‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে নারী সমাজ
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা
গ্রাম-শহর সমানভাবে উন্নত হলেই একটা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। কেবলমাত্র শহরের উন্নয়ন দিয়ে কখনই একটা দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধশালী করা সম্ভব নয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে সেখানকার গ্রামীণ অর্থনীতি বেশ শক্তিশালী। আর গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি ভূমিকা পালন করে থাকেন। বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের ‘গ্রাম-শহর সমান উন্নতি’ নীতির কারণে এবং অনেকেই শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন, অবদান রাখছেন দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে। যেমন তাদেরই একজন বান্দরবানের বিলাইছড়ির আয়শা খাতুন।
আয়শা খাতুন কয়েক বছর আগে ঢাকা শহরে এসেছিলেন এক বান্ধবী শাহেদার হাত ধরে। ইচ্ছে ছিল গ্রামের গরীব বাবা-মাকে সাহায্য করা। শুরুতে এক গার্মেন্টস কারখানায় চাকরি নেন। বেতন ছিল সাত হাজার। শুরুতে কারখানায় হেলপারের কাজ করলেও পরে আস্তে আস্তে নিজেই শিখে যান সেলাইয়ের কাজ। এভাবে প্রায় দু’বছর কাজ করার পর বেতন দাঁড়ায় সাড়ে আট হাজার টাকায়। চার হাজার টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে বাকি সাড়ে চার হাজার টাকায় ঢাকায় থাকা-খাওয়া খুব কষ্ট হয়ে যেত আয়শার। সিদ্ধান্ত নেন বাড়ি ফিরে যাবেন।
বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার বিলাইছড়িতে তার গ্রাম। সেখানে ফিরে প্রথমে এক এনজিও’র সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ নেন কাপড় কাটার। তিন মাস প্রশিক্ষণ শেষে সেলাই মেশিন কিনে ঘরের মধ্যে নিজেই শুরু করেন সেলাইয়ের কাজ। প্রথমে খরিদ্দার পেতে কিছুটা কষ্ট হলেও আস্তে আস্তে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তারপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি আয়শাকে।
নিজের বিয়ের সব খরচ নিজেই বহন করেছে আয়শা। এক সময় বিয়ে করেন। বিয়ের আগে নিজের জমানো টাকা দিয়ে ছোট ভাইকে কিনে দিয়েছে দু’টি ব্যাটারী-চালিত রিকশা।
আয়শার মতো অনেক নারীই এখন শহর ছেড়ে চলে ফিরে যাচ্ছে নিজের গ্রামে। সেখানে গিয়ে তারা চেষ্টা করছেন কিছু না কিছু অর্থ উপার্জন করে সাবলম্বী হতে। ফলে গ্রামে বাড়ছে নারীদের শ্রমশক্তি। এরফলে চাঙ্গা হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতিও।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে বলা হয়েছে, এখন দেশের মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি। ১৯৯৫-৯৬ সালে শ্রমে নারীর অবস্থান ছিল শহরে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ, গ্রামে ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০০৩ সাল পর্যন্ত এ হার শহরেই বেশি ছিল। সর্বশেষ ২০১৬-১৭ সালে গ্রামে এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ দশমিক ৬ শতাংশে। অন্যদিকে, শহরে কমে হয়েছে ৩১ শতাংশ। গ্রামের শ্রমশক্তিতে যুক্ত নারীদের ৬০ শতাংশই আছেন কৃষি খাতে।
বিবিএসের ২০১৫-১৬ সালের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বিভাগীয় পর্যায়ে রাজশাহী, খুলনা ও রংপুরে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেশি। রাজশাহী বিভাগে সবচেয়ে বেশি ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ। খুলনায় ৪২ দশমিক ২ শতাংশ। রংপুরে ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ। চট্টগ্রামে ৩৪ শতাংশ, ঢাকায় ২৯ দশমিক ৯ শতাংশ, বরিশালে ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ এবং সিলেটে সবচেয়ে কম ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ।
আয়শা বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে নারীদের উন্নয়নের জন্য অনেক কিছুই করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ নারীই সে সব সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। যদি তারা একটু সচেতন হন, তবে অনেক সুযোগ-সুবিধাই রয়েছে যাতে করে নারীরা ঘরে বসেই উপার্জন করতে পারে এবং সাবলম্বী হতে পারেন।
নারী অধিকার বিষয়ক আন্দোলন কর্মী মারিয়া সরকার বলেন, আগে নারীরা তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য গ্রাম থেকে শহরে চলে আসত। এর মূল কারন ছিল গার্মেন্টস শিল্প। মূলত নারীরা শহরেই আসত এসব পোশাক কারখানায় চাকরি করে নিজের খরচ চালানোর জন্য। আর এসব কারখানায় কাজ করা নারীদের অধিকাংশের বাড়ি উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে। কারণ এসব এলাকায় দারিদ্র্যের হার অন্যান্য এলাকার চেয়ে কিছুটা বেশি ছিল।
তিনি বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এসব এলাকার চিত্র অনেকটা পাল্টে গেছে। কারণ এই সরকার নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী। পাশাপাশি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গ্রামীণ অর্থনীতিকেও চাঙ্গা করতে চায় এই সরকার। এজন্য নেয়া হয়েছে বেশ কিছু উদ্যোগ। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে একটি বাড়ী, একটি খামার প্রকল্পটি।
অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. সেকান্দার ইসলাম বলেন, বর্তমান সরকারের একটি বাড়ী, একটি খামার প্রকল্পে আগ্রহী হয়ে এখন অধিকাংশ বাড়ীতেই গড়ে উঠেছে খামার। আর এসব খামারে হাঁস, মুরগী, ছাগল, ভেড়া এবং গরু পালনের পাশাপাশি অনেক শাক-স্বব্জির চাষ অথবা পুকুরে মাছ চাষ করছেন। আর এসব করছেন বাড়ীর মেয়েরাই বেশি। আর এরফলে নারীরা যেমন অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হচ্ছেন আবার গ্রামীণ অর্থনীতিও চাঙ্গা হচ্ছে।
সুত্রঃ বাসস।