banner

সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: November 15, 2024

 

বটবৃক্ষের গল্প

বটবৃক্ষের গল্প


জিনাত তাসনিম


প্রত্যেকটি মানুষের শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য কিংবা জীবনের যেকোনো স্তরে কাছের কিংবা দূরের কোনো মানুয হয়ে ওঠে তার পরম নির্ভরতার ঠিকানা।তার প্রেরণার বাতিঘর। নিজের শৈশবের ঝাপসা স্মৃতি গুলোতে একটু নির্জনে ডুব দিলে ভেসে ওঠে, কিছু প্রিয় মুখ।সেই শীতের সকাল,চারিধারে কুয়াশার চাদর,প্রিয় মানুষের হাত ধরে তিড়িং বিড়িং লাফিয়ে চলা সেই গাঁয়ের মেঠোপথে। তিনি মাঝেমাঝেই থেমে যাচ্ছেন, কুয়াশার ওপার থেকে ডাক আসে…মিয়াভাই,ওও নানা সাথে সালাম,তিনি দাড়াচ্ছেন, হাসিমুখে কথা বলছেন, তাদের সমস্যা শুনছেন। এদের মধ্যে কেউবা কখনো তাকে ঠকায়, কেউ তার ক্ষতি করে, কেউ তার সমালোচনা করেন।তিনি সবার সাথে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক রাখতেন, কখনো কারো সমালোচনা করতে দেখিনি। জমির ফসল ঘরে এলে যে সাহায্যে চাইতেন তাকেই সাহায্য করতেন।বাসে বা রিকশায় তার সাথে ভ্রমণ ছিলো শিক্ষণীয়। বিভিন্ন রাস্তা চেনা,বিভিন্ন স্হানের ইতিহাস জানা।শৈশবের হাতেখড়ি হয়েছিল তার কাছে। আমার পুরো জীবনে আমি এত নিষ্ঠাবান শিক্ষক পাইনি।আমি খুব ফাঁকি বাজ ছাত্র, তিনি পড়ে যাচ্ছিন,আমি কখনো তার টাক মাথায় বসা মশার পিছনে ছুটছি, কখনো খেলার সাথী দের কথা ভাবছি। যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি,তিনি ঠিক করলেন আমি বৃত্তি পরীক্ষা দিবো।এ বিষয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নাই,উনি বইগুলো পড়ে শোনাচ্ছেন, আমি মাদুরে গড়াগড়ি দিচ্ছি। পরীক্ষার দিন আমরা পরীক্ষা দিতে গেলাম,প্রশ্নও কমন, কিন্তু আমার চিন্তা উনি আছেন না আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন?আমি প্রতি পনেরো মিনিট পর পর বের হচ্ছি,তার সাথে কথা বলছি। তিনি আমাকে আশস্ত করছেন তিনি আছেন। রোগ কাতুরে আমি ক্লাস ফোরের আগে স্কুলে যায়নি। আমার বৃটিশ আমলে মেট্রিকুলেশন পাশ করা,তুখোড় অংক শিক্ষক আমাকে আমার বেসিক তৈরী করে দিয়েন।তিনি কখনো রাগ করতেন না,খুব ধৈর্য সহকারে পড়াতেন।পাড়ার অন্যান্য বাচ্চারা যারা খেলার সাথী ছিলো। ওরা খারাপ কথা বলতো,কখনো অন্যের জিনিস না বলে নিয়ে যেতো।তিনি বুঝাইতে খারাপ কথা কেন বলা যাবেনা,কাউকে না বলে তার জিনিস আনা যাবেনা।প্রত্যন্ত গাঁয়ে আমাদের বাড়ি। তবু সেখানে দৈনিক সংবাদ পত্র পড়া হতো,সকাল সন্ধে ট্রানজিস্টার রেডিও তে বিবিসি সংবাদ শোনা হতো,প্রতিটি ঘর ছিলো বইপত্রে ঠাসা। সবাই পড়তে ভালোবাসি। গাঁয়ের অন্য ঘরগুলোতে যখন বৈষয়িক বিষয় নিয়ে তুমুল ঝগড়াঝাটি, আমাদের বাড়িতে বিতর্ক হতো ইতিহাস, ইসলাম, রাজনীতি নিয়ে।এমন একটা পরিবেশ তৈরি করে ছিলো আমার শিক্ষক। জীবনের যেকোনো সংকটে আভয় আর আশ্রয় স্হল ছিলেন তিনি।সবসময় উত্সাহো দিতেন।তার প্রিয় সূরা ছিলো সূরা রহমান। তিনি জীবনের শেষ দিন গুলিতে যখন খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন, বারবার বলতেন বাংলা তরজমা সহ সূরা রহমান পড়ে শুনাতে।দাদা দাদী মা যখন বিছানায় একদিন দাদী খুব অসুস্থ। দাদা বারান্দায় বসে বারবার তার খবর নিচ্ছেন। আমি সূরা রহমান পড়ছি।একটু পর দাদীকে নিতে এ্যাম্বুলেন্স এলো,দাদা আমাকে বললেন,তোমার দাদীকে আমার সালাম দাও।আমি অবচেতন দাদীকে সালাম পৌঁছে দিলাম।তার মতো বিনয়ী শিক্ষক আমি আর পাইনি। তার মৃত্যু র সময় আমি দূরে ছিলাম। যখন তার কাছে আসলাম,আমি তার নিথর দেহটার কাছে যেতে পারছিলাম না।বরাবরের মতো আমার অভিমান,আপনি আমাকে না বলে চলে গেলেন কেন?সবার অনুরোধে আমি তার সামনে দাড়ালাম। স্মিত হাস্যমুখ, মাথার কাছে একটা সবুজ প্রজাপতি বসে আছে।কি শান্ত আর সুখী দেখাচ্ছে তাকে।আমি নির্বাক হয়ে চেয়ে আছি, আমাদের শেষ বিদায়ের ক্ষণে। আমি অভিমান ভুলে মনে মনে বললাম, হে প্রশান্ত আত্মা যাও তোমার প্রিয় রবের কাছে, যিনিই উত্তম ফয়সালা কারি।