দুলে দুলে খাবারের পেছনে মাহামের যুক্তি হচ্ছে খাবার তার গলা দিয়ে নামতে চায় না। দুলে দুলে খাবারকে নামতে সাহায্য করে সে। নাহ! ভাইয়ার বাম হাতও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। দুইজনকে ভরা মজলিশে ধরা কিভাবে খাওয়ানো যায় ভাবতে লাগলো শাবাব। ডুবে ডুবে জল খাওয়া কথাটার প্রচলন মনেহয় এই ধরণের সুবোধ বালক-বালিকাদের কারণেই হয়েছে, ভাবলো শাবাব। আহা চেহারা দেখে কে বলবে, সবার চোখের অন্তরালে কি খেলাটাই না খেলছে দুজন। থাক খেলুক বিরক্ত করে কাজ নেই ভেবে খাওয়াতে মন দিলো শাবাব।
রাতে ঘুমাতে যাবার আগে আর কথা বলার সুযোগ হলো না মাহামের সাথে শাবাবের। কম্বল মুড়ি দিয়ে গুটিসুটি মেরে বোনের কোল ঘেঁষে এলো সে। অন্য সময় হলে চিৎকার করে উঠতো মাহাম। কিন্তু আজ সেও কাছে টেনে নিলো বোনকে। দুজনের মনের মধ্যেই একই রকম রঙ ছড়াচ্ছে অনুভূতিরা। আর হয়তো বেশিদিন তারা দুজন একসাথে নেই।
কখনোই তো থাকেনি তারা দুজন একে অন্যকে ছাড়া। মাহামকে ছাড়া তো ছোট্ট একটা শিশুর মত অসহায় ফিল করে শাবাব। আর শাবাবকে ছাড়া যে মাহামের ভুবন নীরব নিশ্চুপ, কোন গুনগুন নেই যেখানে। একসময় ফুঁপিয়ে উঠলো শাবাব। অশ্রু নেমে এলো মাহামের চোখেও। একেই কি রক্তের বন্ধন বলে? নাকি ভালোবাসার বন্ধন এটা? মুখে কিছু না বলেও অনুভূতির আদান প্রদান হয়ে যায় যেখানে! মনের মিলই মনেহয় এর যথার্থ সংজ্ঞা!
আমাদের বিয়ে দিয়ে কাজটি মোটেই ঠিক করেননি বাবা! একরকম ফুঁসে উঠলো শাবাব। হেসে বোনের চুলে হাত বুলিয়ে দিলো মাহাম। উঠে বসে শাবাব বলল, আমি বিয়ের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। জীবনকে ঘিরে আমার অন্যরকম কিছু চাওয়া পাওয়া ছিল। জানিস মাঝে মাঝে সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগে আমার কাছে। বাবা কাজটি ঠিক করেননি।
এখন এভাবে চিন্তা না করাই ভালো শাবাব। বাবা যা করেছেন আমাদের ভালোর চিন্তা করেই করেছেন নিশ্চয়ই।
কিন্তু বাবার এই ভালো কাজের ফলে আমাদের জীবন বদলে গিয়েছে। যারা দুদিন আগে আমাদের আনন্দ-দুষ্টুমিকে উপভোগ করতো, এখন তারা মনে করিয়ে দেয় তুমি এটা করতে পারো না। তোমার উপর বিয়ের ট্যাগ লেগে গিয়েছে। কারো স্ত্রী, কারো বাড়ির বৌ এই নেমপ্লেট ঝুলে গেছে তোমার গলায়। আমার কি মনেহয় জানিস?
কি? জানতে চাইলো মাহাম।
বিয়ে হলে মানুষের জগতটা ছোট হয়ে যায়। জীবনকে উপভোগ করার উপকরণ কমে যায়।
হেসে ফেললো মাহাম। বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল, ওরে বাবা এত দেখছি একদম কঠিন উপলব্ধি।
তুই কি বুঝবি ফাজিল! ভাইয়ার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলি, বিয়ে হওয়াতে তো তুই আরো খুশি হয়েছিস।
ইশশ…আর তুমি বুঝি মাঝ সাগরে পড়েছো? সারাক্ষণ তো দেখি বাকবাকুম করতেই থাকো আরিফী ভাইয়ার সাথে।
সেটা তো করবোই। আমাকে বিয়ে করার সাধ হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে ছাড়বো। ওর হাড় দিয়ে নিহাড়ি পাকাবো, গোশত দিয়ে বারবিকিউ করবো আর চামড়া দিয়ে ঝুনঝুনি বানাবো বাবুদের জন্য।
কার বাবু?
কার আবার আমাদের! বলেই থেমে গেলো শাবাব।
হায় আল্লাহ! ইউ আর ব্লাশিং। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো মাহাম।
বোনকে আদরের থাপ্পড় দিয়ে শাবাব বলল, ভেবে দেখ কত মজা করতাম আমরা। বাবার অফিসে গিয়ে আড্ডা দেয়া, মাঝরাতে বালিশ হাতে মামণি-বাবার রুমে হাজির হয়ে তোমাদের সাথে ঘুমবো এই আবদার করা, ভাইয়া-ভাবীদের রোমান্টিক মুহুর্তে গিয়ে কাবাবমে হাড্ডি হওয়া, ড্রাইভার চাচার কাছে বসে উনার জীবনের গল্প শোনা, সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত দুজন মিলে জোছনা দেখা, বৃষ্টিতে ভেজা। আরো কত কি করতাম আমরা।
আরে এসব তো এখনো করি আমরা।
সেতো এখনো আমরা বাবা-মামণির কাছে থাকি বলে। যখন আমাদেরকে যার যার শ্বশুরবাড়িতে চলে যেতে হবে তখন কি আর পারবো এসব করতে? একদিন দুইদিন তিনদিন হাসিমুখে মেনে নেবে। তারপর ঠিকই বিরক্ত হবে।
হুমম, আচ্ছা বাদ দাও এসব কথা। ভবিষ্যতের চিন্তা করে শুধু শুধু চিন্তার পাহাড় মাথায় তোলার দরকার নেই। চল ঘুমাই এখন।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর শাবাব বলল, আজ ভাইয়ার খাওয়া দেখে কিন্তু বেশ অবাক হয়েছি আমি।
কেন?
এমন তো সাধারণত কখনোই হয় না। মাহাম কথা বলছিস না কেন?
উফফ…ঘুমাও তো এখন।
সারাক্ষণ হাত ধরে থাকবে এই শর্তে ভাইয়া সব খাবার চেখে দেখতে রাজী হয়েছিলো তাই না?
কম্বল টেনে মুখ ঢেকে ফেললো তখন মাহাম। বোনকে জড়িয়ে ধরে খিলখিল করে হেসে ফেললো শাবাব।