স্মৃতির জোনাকি… ৩
আফরোজা হাসান
পাপার সন্ধানে পুরো বাড়ি পুনরায় আরেকবার ঘুরে দেখার পর নাবিহার খেয়াল হলো পাপার অন্যতম প্রিয় জায়গাতেই এখনো সন্ধান অভিযান চালানো হয়নি। সেই জায়গাটি হচ্ছে বাড়ির ছাদ। খেয়াল হওয়া মাত্র ছাদের দিকে ছুট লাগালো নাবিহা এবং তার আরাধ্য ব্যক্তিকে অবশেষে খুঁজে পেলো। কারো আগমনের শব্দ পেয়ে জাওয়াদও ফিরে তাকালেন। নাবিহা সালাম দিয়ে বললেন, পাপা তুমি এখানে? আমি সেই কখন থেকে তোমাকে খুঁজছি আর খুঁজছি।
সালামের জবাব দিয়ে জাওয়াদ বললেন, কেন আপনি আমাকে খুঁজছেন আর খুঁজছেন আম্মাজান?
নাবিহা হেসে বলল, অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপারে তোমার মতামত জানার জন্য। তবে সেই ব্যাপারে পরে কথা হবে। আগে বলো তুমি কি করছো এগুলো?
জাওয়াদ হেসে বললেন, আমি তোমার জাল দাদাভাইয়ের পাখীদের জন্য ঘর বানাচ্ছি। তোমার জাল দাদাভাইয়ের ব্যালকনির সাথে লাগোয়া গাছে যে দুটো পাখীর বাসা ছিল, গতরাতের ঝড়ো বাতাসের কারণে দুটো পাখীর বাসাই ভেঙে গিয়েছে। হজ্জ থেকে ফিরে এসে এই দৃশ্য দেখলে বাপী ভীষণ কষ্ট পাবেন। তাছাড়া নীড় ভাঙা পাখীরাও নিশ্চয়ই অনেক কষ্টে আছে। তাই ভাবলাম ওদের জন্য নতুন ঘর বানিয়ে দেই। বাড়ির বাচ্চাদের প্রায়ই দেখি পুরো ছাদ জুড়ে পাখীদের জন্য খাবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে। একটু বেখেয়াল হলেই খাবার পায়ের নিচে পড়ে। পাখীদের খাবার, পানি রাখার ব্যবস্থাও করে দিয়েছি। বাচ্চাদের সবাইকে বুঝিয়ে বলবে এখন থেকে যেন নির্দিষ্ট স্থানে খাবার রাখে।
নাবিহা হেসে বলল, ওকে পাপা ইনশাআল্লাহ। পাপা এই যে তুমি পাখীদের জন্য ঘর বানিয়ে দিচ্ছো, পাখীদের খাবারের জায়গা করে দিচ্ছো এজন্যও তো অনেক সওয়াব হবে তাই না? রাসূল (সঃ) তো বলেছেন, “মুসলিম যখন কোনো গাছ রোপণ করে, তখন এর যে ফল খাওয়া হবে এটা তার জন্য সদাকা হিসেবে গণ্য হবে। এ থেকে যা চুরি যাবে তাও সদাকা হিসেবে গণ্য হবে।হিংস্র প্রাণীও যদি তা থেকে খায় তাও সদাকা হবে। পাখি খেলে সদাকা হবে। (এমনকি) যে কেউ যে কোনোভাবে এ থেকে (উপকার) গ্রহণ করবে তা সদাকা হিসেবে গণ্য হবে।” আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কত মহান তাই না পাপা? সবকিছুর মধ্যেই সওয়াবের সুযোগ রেখেছেন। আমরাই গাফলতী করে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারিনা।
জাওয়াদ হেসে বললেন, গাফলতী করো কেন? কোনদিন যদি তোমাকে গাছে পানি দেয়ার দায়িত্ব দিয়ে যাই, তুমি বেমালুম ভুলে গিয়ে গাছেদের তৃষ্ণার্ত রেখে দাও।
নাবিহা বলল, সরি পাপা। আর মন হবে না ইনশাআল্লাহ। এখন থেকে আমিও গাছ লাগাবো, গাছেদের যত্ন করবো।
জাওয়াদ হেসে বলল, এই কথা তো যখন থেকে কথা বলা শুরু করেছো তখন থেকেই বলছো।
নাবিহা কিছুক্ষণ হাসলো। এরপর বলল, গতরাতে কি প্রচন্ড ঝড়ো বাতাস হচ্ছিলো পাপা! ভয়ংকর শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিলো কিছুক্ষণ পরপর। আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম। একবার ভেবেছিলাম মাঈশার রুমে চলে যাবো ওর সাথে ঘুমোতে। যাওয়ার জন্য উঠেও ছিলাম। কিন্তু রুম থেকে বেরুনোর জন্য দরজা খুলে দেখি তুমি বসে আছো আমার রুমের সামনে। আমি ভয় পাচ্ছি তুমি ফিল করেছিলে তাই না পাপা?
জাওয়াদ হেসে বললেন, এসো আমাকে সাহায্য করো পাখীদের জন্য ঘর বানাতে। কিছু সওয়াব অর্জন করো। সেই সাথে সদাকায়ে জারিয়ার সুযোগ তৈরি করো নিজের জন্য।
নাবিহা পাপার পাশে গিয়ে বসে হাসি মুখে বলল, গতরাতে তোমাকে দেখা মাত্র আমার সমস্ত ভয় এক নিমিষে উধাও হয়ে গিয়েছিল পাপা। একবার ইচ্ছে হয়েছিল তোমার সাথে বসে গল্প করতে। কিন্তু তুমি গভীর মনোযোগের সাথে বই পড়ছিলে তাই আর বিরক্ত করিনি। কিন্তু বিছানায় গিয়ে বসতে না বসতেই আবারো প্রচন্ড শব্দে বজ্রপাত হলো। আমি তখন বজ্রপাতের দোয়া পড়লাম। এরপর সেলফ মোটিভেশনের জন্য বললাম, বসে আছেন পাপা দরজার বাহিরে, হে ভয় এখনো কি যাওনি আমায় ছেড়ে? জানো না বুঝি যখন আশেপাশে থাকেন পাপা, আমি হয়ে যাই পেইন কিলার নাপা। সমস্ত প্রতিকূলতা তখন করতে পারি জয়, বজ্রপাত ভীতি হয়ে যাও চূর্ণ, এই মূহুর্তে ক্ষয়।
হেসে ফেললেন জাওয়াদ। কন্যার কান ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললেন, বেশি বেশি দুষ্টু হয়েছো তুমি।
নাবিহা হাসতে হাসতে বলল, আমার কোন দোষ নেই। দুষ্টুমি গুণও জেনেটিক্যালি পেয়েছি। আমার মামণির কাছ থেকে।
জাওয়াদ হেসে বলল, আচ্ছা! তা কেমন আছেন নাবিহার মামণি?
নাবিহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ মামণি ভালো আছেন। কিন্তু অনেক ঝামেলার মধ্যে আছে।
জাওয়াদ বললেন, ঝামেলার মধ্যে কেন? কি হয়েছে?
নাবিহা হেসে বলল, মামণির কিছু হয়নি পাপা। মামণির স্টুডেন্ট গ্রুপের বেশিরভাগ সদস্যাই তো এখন বিবাহিতা। তারা নিজ নিজ সংসার, বাচ্চাদের নিয়ে নানান ঝামেলাতে আছেন। সেসব ঝামেলার সমাধান করতে করতে মামণিরও ঝামেলার শেষ নেই। পাপা সুন্দর সুন্দর কিছু আশা জাগানিয়া কথা বলো।
জাওয়াদ হেসে বললেন, হঠাৎ আশা জাগানিয়া কথা কেন? তাছাড়া বলতে বললেই তো আশা জাগানিয়া কথা বলা যায় না। উৎস লাগে, প্রসঙ্গের দরকার হয়। তারপর যথার্থ বিশ্লেষণ অতঃপর মন্তব্যে গিয়ে আশা জাগানিয়া কথা বলতে হবে।
নাবিহা একটুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে বলল, পাপা তুমি তো আমাদের সবাইকে একা লালন পালন করেছো। আমরা তোমাকে অনেক যন্ত্রণাও করেছি। আমাদের দুষ্টুমিতে অতিষ্ট হয়ে তোমার কি কখনো মামণির উপর রাগ হয়েছে?
পাপা হেসে বললেব, তোমার মামণির স্টুডেন্টরা কি বাচ্চাদের সামলাতে গিয়ে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে তাদের লাইফ পার্টনারদের উপর অভিমান করে কখনো সখনো?
নাবিহা হেসে বলল, উনাদের সবার সাথে আমারও অনেক সুন্দর সম্পর্ক। ফোনে কথা হয় প্রায় সময়ই। অভিমানের কথা বলেনি কেউ সেভাবে তবে মাঝেমধ্যে রাগ হয় খুব নিজ নিজ লাইফ পার্টনারের উপর সেটা বলেছে।
জাওয়াদ হেসে বললেন, ওটা মূলত অভিমান, রাগ নয়। সন্তান বলো আর সংসার সেটা উভয়েরই। তাই আনন্দ বেদনা সবকিছু ভাগ করে নেবার একটা আকাঙ্ক্ষা থাকে মনে। পার্টনার যখন দূরে থাকে আনন্দের মূহুর্তগুলোতে যেমন তাকে মনে পড়ে, কষ্টের মূহুর্তগুলোতেও তাকেই সবার আগে মনেপড়ে। তোমরা যখন অনেক মজার কিছু করতে বা বলতে আমার তোমাদের মার কথা সবার আগে মনে পড়তো। মনেহতো তোমাদের মা সাথে থাকলে অনেক আনন্দ পেতো এখন। আবার যখন খুব বিরক্ত করতে কোন কারণে তখনো তোমাদের মাকেই সবার আগে মনে পড়তো। মনেহতো তোমাদের মা পাশে থাকলে এই পরিস্থিতিটা হ্যান্ডেল করা অনেক সহজ হয়ে যেতো আমার জন্য। এটা মূলত লাইফ পার্টনারের প্রতি নিজের নির্ভরশীলতার প্রকাশ। জীবনের আনন্দ বেদনা, সুখ দুঃখ সবকিছু ভাগাভাগি করে নেবার ওয়াদা করেও কেন নেই সে আমার পাশে কঠিন এই মূহুর্তে? এই চিন্তাটা মোটেও রাগ নয়। অধিকার মিশ্রিত অভিমান, ভালোবাসার আকুল আবেদন।
আমি তাহলে উনাদেরকে কি বলবো পাপা?
জাওয়াদ হেসে বললেন, উনাদেরকে বলার দায়িত্ব তোমার মাকেই পালন করতে দাও। আমরা খাল কেটে কুমীর না আনি।
নাবিহা হাসতে হাসতে পাপার কথাকে সমর্থন করলো। এরপর পাপাকে অনুকরণ করে পাখীদের জন্য ঘর বানানোতে মনোযোগ দিলো। বেশ অনেকক্ষণ নীরবে কাজ করার পর নাবিহা বলল, সুখী হওয়ার জন্য, ভালো থাকার জন্য চারপাশের সবকিছু কি মনের মতো হওয়াটা জরুরি পাপা?
জাওয়াদ হেসে বললেন, চারপাশের কোন কিছুই তো শতভাগ তোমার, আমার বা অন্য কারোই মনের মতো হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের মন সদা জাগ্রত ক্রিটিকের মতো। পারফেক্ট সবকিছুর মধ্যে থেকেও অবলীয়ায় ইনপারফেকশন খুঁজে বের করে ফেলে মূহুর্তেই। জগতের কোন কিছুই একদম তোমার মনের মতো হবে না। সুখী হবার জন্য এই কথাটাকে মনের মাঝে স্থাপন করতে হবে সবার প্রথমে।
কিন্তু কথাটা যদি কোন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে হয় তাহলে? আইমিন, সময়ের ব্যবধানে কারো আচরণ যদি বদলে যায়? যেভাবে সাপোর্ট করা উচিত সেভাবে যদি না করে তাহলে? সেক্ষেত্রে কি হবে পাপা?
জাওয়াদ বললেন, সাপোর্ট করা উচিত কিন্তু স্বইচ্ছায় করছে না আবার সাপোর্ট করা উচিত কিন্তু করতে পারছে না কোন কারণে। এই দুটা সিচুয়েশন কিন্তু ভিন্ন। যারা আমাদেরকে ভালোবাসে, কেয়ার করে কিংবা যাদেরকে আমরা ভালোবাসি, কেয়ার করি তাদের অপরাগতা মেনে নেয়াটা ভালো থাকার এবং তাকে ভালো রাখার মূলমন্ত্র সমূহের একটি। ইউ কান্ট জাস্ট গিভ আপ অন সামওয়ান বিকজ দ্য সিচুয়েশন’স নট আইডিয়াল। এই জগতে যত সুন্দর সম্পর্ক আছে, বন্ধন আছে। যাদেরকে আমরা আদর্শ মানি, মডেল, আইডল হিসেবে ভাবি তুমি যদি তাদের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখো তাহলে দেখতে পাবে যে, তাদের সম্পর্ক সুন্দর এর পেছনে কারণ এটা নয় যে তাদের মধ্যে কোন সমস্যা নেই। তাদের সম্পর্ক সুন্দর কারণ তারা সমস্যাগুলোকে তাদের সম্পর্কের উপর, বন্ধনের উপর সওয়ার হতে দেয়না। তারা প্রতিকূলতার জন্য একে অন্যকে দোষারোপ না করে পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে সেই পরিস্থিতিটা মোকাবিলার চেষ্টা করে। যারফলে তাদের সম্পর্ক আরো সুন্দর হয়ে ওঠে এবং বন্ধন আরো মজবুত হয়। একটা কথা আছে, গুড বেটার এন্ড বেস্ট, নেভার লেট ইট রেস্ট। আমাদের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া রয়েছে, আমরা গুড ফ্রেন্ড, এরচেয়ে বেস্ট আর কিছু হতেই পারে না। এমন ভাবার কোন অবকাশই নেই নিজের ব্যক্তিজীবনের কোন ক্ষেত্রে কিংবা আমাদের জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা কোন স্পেশ্যাল বন্ধনের ক্ষেত্রে। এই যেমন তোমরা যখন বলো, আমাদের পাপা এই পৃথিবীর বেস্ট পাপা। আমি তখন মনে মনে বলি, গুড বেটার এন্ড বেস্ট, নেভার লেট ইট রেস্ট। টিল ইউর গুড ইজ বেটার এন্ড ইউর বেটার ইজ বেস্ট। মোর, মোর এন্ড মোর।
নাবিহা হেসে বলল, লাভ ইউ পাপা। ইউ আর দ্য বেষ্ট, ঐ দেখো নানুমণিও হাজির করতে তোমায় অ্যারেস্ট।
হেসে ফেললেন জাওয়াদ। মিসেস সুরাইয়াও হাসতে হাসতে কন্যা জামাতা আর নাতনীর সাথে এসে বসলেন।
চলবে..
পর্ব-২