banner

সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: November 15, 2024

 

জীবনের বাতিঘরে নারী

জীবনের বাতিঘরে নারী


আসিফ মাহমুদ


এ্যাভারেজ আমেরিকান মহিলারা মাত্র সাতাশ মিনিট আর বাঙ্গালি মহিলারা গড়ে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা সময় প্রতিদিন রান্নাঘরে ব্যয় করে। বাংগালী নারীদের জীবনের বিশাল অংশ এই রান্নাঘরেই কেটে যায়। কয়েকসপ্তাহ আগে আমার প্রতিবেশী হ্যারল্ডের বাসায় আমাদের ডীনারের দাওয়াত ছিলো। সন্ধ্যা ছটার আগেই সাধারণত এরা ডীনার শেষ করে। একেবারে ঘড়ির কাঁটায় ঠিক ছটা বাজেই ডীনার শুরু হলো। ডীনারের আয়োজন ছিলো টুনা ফীস, সালাদ, কিছু চিপস আর কোমল পানীয়। ব্যস । হ্যারল্ডের ওয়াইফ ম্যারি আর হ্যারল্ড আমাদের সাথে ক্লান্তিহীন আড্ডা দিলেন। রান্নার আয়োজন যেহেতু কম-আড্ডার আয়োজনতো সুন্দর হবেই। বুঝলাম , নিমন্ত্রন মানে শুধু ভোজন না। নিমন্ত্রণ হলো আপনার জীবনের কিছু অংশ আর আমার জীবনের কিছু অংশ একসাথে পাশাপাশি বসে উপভোগ করা।

কেউ যদি বলে বাংগালীরা আড্ডা প্রিয়। কথাটি ভুল। আমরা আসলে ভোজনপ্রিয়। আমাদের বাসায় কারো দাওয়াত মানেই বিশাল রান্নার আয়োজন। কে কত আইটেম বাড়াতে পারে ভাবীদের সাথে ভাবীদের চলে এর প্রতিযোগিতা। যেদিন অতিথিদের নিমন্ত্রণ বলতে গেলে এর এক সপ্তাহ আগে থেকেই শুরু হয় রান্নার আয়োজন। একেকটা রান্নার আয়োজন একেকটা ঘুর্ণিঝড়। এরকম ঘুর্ণিঝড়ের ভিতর সময় পার করে ঘরের বউ, ভাবী ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। সুতরাং সুন্দর পরিবেশে বসে আড্ডাটা হবে কখন?

রান্নাঘর আর বাথরুম দেখে মানুষের পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা পাওয়া যায়। হ্যারল্ডের ঘরে পা দিয়েই বুঝা গেলো- কত সুন্দর, পরিপাটি আর কত পরিচ্ছন্ন হতে পারে একটি ঘরের পরিবেশ। সুন্দর ঘর রাখার অন্যতম প্রধান কারণ হলো- ওদের রান্নার আয়োজন খুবই কম। আপনি যখন গরম তেলের ওপর দুনিয়ার নানা রকমের মশলা ছাড়বেন- সাথে সাথেইতো ঘর গ্রীজি হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে দিবে। আর এই তৈলাক্ত গ্রীজ শুধু আপনার কিচেন নষ্টই করছেনা। আপনার উদরও নষ্ট করছে।

তবে কি আমেরিকানরা রান্না করেনা। না করলে এতো গ্রোসারি আইটেম যায় কই । জ্বি করে। বেশ আয়োজন করেই করে। তবে একদিনে চৌদ্দ পনের পদ তৈরি করে- ডাইনিং টেবিলের এই মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেনা। আমি নিজেও বুঝিনা। এতো পদ দিয়ে একসাথে খাবার খেয়ে এতো ভূরিভোজনের দরকারটাই বা কি? কালকে মারা গেলে- আজকে বেশ করে খেয়ে নেন ঠিক আছে। কিন্তু তাই যদি না হয়- তবে আজকে দুপুরে এক আইটেম দিয়ে খান। রাতের বেলা আরেকটা দিয়ে খান। এভাবে প্রতিদিন একেকটা আইটেম দিয়ে খেলেইতো নানা রকমের খাবারের স্বাদ পাওয়া যায়।

আমাদের পিকনিক মানেই ঐ খাবার দাবার। গাড়ীতে খাবার ঢুকাও, গাড়ী থেকে খাবার নামাও, খাবার সাজাও, খাবার রান্না করো, খাবার পরিবেশন করো, খাবারের পর এবার তালা, বাসন, বাটি, ঘটি গাড়িতে তোল। ব্যস খাবারের আয়োজনের ভিতরই পিকনিক শেষ। একবার সমূদ্র দর্শন করতে গিয়ে দেখলাম- এক আমেরিকান কী সুন্দর করে ফোল্ডিং চেয়ার খোলে পানিতে পা ভিজিয়ে বসেছে। ঘন্টার পর ঘন্টা যায়। সে বসা। তার মাথার ওপর ছাতা। পাশে একটা ড্রিংক। বুঝা গেলো সে আজ মন প্রাণভরে সমূদ্র দেখবে। আর আমরা- খাবার খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সমূদ্র দেখলাম। আর সমূদ্র দেখার পাশাপাশি এই দোকানে ঢু মারলাম, আরেক দোকান থেকে বের হলাম, একটু এদিক ওদিক ঘুরলাম, রাজনীতি, কম্যুনিটি নীতি, ট্রাম্প, মোদি, গদি, হাসিনা, খালেদা, পাপিয়া, সাফিয়া,কাদেরি , তাহেরি সহ দুনিয়ার সব বিষয়ে বিপুল আলোচনা, হালকা বাক বিতণ্ডা, ঝাপসা মনোমালিন্য নিয়ে সমূদ্র জয়ের পাশাপাশি দুনিয়া জয় করে ঘরে ফিরলাম।

গত শনিবার। গ্রোসারি কিনতে যাবো। দেখি হ্যারল্ড। সেও আমার সাথে যাবে। আমাদের গ্রোসারির লিস্টি মাশাল্লাহ- এইগুলো একটার সাথে আরেকটা জোড়া লাগালে- চাঁদের দেশে যাওয়া যাবে। মাংসের জন্য এক দোকান, মাছের জন্য আরেক দোকান। সব্জির জন্য ফার্মাস মার্কেট। সেখানে আবার দেশি লাউ পাওয়া যায়না। যাও আরেক দোকান। কাঁচামরিচের জন্য আরেক জায়গায়। দুধ-ডিমগুলো আবার এইসব দোকানে ভালো পাওয়া যায়না। যাও আমেরিকান গ্রোসারিতে। বিশাল লিস্টের যুদ্ধ শেষ করে যখন ফিরছি- হ্যারল্ড বললো- একটু দাঁড়াও। এক ফাস্টফুডের দোকানে দাঁড়ালাম। হ্যারল্ড একটা স্যান্ডউইচ কিনলো। স্যান্ডউইচের অর্ধেক সে খাবে। বাকি অর্ধেই ওর বউয়ে খাবে। ঝামেলা শেষ। সেইজন্য ওরা নাসা থেকে স্পেসে যায়। আর আমরা বেডরুম থেকে কিচেন আর কিচেন থেকে বেডরুমে যাই। আর, এর ফাঁকে ফাঁকে ইয়া বড় বড় ভুড়ি বানাই। স্পেশ স্টেশানে যাওয়ার সুযোগ আসলে আমরা খোঁজ নিবো- কিমার জন্য ফ্রেশ গ্রাউন্ড বীফ, কাচ্চি বিরিয়ানির মশলা, ডালের জন্য পাঁচফোড়ন, খাওয়ার পর গোলাপজামুন, চায়ের সাথে বিস্কুট, পানের সাথে চুন, খয়ের এসব কিছু সেখানে ঠিকঠাক পাওয়া যাবেতো?

আমি একটা জিনিস পর্যবেক্ষণ করলাম। যার গ্রোসারির ট্রলি যত বড়- মেধা আর যোগ্যতায় সে তত ছোট। যারা দরিদ্র-অর্থের অভাবে খেতে পায়না-সেটা ভিন্ন কথা। মেক্সিকান আর আমাদের গ্রোসারির ট্রলিগুলো যেন একেকটা মুদির দোকান। চেকআউট লেনে চেকআউট লেনে দাঁড়ালে মনে হয় কোনো ছোট দোকান ঘরের পিছনে দাঁড়িয়ে আছি। এতো বেশি বেশি খাবার উদরে যায় বলে আমাদের মগজে আর বেশী কিছু যায়না। হিসপানিক আর ভারতীয় অধ্যুষিত এলাকায় আপনি কোনো ভালো লাইব্রেরি কিংবা কোনো ভালো বইয়ের দোকান পাবেন না। এগুলো পাবেন শুধু সাদা বিশেষ করে ইহুদি অধ্যুষিত এলাকায়। রান্না করে আর খেয়েইতো আমাদের জীবন শেষ। অধ্যাবসায়ের অতো সময় কোথায়? বিল গেটস, মার্ক জুকারবার্গ, স্টিভ জবস ওনাদের সামনে কোনোদিনও ইয়াবড় খাবারের প্লেট দেখিনি। যেমন দেখেছি-রাজা-বাদশাহ-আমীর ওমরাহদের সামনে।

প্রিয় ভাই, চাচা, বাবা, দাদারা দয়া করে বউ, ভাবি, বোন, চাচী, মাসিদের রান্নাঘরের একচেটিয়া জীবন থেকে মুক্তি দিন। আর ভাবী, আপা আপনারাও একজনের সাথে আরেকজনের রান্নার আইটেম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা থেকে দয়া করে নিজেদের হেফাজত করুন। এক জনে পাঁচজনের জন্য প্রতিদিন পাঁচপদ রান্না না করে পাঁচজনে মিলে একপদ রান্না করুন। সম্পর্ক বাড়বে। ভালোবাসা তৈরি হবে। কষ্ট লাঘব হবে। কিচেনে আপনার সময় যত বাড়বে- ভাইয়ের ভুড়িও তত বাড়বে। আর এই ভুড়ি ভালোবাসা না। এটা সর্বনাশা। এটা জীবননাশা। জীবন ধারনের জন্য খেতেতো হবেই। কিন্তু রান্নাঘর আর ভোজন যেন আমাদের পুরো জীবনটাই খেয়ে না ফেলে- দয়া করে সেদিকে একটু লক্ষ্য রাখবেন। সারাজীবন নারীমুক্তি নারীমুক্তি করলাম। কিন্তু নারীকেতো রান্নাঘর থেকেই মুক্তি দিতে পারলাম না।

সংসার আর জীবনের বাতিঘর সব নারীদের জন্য বিশ্ব নারী দিবসে হৃদয়ের গভীর থেকে রইলো বিশুদ্ধ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।

Asif mahmud.

 

নারী দিবসে তুলে ধরতে চাই নারী অধিকারের কিছু ভুল ধারণা

নারী দিবসে তুলে ধরতে চাই নারী অধিকারের কিছু ভুল ধারণা


কানিজ ফাতিমা


একসময় সমাজে একটা ভুল ধারণা প্রচলিত ছিল যে ছেলের বউয়ের দায়িত্ব হলো নিজের বাবা-মা, ভাই-বোন ভুলে শশুর-শাশুড়ী , দেবর-ননদ, ননদ-জামাই এর সেবা করতে হবে। বর্তমানে শিক্ষিত মহলে এই ভুল ধারণার অবসান ঘটেছে। এ ধারণাটা অনেকটাই সুস্পষ্ট যে ইসলামে দেবর-ননদ, ননদ জামাই দূরে থাক, স্বয়ং শশুড় -শাশুড়ীর প্রতি নারীর ফরজ কোনো দায়িত্ব নেই। কিন্তু এটুকুই পরিপূর্ন চিত্র না –

ইসলাম শশুড় -শাশুড়ীর প্রতি নারী বা পুরুষের ফরজ কোনো দায়িত্ব দেয়নি -এই কথাটা যেমন সত্যি তেমনি সত্যি ইসলাম বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানকে কিছু দায়িত্ব বাধতামূলক বা ফরজ করেছে। নারী হলে আপনার জন্য আপনার শশুর -শাশুড়ীকে সেবা করা ফরজ নয়, কেবলই মুস্তাহাব; কিন্তু আপনার স্বামীর জন্য তাদের ভরণ-পোষণ ও দেখা-শোনা করা ফরজ । তাই আপনার স্বামীর যেমন হক নেই আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপনাকে বাধ্য করতে তার বাবা-মায়ের অর্থাৎ আপনার শশুড় -শাশুড়ীর সেবা করার জন্য, তাদের জন্য প্রতিদিন রান্না করার জন্য; তেমনি আপনারও হক নেই আপনার স্বামীকে নানা অজুহাতে বা হুমকি-ধমকি দিয়ে তার বাবা- মায়ের প্রতি তার দ্বায়িত পালনে বাধা দেয়ার। মনে রাখবেন ইসলামে কখনোই এক চোখা নয়।

অনেক সময় অনেক সচেতন স্ত্রী মনে করেন তার স্বামীর জন্য স্ত্রী -সন্তানের ভরণ পোষণ, বিনোদন, শখ সব পূরণ হবার পরে আসবে তার বাবা-মায়ের হকের প্রশ্ন। না, ব্যাপারটা সেরকম নয়। ব্যাপারটা হলো পুরুষ যা আয় করবে তাতে সর্বপ্রথম আনুপাতিক হরে তার স্ত্রী , সন্তান ও বাবা-মায়ের ভরণ পোষণ এর চাহিদা পূরণ হতে হবে। কারো ইনকাম যদি কেবল মাত্র ১০০ টাকাও হয় তবে এই ১০০ টাকা থেকেই এই সবক’টি চাহিদার জন্য টাকা বরাদ্দ হবে। ইনকাম কম তাই সবটাই স্ত্রী-সন্তান এর জন্য খরচ হবে আর বাবা-মা বঞ্চিত হবে – সেটা ইসলামের নিয়ম না। ইসলাম সর্বাবস্থায় ভারসাম্যকে গুরুত্ব দেয়।

আবার দেখা যায় অনেক কৌশলী স্ত্রী ইচ্ছা করে তাদের সংসারের চাহিদাকে হিসাব করে এমনভাবে বাড়িয়ে দেয় যাতে স্বামীর ইনকাম থেকে এরপরে আর কোনো অর্থ উদ্বৃত্ত থাকতে না পারে তার বাবা- মাকে দেবার জন্য। এমন কৌশল শুধু অন্যায়ই নয় – বরং বড় ধরণের জুলুম।

শাশুড়ী কর্তৃক ছেলের বৌ নির্যাতন যেমন নারী অধিকারের লঙ্ঘন তেমনি ছেলের বৌ কতৃক শাশুড়ীর মাতৃত্বের হক নষ্ট করাও নারী অধিকার লঙ্ঘন। স্ত্রীকে তার বাবার বাড়ী যেতে না দেয়া, বিভন্ন অজুহাতে বাধার সৃষ্টি করা যেমন নারী নির্যাতন তেমনি স্বামীকে তার বাবা-মা, ভাইবোনের সঙ্গে কথা বলতে না দেয়া, তারা বেড়াতে আসলে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব করা যাতে তারা বাড়ী থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হয় – সেটাও সুস্পষ্ট নির্যাতন।

জুলুম -নির্যাতন যে পক্ষ থেকেই হোক তা নিন্দনীয়, তা সংসারের ভিত্তিকে ধ্বংস করে। জুলুমকারীকে ভয় পেয়ে তার সঙ্গে কম্প্রোমাইজের নামে জুলুম মেনে নিলে এটি বেড়ে আরও শাখা প্রশাখা ছড়ায়। তাই সাহস ও বুদ্ধি করে জুলুমের সামনে দাঁড়িয়ে সেটা একটু শক্ত হাতে বন্ধ করতে হয়। এতে সাময়িক কিছু অসুবিধা হলেও long run এ কল্যাণ হয়।

সব নারী ভালো থাকুক; সে স্ত্রী, মেয়ে, মা বা বোনই হোক । সবাইকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা।