মোরা জোনাকি হতে চাই……১
আফরোজা হাসান
ঘুম থেকে উঠে হেলতে দুলতে রান্নাঘরে রওনা করলো রুহি। রান্নাঘরের কাছে যেতেই লুচি ভাজার মিষ্টি ঘ্রাণ এসে নাককে ছুঁয়ে দিলো। মামণিকে বলেছিলো আজ তার জন্য আলুর লুচি ও কলিজা ভুনা করতে। নিশ্চিয়ই তাই করেছে মামণি। হাসিতে বিকশিত হতে হতে রান্নাঘরে ঢুকে মামণির চেহারার দিকে তাকাতেই সাবধান হয়ে গেলো রুহি। মামণির চেহারাতে ঝড়ের পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে। এটাকে দশ নাম্বার বিপদ সংকেত বললেও কম বলা হয়ে যাবে। ঝড়ের কবলে পড়ার আগেই সরে পড়তে চাইলো কিন্তু ঝড় তাকে ধরেই ফেললো।
মোটামুটি হুংকার দিয়ে মিসেস রাহমা বললেন, সকাল হলো তাহলে নবাবজাদীর। কয়টা বাজে দেখেছিস? আর তুই ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ না ধুয়ে রান্নাঘরে কেন ঢুকেছিস? সামনে থেকে যা আমার। এক্ষুনি যা বলছি।
রাজকন্যার বদলে নবাবজাদী! তারমানে মামণির চেহারাতে যে ঝড়ের পূর্বাভাস পরিলক্ষিত হচ্ছে সেটার কারণ বাবা। হাসি চেপে মিনমিনে কণ্ঠে রুহি বলল, আজ তো কলেজ নেই মামণি।
তাই বলে দশটা পর্যন্ত ঘুমাতে হবে নাকি? আমাদের যেদিন ছুটি থাকতো সংসারের কাজে মাকে সাহায্য করতাম। একদিনের জন্য মাকে একটু আরাম করতে দিতাম। আর তোরা ছুটি পেলে নিজের আরামের চিন্তা করিস।
মুখ শুকনো করে রুহি বলল, ভুল হয়ে গিয়েছে মামণি। এরপর থেকে আর এমন হবে না। এরপর থেকে ছুটির দিনে তোমাকে সাংসারিক কাজে সাহায্য করবো। তাছাড়া এখন থেকেই সাংসারিক কাজ শিখাও তো উচিত। নয়তো শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলবে মায়ের বাড়ি থেকে কি শিখে এসেছো শুনি? মায়ের বাড়ি তুলে কথা বললে আমার হবে মেজাজ গরম। সংসারে শুরু হবে অশান্তি। তাই ভালো এখন থেকেই কাজকর্ম শেখা শুরু করা। বাঁশ থেকে বাঁশী তৈরি হবে? হুহ! আমি বাঁশঝাড়ই জন্মাতে দেবো না।
তোকে না বলেছি আমার সাথে ফাজলামো করবি না। যা তুই আমার সামনে থেকে। যা বলছি।
যাওয়ার আগে তোমাকে একটা টাইট হাগ দিয়ে যাই মামণি?
কাঠের চামচ উঁচিয়ে মিসেস রাহমা বললেন, বাসী শরীরে আমার কাছে এলে এইটার বাড়ি খাবি।
মাই ডিয়ার সুইট মাদার গাছে থাকলে ফুল কখনো বাসী হয় না।
মানে কি এই কথার?
মানে হচ্ছে আমি যেই দুটি গাছের সমন্বয়ে আমি প্রস্ফুটিত হয়েছিলাম। এখনো সেই বৃন্তেই শোভা বর্ধন করছি। হাসতে হাসতে বললো রুহি।
মিসেস রাহমা বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, এজন্যই আমি তোর সাথে কথা বলতে চাই না। সারাক্ষণ শুধু ফালতু কথা। দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা বলছি সামনে থেকে।
রান্নাঘরের দরজার সামনে গিয়েও আবার ফিরে এসে মামণিকে জড়িয়ে ধরে আদর করে হাসতে হাসতে ছুটে বেড়িয়ে গেলো রুহি।
হেসে ফেললেন তখন মিসেস রাহমাও। তার রাগ হলে সবসময় চেষ্টা করেন তার দুষ্টু মেয়েদের সাথে কথা না বলতে। এটা সেটা বলে ঠিকই তাকে হাসিয়ে ফেলে নয়তো।
@
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই স্ত্রীর সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে। মন মেজাজ তাই খুবই খারাপ নোমান সাহেবের। বারান্দায় বসে গম্ভীর মুখে পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছিলেন। গুনগুণ শব্দ কানে আসতে পত্রিকা ভাঁজ করে রেখে উঠে দাঁড়ালেন। ছোট মেয়ে নূরি বাগানে গাছে পানি দিচ্ছিলো আর গুনগুণ করছিলো। মেয়েকে দেখেই হাসি ফুটে উঠলো নোমান সাহেবের চেহারাতে। সাথে সাথে মনও ভালো হতে শুরু করলো। আদর ভরা কণ্ঠে বললেন, আমার মা কি করে?
নূরি উপর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, গাছদের নাস্তা দিচ্ছি বাবা। খালি পানি খেতে চাচ্ছে নাতো তাই গুনগুণ করে পটানোর চেষ্টা করছি।
নোমান সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, তোর গুনগুণকে শব্দ দিয়ে দেতো মা। অনেকদিন তোর গান শুনিনা।
মামণির সাথে ফাইট হলে তুমি একদম বোকা ছেলে হয়ে যাও বাবা। বাগানে দাঁড়িয়ে আমি বুঝি গান করবো?
তোর মামণির সাথে আমার ফাইট হয়েছে কে বললো?
জগতের সবকিছু মুখে বলার দরকার হয় না বাবা। নিশ্চুপ পরিবেশও অনেককিছু জানান দিয়ে যায়। এই যেমন ধরো, প্রতিদিন ভোর বেলা দুজন কপোত-কপোতি চায়ের কাপ হাতে আমাদের বাগানে বসে গুটুর গুটুর করে। আজ তাদেরকে দেখা যায়নি। তাছাড়া রান্নাঘর থেকে ধুরুম ধারুম শব্দ ভেসে আসছে। এসবই মামণির মেজাজ গরমের লক্ষণ।
তুই এত কিছু খেয়াল করিস তাতো জানা ছিলো না। হাসি মুখে বললেন নোমান সাহেব।
মেয়েদেরকে সংসারের সবদিকে খেয়াল রাখতে হয় বাবা। তুমি এসব বুঝবে না।
বুঝবো না কেন?
জগতের সবকিছু তো সবাই বোঝে না বাবা। কিছু কিছু উপলব্ধি একান্ত মেয়েদের আর কিছু উপলব্ধি একান্ত ছেলেদের। ছেলে ও মেয়েরা যখন একে অপরের উপর নিজ নিজ উপলব্ধি চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে তখনই বাঁধে সমস্যা।
তুই তো মা অনেক কঠিন কঠিন কথা শিখে ফেলেছিস। তোর মামণিকে একটু বোঝাতে পারিস না এসব কথা। তাহলেই তো আর অশান্তি হয় না।
তুমি বুঝলেও তো অশান্তি কমে যেত বাবা। তাহলে তুমি কেন বোঝ না বলো তো?
তুই কখনোই তোর মামণির দোষ দেখিস না এটাই হচ্ছে সমস্যা। এমনিতে মুখে মুখে শুধু বলিশ যে আমাকে বেশি ভালোবাসিস। সত্যি করে বল তো তোকে যদি অপশন দেয়া হয় আমাকে কিংবা তোর মামণি যে কোন একজন বেছে নিতে তুই কাকে নিবি?
চলবে
পর্বঃ২ মোরা জোনাকি হতে চাই…..২