banner

মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: November 15, 2024

 

সমুদ্রের টানে নদীর ছুটে চলা – ১২

সমুদ্রের টানে নদীর ছুটে চলা – ১২


আফরোজা হাসান


গাড়ি থেকেই শাবাব ও আরিফীকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো মাহাম। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে শাবাব ননস্টপ বকবক করছে আর আরিফী মুগ্ধ মনে শুনছে। হাসি পেলো মাহামের শাবাবের দিকে তাকিয়ে। শুধু মুখ না সারা শরীর কথা বলে এই মেয়ের। কিন্তু বোনের এই সদা চঞ্চল ভাবভঙ্গী খুব উপভোগ করে মাহাম। ঐ যে ছুট লাগিয়েছে শাবাব এদিকে। মনেহয় দেখতে পেয়েছে তাদেরকে।

গাড়ি নামতে না নামতেই খপ করে মাহামের হাত চেপে ধরে শাবাব বলল, এতক্ষণে আসার সময় হল আপনাদের? আধঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। তোর পছন্দের বোরিং স্ট্রোবরী ফ্লেবারের আইসক্রিম নিয়ে এসেছিলাম। গলে যাচ্ছিলো তাই আরিফী খেয়ে ফেলেছে। আমি তোর জন্য কিনেছি আর সে খেয়ে নিলো পেটুকের মতো। এখন গলা চাপা দিয়ে বের করতে ইচ্ছে করছে আইসক্রিম পেট থেকে।
হেসে ফেললো মাহাম। বলল, উফ…কি যে সব বলো না তুমি! আসলে আয়ানকে একটু বাইরে যেতে হয়েছিল তাই দেরি হয়ে গিয়েছে আমাদের আসতে।

শাবাব বলল, কিন্তু এখানে এসেছি কেন আমরা?

তা তো জানি না। আয়ান শুধু বলেছে সারপ্রাইজ আছে আমার জন্য।

ইশশ…ভাইয়া কত্ত রোমান্টিক। আর আরিফী?

মাহাম হেসে বলল, আরে আরিফী ভাইয়া নিজেই তো আপাদমস্তক সারপ্রাইজ তোমার জন্য। স্পেশাল আর কোন সারপ্রাইজ দেবার অবকাশ কোথায়?

বোনের কাঁধে আদরের ঘুষি লাগিয়ে শাবাব বলল, তোর সবচেয়ে বড় গুণ কি জানিস? ভুজুংভাজুং বলে মানুষকে পটিয়ে ফেলা।

আমি আমার গুড এন্ড ব্যাড উভয় কোয়ালিটি সম্পর্কেই জানি। এবং মনেকরি প্রত্যেকেরই তার গুড এন্ড ব্যাড উভয় কোয়ালিটি সম্পর্কে ধারণা থাকা উচিত। আচ্ছা তুমি জানো তোমার গুড কোয়ালিটি কি?

শাবাব চিন্তিত কণ্ঠে বলল, নাতো। তুই জানিস?

বোনকে কথার ঝাঁপি খোলার সুযোগ না দিয়ে হেসে হাঁটতে শুরু করলো মাহাম। পাশে হাঁটতে হাঁটতে শাবাবের কথা চলতে থাকলো। আজকে আরিফী মিয়াকে লাট্টুর মতো ঘুরানোর প্ল্যান ছিল আমার বুঝেছিস। ইচ্ছে ছিল শপিং করতে করতে ফতুর করে দেবো। কিন্তু ভাইয়া ফোন করে এখানে আসতে বলে আমার সব প্ল্যান বানচাল করে দিয়েছে।
মাহাম হেসে বলল, কেন তুমি এত যন্ত্রণা করো বেচারা ভাইয়াকে বুঝি না!

আমিও বুঝি না তুই এত পতিপ্রাণা হয়ে থাকিস কেন? বিয়ের পর থেকে কত বদলে গিয়েছিস তুই সেটা কি জানিস ?

মাহাম হেসে বলল, হুম…জানি। শোনো জীবনকে স্বপ্নিল বানানোর জন্য মেয়েদেরকে তাদের অনেক পছন্দ, শখ, ভালোলাগা, মন্দলাগা স্বামীর ইচ্ছানুযায়ী বদলাতে হয়। আর এতে কল্যাণ উভয়েরই হয়।

তোর সব ওয়াজ শুধু মেয়েদের জন্য কেন বুঝি না! বিশেষ করে আমার জন্য।

কারণ আমি নিজে একটা মেয়ে। মেয়েদের মন মানসিকতা আমি বেশি বুঝি এবং মেয়েদের ক্ষমতাও আমি উপলব্ধি করতে পারি নিজেকে বিচার করে। আর তোমাকে বেশি বলি কারণ বোন আমি তোমার। জীবনের প্রতি মুহুর্তে প্রতি কদমে তোমাকে বোঝানো, শুধরে দেয়া আমার জন্য ফরজ।

শাবাব হেসে বলল, এজন্যই তো তোকে আমি এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। আমার কাছে পুরো পৃথিবী একদিকে আর তুই একা একদিকে।

সাথে সাথে মুখটা ভার করে ফেললো মাহাম। বলল, শাবাব প্রিয় বোন আমার আমি তোমার কথার বদলে একই কথা তোমাকে বলতে পারলাম না বলে খুবই দুঃখিত। কি করবো বলো আমার দুনিয়া যে আমি অন্য একজনকে বানিয়ে ফেলেছি।

দুই বোনই হেসে ফেললো একসাথে। অতঃপর একে অন্যের সাথে ভাবের আদান প্রদান করতে করতে সবার পেছন পেছন হাটতে লাগলো।

ভেতরে প্রবেশ করে যা দেখলো তাতে আয়ান আর আরিফী ছাড়া পরিবারের সবাই বেশ অবাক হলো। চোখ প্রশ্ন নিয়ে আয়ানের দিকে তাকালো মাহাম! সারপ্রাইজের কথা বলে সবাইকে চাইল্ড হোমে নিয়ে এসেছে কেন আয়ান? তাও আবার মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশু সবাই। প্রথমে তো সবাইকে ঘুরিয়ে দেখলো সবকিছু আয়ান আর আরিফী মিলে। এরপর সবাইকে নিয়ে বাগানে এসে বসলো।

আয়ান সবাইকে জানালো তাদের এক শিক্ষক ও তাঁর স্ত্রী মিলে মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য এই স্কুলটি শুরু করেছিলো আরো ছয় বছর আগে। তাদের নিজেদের কোন সন্তান ছিল না তাই অসহায় এই শিশুগুলোর জন্য একটু আশ্রয় হতে চেয়েছিলেন। এটাকেই জীবনের মিশন হিসেবে নিয়েছিলেন দুজন। প্রথম থেকেই আয়ান ও আরিফী সাথে ছিল উনাদের। আয়ানের সাথে তাদের পরিচয় হয়েছিলো নিউজিল্যান্ডে আরো একযুগ আগে। ইউরোপিয়ান এই দম্পতি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন পাঁচ বছর আগে। গত বছর এক এক্সিডেন্টে স্বামী-স্ত্রী দুজনই মারা গিয়েছে। এবং মৃত্যুর আগে স্কুলটার দায়িত্ব আয়ানকে দিয়ে গিয়েছেন উনারা দুজন।

গাড়িতে উঠার পর থেকেই সীটে হেলান দিয়ে বাইরের চুপ দিকে তাকিয়ে আছে মাহাম। অনেকক্ষণ পর আয়ান বলল, কি ভাবছো? সারপ্রাইজটা তোমাকে সত্যি সত্যিই খুব সারপ্রাইজড করে দিয়েছে তাই না?

আয়ানের দিকে ঘুরে তাকালো মাহাম। বলল, বাচ্চাগুলোর কথা ভাবছি। তোমাকে নিয়েও ভাবছি।

আমাকে নিয়ে? হাসলো আয়ান। আমাকে নিয়ে কি ভাবছো?

ভাবছি অনেক দায়িত্ব তোমার উপর। আমি পারবো তো তোমার যোগ্য সাথী হতে? তোমার সাথে কদমে কদম মিলিয়ে চলতে?

আয়ান হেসে বলল, আমি আরো কি ভাবছিলাম জানো? তুমি হয়তো ঘাবড়ে যাবে এসব দেখে। অথচ দেখো তুমি আমার সাথে কদমে কদম মিলিয়ে চলতে চাইছো! এটাই তো প্রমাণ করে আমাদের সফরটা খারাপ হবে না, ইনশাআল্লাহ। তাছাড়া…

তাছাড়া কি?

গাড়ি থেকে নামো।

অবাক দৃষ্টিতে মাহাম তাকালো আয়ানের দিকে। আয়ান সেই দৃষ্টির দিকে দৃষ্টিপাত না করে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। ঘুরে এসে মাহামকেও ধরে বের করলো। পেছনে ঈশারা করে আয়ান বলল, ঐ দেখো বাস আসছে।

হ্যা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তাতে কি?

আয়ান হেসে বলল, চলো নাইট বাসে করে ঘুরবো দুজন। দৌড়ে কখনো বাস ধরেছো? আমিও পাগল তোমার কাছে এই প্রশ্ন করছি? জাদুঘরে রাখার মত বোরিং লাইফ লিভ করো তুমি। চলো তোমাকে লাইফ লিভ করতে শেখাবো। বাসে উঠে যত ইচ্ছে তাকিয়ে থেকো আমার দিকে। বাস এসে যাচ্ছে চলো তাড়াতাড়ি। কামঅন।

হেসে ফেললো মাহাম। আয়ানের বাড়িয়ে ধরা হাত ধরে ছুটতে শুরু করলো সম্মুখ পানে……।

চলবে

পর্ব-১১