যাদের ক্ষেত্রে ‘Low excitation’ এবং ‘High inhibition’ থাকে, তাদের ক্ষেত্রে সেক্সুয়াল ডিসফাঙ্কশন হওয়ার একটি সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে যাদের ‘High excitation’ এবং ‘low inhibition’ থাকে, তাদের ক্ষেত্রে রিস্কি সেক্সুয়াল বিহেভিয়র’ (ধর্ষণ) হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর।

পরিশেষে একটি কথা না বললেই নয়। ধর্ষণের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে আমার লেখাটির পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্ষণ প্রতিরোধে ঠিক কোন কোন জায়গায় কাজ করা উচিত, কেন করা উচিত- সে বিষয়ে একটি বিজ্ঞানসম্মত ধারণা দেওয়া, ধর্ষণকে নরমালাইজ করা নয়। কারণ আমি জানি, আমাদের আশেপাশেই অনেক রেপিস্ট বা পটেনশিয়াল রেপিস্ট ভালো মানুষের চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

তারা কেউ কেউ হয়তো এটা বলবে, সবই যখন সাইকোলজিকাল কারণে হয়, তাহলে মানুষের কী দোষ! দোষ অবশ্যই আছে। আপনি চাইলেই মাদকাসক্ত না হতে পারেন, চাইলেই পর্নোগ্রাফিক মুভি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারেন, চাইলেই ধর্মীয়, পারিবারিক, সামাজিক অনুশাসন মেনে আপনার ইগো, সুপার ইগোকে উন্নত করতে পারেন। তা না করে, সব দোষ সাইকোলজি আর মেয়েদের পোশাকের- এসব কথা বলে বলে নিজেকে পটেনশিয়াল রেপিস্ট থেকে রেপিস্টে উন্নীত করার দায়ভার অবশ্যই আপনার।

লেখক: রেসিডেন্ট, ডিপার্টমেন্ট অব চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডলোসেন্ট সাইকিয়াট্রি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

সৌজন্যে : জাগোনিউজ