প্রসঙ্গ; শিক্ষা
জিয়াউল হক
সমাজেই তিন তিন জন বিশ্বখ্যাত দর্শনিক জন্ম নিয়েছিলেন। গ্রিক গ্যাং অব থ্রী নামে তাদেরকে এক নামে সবাই চেনে। সক্রেটিস, তার চুয়াল্লিশ বৎসর পরে প্লেটো এবং তারও একচল্লিশ বৎসর পরে এ্যরিস্টেটলের জন্ম। এই তিন দার্শনিকের দর্শন গ্রিক সমাজে ব্যাপকভাবে চর্চিত হতো। শাসক শ্রেণীর সাথে সক্রেটিসের চিন্তার অনৈক্য তাকে শেষ পর্যন্ত হেমলক পানে আত্মহত্যায় বাধ্য করার ঘটনা আমরা জানি।
সক্রেটিসের একটা উক্তি Know Thyself ’ ( নিজেকে জানো) অমর হয়ে আছে। নিজেকে জানলে কি হবে? সেই জানার পথ ও পদ্ধতিই কি? সে বিষয়ে সক্রেটিস নিশ্চুপ।
সক্রেটিসের অনেক পরে এসে ইসলাম সোজাসাপ্টা বলেছে; নিজেকে জানো, তা হলে তুমি তোমার স্রষ্টাকে জানবে। বলেছে; ‘মান আরাফা নাফসাহু ফাক্বাদ আরাফ রাব্বাহু অর্থাৎ যে নিজেকে চিনেছে, সে তার স্রষ্টাকে চিনেছে।
এই যে স্রষ্টাকে চিনতে পারার সহজ ও সোজা পথ, এই পথটাই সক্রেটিস, প্লেটো এবং এ্যরিষ্টেটল কেউই বলতে পারেন নি।
গ্রিক দর্শনের এই ব্যার্থতার অন্যতম কারণ গ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, যার মৌলিক ভিত্তি দুটো; এক-ইনটুইশন – Intuition, দুই- লজিক – Logic অর্থাৎ বোধ ও যুক্তি।
এই বোধ আর যুক্তির উপরে ভিত্তি করেই তারা টিকে থাকার চেষ্টা করেছে। সক্রেটিস থেকে শুরু করে এ্যরিস্টেটল পর্যন্ত সকলেই তাদের ‘বোধ কে যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।
মানুষের বোধে বা উপলব্ধীতেই যদি ভূল হয়, অপূর্ণতা থাকে, তা হলে কি সে অপূর্ণতাকে যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা যায়? এ প্রশ্নটি কেউ তুলেননি গ্রিক ঐ তিন দার্শনিকের কাছে। সর্বপ্রথম তাদের সেই দর্শন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে ইসলামের সান্নিধ্যে এসে।
গ্রিক সমাজে শিক্ষা দুটি মৌলিক ভিত্তির বিপরিতে ইসলাম তিনটি মৌলিক ভিত্তি দাঁড় করিয়েছে, বোধ ও যুক্তির সাথে এক্সপেরিমেন্টের তথা পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা বলেছে। তার মানে, ইসলাম বলেছে, জ্ঞানের উৎস হলো তিনটি; ইনটুইশন (Intuition), লজিক – (Logic), এক্সপেরিমেন্ট (Experiment) অর্থাৎ বোধ-যুক্তি আর নীরিক্ষণ।
এর মধ্যে প্রথমটি অর্থাৎ ইনটুইশন তথা বোধটার উৎস গ্রিক সমাজে মানুষে নিজের মনের উদিত চিন্তা ও বিশ্বাস । ইসলামে এই বোধের উৎস আল্লাহ প্রদত্ত অহি (নবী রাসুল গণের ক্ষেত্রে) অথবা ইলহাম (সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে)। এই ইলহামটিই অহির মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান, যুক্তি ও বাস্তবতার আলোকে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে বিশ্বাস করা বা না করাটাই হলো ইসলামি শিক্ষার মৌলিক ভিত্তিমূল।
এই ভিত্তিমূলের সন্ধানটাই সক্রেটিস ও তার অপর দুই শিষ্য দিতে পারেন নি। এটা হলো সক্রেটিসের শিক্ষা ও দর্শনের দূর্বলতা। এটা বলতে আমরা ভয় পাই, সংকোচ বোধ করি, কারণ, সক্রেটিস হলেন বিশ্বের কাছে এতো বড় দার্শনিক যে, তাকে পশ্চিমা বিশ্বে চিন্তা ও দর্শনের ইশ্বর ভাবা হয়। ইশ্বরের কি সমালোচনা করা যায়?
এই যে মনস্তত্ব, চিন্তা ও দর্শনের ক্ষেত্রে কিংবা ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তির ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত শ্রেষ্ঠত্ব থাকার কারণে প্রশ্নাতীতভাবে দাসত্ব করে যাওয়ার মত মানসিক অবস্থাটা ছিলো গ্রিক সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিষ্ঠিত। সেখানে আল্লাহর পরিচিতি কিছুই ছিল না। মানুষের বাইরে আরও উচ্চক্ষমতাশালী কর্তৃত্বপরায়ন কোন শক্তি যদি থেকে থাকে, তারা হলো; ভেনাস, এ্যাপেলো, জুপিটার এসব। আল্লাহ নয়।
সময় গড়িয়ে যাবার সাথে সাথে গ্রিকো-ল্যাটিন সেই দর্শনের মধ্যেও পরিবর্তণ এসেছে। মানুষের বোধ বুদ্ধি ও উপলব্ধীর মধ্যে এক বিরাট অপূর্ণতা রয়েছে এবং তাকে শিক্ষার একমাত্র ও চুড়ান্ত উৎস হিসেবে মেনে নেওয়াটা নিরাপদ নয়, সে বোধ তাদের মধ্যে এসেছে। কিন্তু তা তথা পশ্চিমা সভ্যতা ইনটুইশন এবং লজিক বা উপলব্ধী ও যুক্তি, এ দুটোকে বিজ্ঞানের অধিনস্থ করে দিয়েছে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যদি ইনটুইশন ও লজিক উৎরে যায়, তা হলে সেটাই সত্য!
মানবতার জন্য এ এক আত্মবিধ্বংসী বিশ্বাস। নিত্য পরিবর্তনশীল বিজ্ঞানকেই সত্যের উৎস হিসেবে মেনে নেয়াটা এক মারাত্মক ভ্রম। এই ভুলের মধ্যেই পড়ে আছে আজকের বিশ্ব; আধুনিক বিশ্ব।
আমরা আধুনিক যুগের অধিকাংশ মুসলমানরা ইসলামি শিক্ষা ও সাংস্কৃতির ধারক বাহক হবার বা তেমনটা হবার দাবীদার হওয়া সত্তেও কিন্তু সেই হাজার বসর প্রাচিন গ্রিকদের মানসিকতা ছাড়তে পারি নি।
আমাদের সমাজেও এখন শিক্ষার ক্ষেত্রে অন্যতম বড় সমস্যা হলো, ওস্তাদ বা শিক্ষকের কথার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। ওস্তাদ বা শিক্ষকের বাণীকেই শীরোধার্য হিসেবে মানতে হবে! অথবা যারা একটু স্বাধীন চিন্তা পোষণ করেন তারা ওস্তাদ বা শিক্ষকের মতের বিপরিতে আরও একজনের মতামতকে অন্ধের মত প্রাধান্য দেন; Science বা বিজ্ঞানের !
হয় আমার শিক্ষক, না হয় হয় বিজ্ঞান, দুটোর যে কোন একটা অবশ্যই সত্য ও চুড়ান্ত। এসবের কোনটিকেই শিক্ষার্থী তার নিজস্ব চিন্তা ও বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে পরখ করছে না। অথচ ইসলামের নির্দেশই হলো প্রতিটি জ্ঞান, তথ্য উপাত্ত ও শিক্ষা যাচাই করতে হবে, তারপরেই কেবল তা সত্য বলে গ্রহণ করতে হবে। কারোরই অন্ধ অনুসরণ করা যাবে না (আল কুরআন ১৭ : ৩৬)।
তার মানে হলো ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার তৃতিয় যে বৈশিষ্ঠ, সেই বৈশিষ্ঠের কোন চর্চা হচ্ছে না আমাদের মুসলিম সমাজের ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে।
এ মানসিকতার কারণে একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে স্বাধীন চিন্তাধারার উন্মেষ ঘটছে না যেমনি, তেমনি শিক্ষাও রয়ে যাচ্ছে অপূর্ণাঙ্গ ও অর্থহীন। ছাত্ররা পড়ছে তবে শিখছে না। এরকম পরিস্থিতি থেকে যত দ্রুত বের হয়ে আসা যায়, ততোই মঙ্গল।