সম্পর্কে যত্নশীল হয়ে উঠি
নিশাত জাহান নিশা
Effort and Expectation
দুটো শব্দই ইংরেজি অক্ষর E দিয়ে……. এই মিল টুকু ছাড়াও শব্দ দুটি একে অন্যের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত।
আজকাল Discorded Relationship (সম্পর্ক কলহ) একটি কমন সমস্যা। আর এই সম্পর্কগুলো হতে পারে, বাবা-মা ও সন্তান, ভাই-ভাই, ভাই-বোন, বন্ধু, প্রেমিক-প্রেমিকা অথবা স্বামী-স্ত্রী….
আর এই কমন সমস্যার মূল কারণ Effort & Expectation এর অসমতা…
আর এই অসমতাই দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যকার সম্পর্ক গুলো অতি দ্রুত ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়।।।
বিনা expectation এ যেমন কেউ effort করতে চায় না তেমনি effort ছাড়া expectation গুলোও কখনো পূর্ণতা পায়না। একটা সুষ্ঠু সম্পর্কের মধ্যে effort ও expectation দুটোই সমানতালে সমান ভাবে থাকতে হবে।
সম্পর্কে Effort ছাড়া Expectation হলো এক ধরনের ফুটো কলসির মত, effort না থাকলে আপনার expectation এর সেই কলস কখনোই পূর্ণ হবে না।।।
আজকাল সম্পর্ক গুলো কেন এত দ্রুত ভেঙে যায়, জানেন, কারন আজ কাল কার বেশিরভাগ সম্পর্কের মধ্যে এক পক্ষে effort দেয় আরেক পক্ষ expect করে, আর ভুলটা এই জায়গাতেই হয় সম্পর্ক যেহেতু দুটি মানুষের মধ্যে, তাই দুজনের মনের মধ্যেই থাকতে হবে একে অপরের প্রতি সম্মান দেওয়ার প্রচেষ্টা ও নিজ নিজ জায়গা থেকে নিজ নিজ দায়িত্ববোধ এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রত্যাশা, তবেই একটা সম্পর্কের মধ্যে ব্যালেন্স বজায় থাকে।
এবার চলুন জেনে নিই সম্পর্কের এক্সপেক্টেশন (প্রত্যাশা) গুলো কি কি।।।।
আমরা কমবেশি সবাই আমাদের সম্পর্কের মধ্যে যে এক্সপেক্টগুলো করি :
১) আমাকে বুঝতে হবে, কারন আমি আমি অভিজ্ঞ
২) আমার কথা শুনতে হবে, কারণ আমি ভাল চাই
৩) আমার ক্ষেত্রে ধৈর্যশীল হতে হবে
৪) ভালবাসলে সেক্রিফাইস মাইন্ডেড হতে হবে
৫) আমাকে অন্ধ বিশ্বাস করতে হবে, কখনো রিয়্যাক্ট করা যাবেনা
৬) আমার পছন্দ অপছন্দ কে মূল্যায়ন করতে হবে
৭) আমার ডিসিশন কে চূড়ান্ত বলে মেনে নিতে হবে
৮) আমার প্রতি 100% loyal থাকবে
৯) আমার মত করেই তাকে ভাবতে হবে (my choice is your choice)।।।
১০) আমার কথাকে অধিকতর সম্মান দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি……
অথচ আমরা খুব কম ব্যক্তিই আছি এই expect গুলো করার আগে, নিজেরা সম্পর্কের মধ্যে effort দেই।।।
এবার চলুন এফোর্ড (প্রচেষ্টা) গুলো কি জেনে নেই।
১) আপনার সম্পর্কের মানুষটির ধরন গড়ণ চলন সর্বোপরি সে যেই প্যাটার্নের তাকে সেভাবে গ্রহণ করা, অর্থাৎ যদি না সে গুরুতর সমাজ বিরোধী হয় তাকে পরিবর্তন করার আগে এটুকু বোঝা যে, আপনার সৃষ্টিকর্তা আপনাকে যেভাবে তৈরি করেছেন, সেই একই সৃষ্টিকর্তা তাকে তৈরি করেছেন তার মত করে।।।। অর্থাৎ প্রত্যেকটা ব্যক্তি যে স্বতন্ত্র সত্তার অধিকারী এতটুকু বিবেক বোধ রাখা।।।
২) আপনার যা ভালো লাগে তার কাছে সেটা ভালো নাও লাগতে পারে এই ছোট বিষয় টাকে শুধু জানা নয় মানতেও হয়।।।
৩) নিজের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত দাবি করার আগে, তার সিদ্ধান্তটির পক্ষের যুক্তি গুলো বুঝতে চেষ্টা করা।
৪) পরিপূর্ণ ভালোবাসা ও মর্যাদা দেওয়ার আগেই সেক্রিফাইস, ধৈর্য এগুলো আশা না করা।।।
৫) অপর মানুষটি নিজের অবস্থানে কতটুকু সমঝোতা করে, আপনাদের দুজনার সম্পর্কের মধ্যে সেক্রিফাইস মনোভাব গড়ে তুলতে হচ্ছে, সেটার সমীকরন তৈরি করা।।।
৬) নিজের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস প্রত্যাশা করার পূর্বে, নিজেকে তার কাছে আস্থাশীল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
৭)সম্পর্কের মধ্যে loyalty & liability দুটোই নিশ্চিত করা।
৮) সম্পর্কের মানুষটির প্রতি যত্নশীল হওয়া।
৯) সম্পর্কের মানুষটির self esteem, emotion, patience এগুলোর threshold লেভেল সম্পর্কে অবগত থাকা।
১০) আপনার সম্মান নিশ্চিত করার সাথে সাথে, তার সম্মান সুনিশ্চিত করা।
এই basic effort গুলো থাকলেই সম্পর্কগুলো মোটামুটি ব্যালেন্সে থাকে।।।
*সম্পর্কের মাঝে যখন আপনার expectation হবে ‘
‘feel to be comfort with him/her’
এর আগে আপনার effort হতে হবে
‘I have to make sure his/ her comfort with me’ কারণ আপনার effort এর ওপর ভিত্তি করেই আপনার expectation গুলোর পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটবে*
*Effort ছাড়া সম্পর্ক হলো হলো মাটি (ভিত্তি) ছাড়া গাছ, আর Expectation হলো সেই গাছের মধ্যে আবার ফলন চিন্তা করা।*
তোমার চেয়ে আমার Social Value/Network বেশি, তোমার কম… সম্পর্কটাকে এরকম competitive না করে complementary করে তুলুন “তোমার এটা আছে আমার ওটা আছে” একে অন্যের পরিপূরক। ব্যাস…
আজকাল আমাদের সম্পর্ক গুলোর মধ্যে এক ধরনের রোগ বাসা বেঁধেছে সেটা হলো: এক তরফা প্রচেষ্টা (effort) আর না হয় এক তরফা প্রত্যাশা (expectation)……আমরা যখন আমাদের সম্পর্কের মানুষের সাথে বাকবিতণ্ডা বা তর্কে জড়াই বা যেকোন বিষয়ে অমত হই, তখন কটু কথা বা কাজের মাধ্যমে তাকে ছোট করার সকল প্রচেষ্টা চালানো হয়, সে human being হিসেবে নূন্যতম যতটুকু মর্যাদা পাওয়ার কথা, (টাকা বা সম্পদের খোটা দিয়ে) সেটাও তাকে দেয়া হয় না…..
অথচ তার কাছ থেকে সেক্রিফাইস আশা করার বেলায় আমরা তাকে মহামানব বা দেবীর স্থানে বসিয়ে দেই, আর অকপটে বলে ফেলি আমার জন্য তুমি এতোটুকু সেক্রিফাইস করতে পারলে না…..
আচ্ছা বলুনতো সেক্রিফাইস কারা চায়? সেক্রিফাইস কাদের দরকার?
সেক্রিফাইস কাদের করা হয়?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কি?
উত্তর একটাই, যারা দুর্বল, অপারগ, নিজ দায়িত্বে বা ক্ষমতায় কায়েম থাকতে পারে না, তাদের জন্যই সেক্রিফাইস করা হয়।।। আর সেক্রিফাইস হলো একটি মোহ পেতে থাকলে, শুধু পেতেই ইচ্ছা করবে।
আপনাকে কেউ স্বেচ্ছায় সেক্রিফাইস করলো আপনি সেটা গ্রহণ করলেন, it’s ok এটা আপনার ব্যাপার।।।। কিন্তু আপনি কারো কাছ থেকে আগ বাড়িয়ে sacrifice আশা করবেন, it’s not ok। এটা শুধুই আপনার দুর্বলতার পরিচয় দিচ্ছেন।।।
উদাহরণস্বরূপ, একজন সুস্থ সবল ব্যক্তি যার দায়িত্ব নেয়ার সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যদি সমাজ তাকে দায়িত্ব মুক্ত করে দেয়, সেটা কি তার জন্য উপকার বা সেক্রিফাইস? বলতে পারেন, সেটা ব্যাক্তির potentiality/ প্রতিভা নষ্ট করার মতো উপকার, আর এই উপকারের মধ্যে কোথাও না কোথাও তাকে demean/ অদক্ষ দাবি করার সূক্ষ একটা ঘ্রান ও পাওয়া যায়।।।
নিজের সম্মান নষ্ট করে sacrifice পেতে কে চায়? অন্যের টা জানিনা, তবে আমি তো অবশ্যই এই ধরনের সেক্রিফাইস পাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতেই পছন্দ করি।।। তাই sacrifice এর মোড়কে, নিজেকে অদক্ষ দাবি না করে বরং নিজ নিজ দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার মধ্যেই সম্পর্কের সার্থকতা।।
সর্বোপরি, আমরা আমাদের জীবনের বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, সবধরনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এর প্রতি দায়িত্ববান বা যত্নশীল হয়ে উঠি।। আপনার জন্য কেউ সুখ ত্যাগ বা জীবন দেওয়ার নাম sacrifice নয় বরং এই অস্থিতিশীল, প্রতিকূল পৃথিবীতে আপনার সাথে একত্রে স্বর্গের সুখ অনুভব করার অক্লান্ত প্রচেষ্টার নাম sacrifice…
আপনার জীবনের সম্পর্কের মানুষটি বেঁচে থাকতে তার গুরুত্ব বুঝুন।
তার নামে বড় বড় ইমারত তৈরী করে অর্থের সেক্রিফাইস না দেখিয়ে, তার মনে ভালোবাসার অখন্ড পাহাড় তৈরি করুন।।।।
*তাজমহল’কে দুনিয়া দেখছে, মমতাজ কিন্তু দেখেনি*
নিশাত জাহান নিশা
অ্যাসিস্টেন্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট