মোরা জোনাকি হতে চাই – ২
আফরোজা হাসান
চোখ বড় বড় করে নূরি বলল, তোমাদের কি সেপারেশন হচ্ছে নাকি? আমরা কি কোর্টে যাবো বাবা? ইশশ…ভাবতেই কেমন রোমাঞ্চ ফিল হচ্ছে। আমি আর রুহি কাঠগড়ার দাঁড়িয়ে আছি। উকিল সাহেব কোমল কণ্ঠে আমাকে প্রশ্ন করছেন, বলো মা তোমরা কার সাথে থাকতে চাও? আমরা দুজন কাঁদো কাঁদো চোখে একবার মামণির দিকে তাকাবো, একবার তোমার দিকে তাকাবো। তারপর ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলবো, জর্জ আঙ্কেল আমরা আমাদের বাবা ও মামণি দুজনের সাথেই থাকতে চাই। কারণ আমরা বাবা-মার মিলিত রূপ। তারাও আমাদের কাছে একাকার এক সত্ত্বা। আমরা তাই মামণির মমতা যেমন চাই, বাবার আদরও তেমন চাই।
নোমান সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, তোর মামণি ঠিকই বলে খুবই দুষ্টু হয়েছিস তোরা দুই বোন। রুহি কোথায়? সকাল থেকে দেখিনি একবারও।
আমি ঘুমে দেখে এসেছিলাম বাবা। এতক্ষণে মনেহয় উঠেছে। চলো বাবা নাস্তা করতে যাই।
নাস্তা করার সময় নেই রে মা। আমি অফিসে গিয়ে কিছু খেয়ে নেবো।
বাবাকে রুমে ঢুকে যেতে দেখে নূরি বুঝলো সিরিয়াস কোন বিষয়েই বাবা-মামণির মনোমালিন্য হয়েছে। গাছে পানি দেয়া শেষ করে বোনের খোঁজে রওনা হলো সে। দুজন মিলে বাবা-মামণির মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কোন বুদ্ধি বের করতে হবে। বড় বোনের সন্ধানে বাড়ির ভেতর ঢুকতে গিয়ে প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেলো নূরি। রুহিও ছোট বোনের খোঁজে বাগানের দিকে আসছিল। ফলে দু’বোনের এই সংঘর্ষ। একে অন্যেকে ধরে ব্যথা পায়নি নিশ্চিত হয়ে রুহি বলল, আমি তোর কাছেই যাচ্ছিলাম। বাবা-মামণির মধ্যে মনেহয় কিছু হয়েছে।
নূরি হেসে বলল, আমিও তো এই খবর নিয়েই তোমার কাছে যাচ্ছিলাম। মামণির মেজাজ কি খুব গরম?
গরম মানে? আমাকে নবাবজাদী বলে ডেকেছে। এবার বুঝে নে যে কতটা গরম। কি করা যায় বল তো?
বাবা-মামণির তো একটাই সমস্যা। মনোমালিন্য হলে কেউ কারো সাথে কথা বলতে চায় না। দুজনই অপেক্ষা করে অন্যজন আগে কথা বলবে। কোন ভাবে দুজনকে শুধু কথা বলিয়ে দিতে হবে একবার।
হুমম! তুই বুদ্ধি বের করতে থাক আমি ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে আসি। নয়তো আবার মামণির বকা শুনতে হবে।
নূরি হেসে বলল, আচ্ছা তুমি যাও। আমি রান্নাঘরের দরজায় চোখ রেখে চুপিচুপি দেখে আসি মামণিকে।
@
মেয়ের সাথে কথা বলে মনে যে আনন্দ ভাব এসেছিলো রুমে ঢুকেই সেটা উবে গেলো নোমান সাহেবের। সবসময় অফিসে যাবার ড্রেস বাইরে বের করে রাখেন তার স্ত্রী কিন্তু আজ করেনি। সংসারে ঝগড়া-ঝাটি মনোমালিন্য হতেই পারে, তাই বলে কি নিজের দায়িত্ব কর্তব্য পালনে অবহেলা করবে মানুষ? মেজাজ আবারো গরম হতে শুরু করলো নোমান সাহেবের। নিজেই ড্রেস বের করে তৈরি হয়ে নিলেন। বার বার চোখ চলে যাচ্ছিলো দরজার দিকে। মনে মনে চাচ্ছিলেন স্ত্রী আসুক, কথা বলুক তার সাথে। তৈরি হয়ে যাবার পরও কিছুক্ষণ রুমে বসে রইলেন। তারপর চোখ মুখ শক্ত করে বেড়িয়ে এলেন রুম থেকে। নাস্তা না করেই বেড়িয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু পাখীর মতো উড়তে উড়তে হাজির হলো বড় মেয়ে রুহি। বাবাকে হাত ধরে টানতে টানতে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে গিয়ে বলল, বাবা দেখো আজ আমাদের দুজনের ফেবরেট নাস্তা বানিয়েছে মামণি। দাঁড়িয়ে আছো কেন? তাড়াতাড়ি বোস ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে তো সব।
মেয়েদের কোন কিছুতে না বলতে পারেন না কখনোই নোমান সাহেব। তাই বসে পড়লেন বাধ্য বাবার মত।
নিজের প্লেটে নেবার সাথে সাথে বাবার প্লেটেও নাস্তা বেড়ে দিলো রুহি। বাবাকে খাওয়ার তাগাদা দিয়ে নিজে খাওয়ায় মন দিলো।
নাস্তার টেবিলে এসে বাবাকে দেখে হাসি ফুটে উঠলো নূরির চেহারাতে। কিন্তু লুচির সাথে কলিজা ভুনা দেখে সাথে সাথে নাক কুঁচকে গেলো। মামণির মেজাজ খারাপ আজ খাবার নিয়ে ঝামেলা করলে ঠিক বকা খেতে হবে। মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো নূরি। মাঝে মাঝে মনের ছোট্ট একটা পছন্দ-অপছন্দ জানানোটাও কত কঠিন হয়ে যায়। বোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো গপাগপ খাচ্ছে। মামণিকে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি প্লেটে লুচি আর এক চামচ কলিজা ভুনা উঠিয়ে নিলো।
মিসেস রাহমা এসে বললেন, তুই না কলিজা খেতে পারিস না, তাহলে নিয়েছিস কেন? এই নে আমি তোর জন্য সবজি নিয়ে এসেছি। সাথে সাথে হাসি ফুটে উঠলো নূরির চেহারাতে। হাত বাড়িয়ে মামণিকে জড়িয়ে ধরলো। হাসলেন মিসেস রাহমাও। মেয়ের মাথার হাত বুলিয়ে বললেন, হয়েছে আর আহ্লাদ করতে হবে না। প্লেটের সব খাবার শেষ করে উঠবি। নয়তো বুঝবি মজা।
মামণির হাত ধরে টেনে পাশে বসিয়ে নূরি বলল, মা সত্যিই অনেক স্পেশ্যাল তাই না বাবা? দেখো শত ঝামেলা, মন খারাপের মাঝেও মায়েরা প্রতিটা সন্তানের পছন্দ-অপছন্দ সবকিছু খেয়াল রাখেন, মনে রাখেন। অবশ্য বাবারা সারাদিন বাইরে পরিশ্রম করেন বলেই তো মামণিরা সন্তানদের পছন্দের সবকিছুর ব্যবস্থা করতে পারেন। বাবারাও অনেক সুইট তাই না মামণি? এজন্যই তো কবি বলেছেন, বাবা-মার কারণেই ধরণী পরে এসেছি, বাবা-মাকে মোরা তাই এতো ভালোবাসি। সকল বালা মুসিবত দূর হয়ে যাক, বাবা-মা মোদের সর্বক্ষণ একসাথে থাক।
কোন কবি এই কথা বলেছে? জানতে চাইলেন মিসেস রাহমা।
নূরি মিষ্টি হেসে বলল, সেই কবি নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতেই পছন্দ করেন।
চলবে…
পর্ব-৩