ধর্মীয় বিতর্কে আটকে গেল ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ স্থাপন
স্বাস্থ্যকথা
এতিম-বিপন্ন শিশুদের জন্য দেশে প্রথমবারের মতো যাত্রা শুরু মায়ের বুকের দুধ সংরক্ষণের ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলেও ধর্মীয় প্রশ্নে বিরোধিতার মুখে আটকে গেছে। এতে আইনগত ও ধর্মীয় সমস্যা আছে মর্মে ‘মিল্ক ব্যাংক’ স্থাপনের বিরোধিতা করে এবং এ ব্যাপারে যথাযথ শর্তারোপ চেয়ে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
রোববার (২৯ ডিসেম্বর) জনস্বার্থে নোটিশটি পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান।
নোটিশে ধর্ম মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইসিএমএইচ), নবজাতক পরিচর্যা কেন্দ্র (স্ক্যানো), নবজাতক আইসিইউ (এনআইসিইউ) এবং ঢাকা জেলা প্রশাসককে বিবাদী করা হয়েছে।
আইনজীবীর পাঠানো নোটিশে বলা হয়েছে, ‘‘ইসলাম ধর্মমতে, কোনো শিশু কোনো মহিলার দুধ পান করলে ওই মহিলা ওই শিশুর দুধমাতা হয়ে যায় এবং উক্ত মহিলার সন্তানরা উক্ত শিশুর ভাইবোন হিসেবে গণ্য হয়। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে উক্ত ‘মিল্ক ব্যাংক’ স্থাপনের ফলে একই মায়ের দুধ পানের কারণে ভবিষ্যতে ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যা চরমভাবে সামাজিক অরাজকতা সৃষ্টি করবে। পাশাপাশি ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী, ভাই ও বোনের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ এবং তা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আইন ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরীয়ত) প্রয়োগ আইন, ১৯৩৭’ এর সরাসরি লঙ্ঘন।”
এ ব্যাপারে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. মজিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, এই কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। এটা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার পর সবার সম্মতি পেলে সম্ভব হলে এটা চালাব।
প্রসঙ্গত, হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের উদ্যোগটি ঢাকা জেলার মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইসিএমএইচ) নবজাতক পরিচর্যা কেন্দ্র (স্ক্যানো) এবং নবজাতক আইসিইউ (এনআইসিইউ)-এর নিজস্ব উদ্যোগ। বেসরকারি আর্থিক সহায়তায় ব্যাংকটি স্থাপন করা হয়েছে। এটি গত ১ ডিসেম্বর চালু হলেও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে।
আইসিএমএইচ ক্যাঙারু মাদার কেয়ারে মা ছাড়া খালা, নানি বা অন্যদের সঙ্গে যে নবজাতকদের রাখা হচ্ছে, তারাও এই দুধ খেতে পারবে। স্ক্যানো ও এনআইসিইউতে থাকা অপরিণত বয়সে জন্ম নেওয়া ও অসুস্থ নবজাতকদের সংরক্ষণ করে রাখা দুধ খাওয়ানো হবে। ৩৭ সপ্তাহের আগে জন্ম নেওয়া ২ হাজার গ্রামের কম ওজনের নবজাতকদের মা বা অন্য অভিভাবকদের ত্বকের সংস্পর্শে রেখে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করাকে ক্যাঙারু মাদার কেয়ার বলে।
এ ছাড়া দত্তক নেওয়া সন্তানের অভিভাবকেরা এখান থেকে দুধ নিয়ে খাওয়াতে পারবেন। বিভিন্ন সময় স্বজনেরা নবজাতককে ফেলে দেন, এই স্বজন-পরিত্যক্ত নবজাতকদের বাঁচাতেও মিল্ক ব্যাংক কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। মায়েদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ ও বিতরণে কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা নেওয়া হবে না।
আইসিএমএইচ স্বায়ত্তশাসিত একটি প্রতিষ্ঠান। এর যাত্রা শুরু ১৯৯৮ সালে। সরকার, বিভিন্ন দেশি–বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা বা ব্যক্তির অনুদান এবং ইনস্টিটিউটের নিজস্ব অর্থ মিলিয়ে এটি পরিচালিত হচ্ছে। ইনস্টিটিউটটির দেওয়া তথ্য বলছে, গত বছর স্ক্যানো এবং এনআইসিইউতে ১ হাজার ৮৬৫ জন নবজাতক ভর্তি হয়। এর মধ্যে ৪৮৮ জনই ছিল গুরুতর অসুস্থ।
গত বছরের জানুয়ারি মাস থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত মোট ২৫ জন মাতৃহীন নবজাতক ভর্তি ছিল। ৩৭ জনই ছিল দত্তক নেওয়া। এদের অধিকাংশই মারা যায়। বুকের দুধ খাওয়ানো সম্ভব হলে এদের অনেককেই বাঁচানো সম্ভব হতো।
সম্প্রতি আইসিএমএইচে গিয়ে দেখা যায়, ইনস্টিটিউটের দোতলায় হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের জন্য পাস্তুরাইজিং মেশিন, অত্যাধুনিক ফ্রিজসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে। ব্যাংকের জনবলকে প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ অন্যান্য কার্যক্রম চলছে। হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকে সংরক্ষিত মায়ের বুকের দুধ তিন মাস থেকে সর্বোচ্চ ১৮ মাস পর্যন্ত সম্পূর্ণ গুণগত মান বজায় রেখে ভালো থাকবে। এই ব্যাংকের মাধ্যমে দুধের বিভিন্ন অংশ যেমন শর্করা, প্রোটিন ও চর্বি উপাদান আলাদা আলাদা করে প্রয়োজনমতো নবজাতককে খাওয়ানো সম্ভব হবে। আর ব্যাংক থেকে নেওয়া দুধ বাড়িতে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত ভালো থাকবে।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা বলছেন, মিল্ক ব্যাংক স্থাপনের ফলে বাজারজাত করা মায়ের দুধের বিকল্প শিশুখাদ্যের ব্যবহার কমবে। নবজাতকদের বুকের দুধ খাওয়ানোর ফলে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি ও অপুষ্টির হার কমানো সম্ভব হবে।
আইসিএমএইচের সহযোগী অধ্যাপক মজিবুর রহমান হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ব্যাংক চালু করার আগে তিনি নিজে স্পেন ও ভারতের দুটি হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক পরিদর্শন করে এসেছেন। তিনি বললেন, যে মায়েদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করা হবে, সেই মায়েদের মারাত্মক রোগ (হেপাটাইটিস বি এবং এইচআইভি) আছে কি না তা পরীক্ষা করে করে দুধ সংগ্রহ করা হবে, যাতে নবজাতক রোগের ঝুঁকিতে না পড়ে।
ইনস্টিটিউটের এনআইসিইউ এবং স্ক্যানোর ইনচার্জ এবং মিল্ক ব্যাংকের সমন্বয়ক মজিবুর রহমান জানান, সবচেয়ে বেশি (২১৬ টি) হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক রয়েছে ব্রাজিলে, যার মাধ্যমে ২৮ শতাংশ নবজাতকের মৃত্যু রোধ এবং ৭৩ শতাংশ শিশুর অপুষ্টি রোধ করা সম্ভব হয়েছে। এমনকি ভারতেও ব্যাংক স্থাপনের পর নবজাতকের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হয়েছে।
আইসিএমএইচের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক এম এ মান্নান বললেন, বাংলাদেশে যেহেতু প্রথমবারের মতো এ ধরনের একটি ব্যাংকের যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে, তাই বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নিয়ে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। মায়ের বুকের দুধ সংগ্রহ এবং অন্য নবজাতকদের খাওয়ানোর ক্ষেত্রে যাতে ইসলামি শরিয়াহর কোনো লঙ্ঘন না হয়, সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। মুসলিম দেশের মধ্যে কুয়েতে প্রথম হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক স্থাপন করা হয়। এ ছাড়া ইরান, ইরাক, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানসহ অনেক মুসলিম দেশ হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে। ওই দেশগুলো কীভাবে ব্যাংক পরিচালনা করছে, তার বিস্তারিত তথ্য জানার চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের মতামত নেওয়া হচ্ছে।
ব্যক্তি উদ্যোগ এবং বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর সহায়তায় মিল্ক ব্যাংকটি স্থাপনে এখন পর্যন্ত এক কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। তবে অধ্যাপক মান্নান বললেন, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য এ ধরনের ব্যাংক পরিচালনা ব্যয়বহুল হলেও সরকারের জন্য এ খরচ তেমন বেশি নয়। আর নবজাতকদের বাঁচাতে এ ব্যাংক যে ভূমিকা রাখবে, সে তুলনায় এ খরচ কিছুই না।
সুত্রঃ মেডিভয়েস রিপোর্ট