স্মৃতির জোনাকি…২
আফরোজা হাসান
আজাদ সাহেব আর মিসেস সুরাইয়া নাস্তা করছিলেন। নূহা এসে সালাম দিয়ে হেসে বলল, মামণি তোমার জন্য একটা গিফট আছে। এরপর হাতের প্যাকেটটা মামণির দিকে বাড়িয়ে ধরে হেসে বলল, এখন খুলতে পারবে না। আমি চা নিয়ে উপরে যাবার পর খুলবে।
কন্যার হাত থেকে গিফট নিয়ে আহ্লাদিত কন্ঠে মিসেস সুরাইয়া বললেন, কি আছে এটার ভেতরে?
নূহা হেসে বলল, চা নিয়ে এক্ষুণি চলে যাচ্ছি এরপর নিজেই খুলে দেখো।
আজাদ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমাদেরকে কেউ গিফট টিফট দেয় না কখনোই। অবশ্য মাকে তিনটা গিফট দেবার পর গিয়েই না বাবার পালা আসবে। মাত্র তো দুটা হলো এটা নিয়ে। হুমমম…
হাত থেকে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে পাপাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিয়ে হাসতে হাসতে চা নিয়ে চলে গেলো নূহা। তৎক্ষণাৎ দুই টানে প্যাকেট খুলে ফেললন মিসেস সুরাইয়া। আজাদ সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, মেয়ের ব্যাপারে একদম বাচ্চাদের মতো হয়ে যাও তুমি সুরাইয়া।
স্বামীর কথাওয়াই কান না দিয়ে প্যাকেট খুলে গিফট বের করে একদম বিমুগ্ধ হয়ে গেলেন মিসেস সুরাইয়া। আজাদ সাহেবও মুগ্ধ কন্ঠে বললেন, মাশাআল্লাহ এতো ভয়াবহ সুন্দর। আমার মা কি নিজ হাতে বানিয়েছে নাকি?
আনন্দিত কন্ঠে মিসেস সুরাইয়া বললেন, আলহামদুলিল্লাহ অবশ্যই আমার মেয়ে বানিয়েছে। দেখেছো কি অদ্ভুত সুন্দর টি-কোজিটা! নানান রঙের উলের সুতো দিয়ে ছোট্ট কুটিরের অবয়বে টি-কোজিটা টা বানিয়েছে। মুগ্ধ চোখে যখন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে টি কোজিটা টা দেখছিলেন মিসেস সুরাইয়া হঠাৎ ভেতর থেকে একটা চিরকুট পড়লো। আজাদ সাহেব হাত বাড়িয়ে চিরকুটটি তুলে নিয়ে খুলে হেসে বললেন, তোমার আদূরে কন্যা লিখেছে, “তোমাকে ঠেলতে গিয়ে দূরে মামণি, থমকে গিয়েছিলাম দেখে হৃদয়ের আয়নাখানি। অন্তর জুড়ে তোমার ছবিই সবচেয়ে উজ্জ্বল, তপ্তদাহে ছায়া তোমার মমতা মাখা আঁচল। যতই মেতে থাকি অন্যের সনে উল্লাসে, মাগো তুমি মিশে আছো মোর প্রতিটি নিঃশ্বাসে। জড়িয়ে থাকো তুমি সর্বদা ছায়ার মতোই, কাছে থাকি তোমার কিংবা দূরে যতোই।
আদরের মেয়ের কাছ থেকে এমন ভালোবাসা পূর্ণ শব্দসম্ভার উপহার পেয়ে মিসেস সুরাইয়ার দু’চোখ বেয়ে অঝোর অশ্রু নেমে এলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগলেন একদম। আজাদ সাহেব তখন স্ত্রীকে ধরে বললেন, এমন করে কেঁদো না সুরাইয়া প্লিজ। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। চলো তুমি উপরে চলো। নূহার কাছে গিয়ে বসবে। দুজন উপরে যাচ্ছিলেন কিন্তু জাওয়াদকে দেখে আজাদ সাহেবকে যেতে বলে মিসেস সুরাইয়া নাস্তা দিলেন জাওয়াদকে।
নাস্তা করতে বসে টেবিলের উপর কুটির আকৃতির টি কোজিটা দেখে জাওয়াদ হেসে বললেন, এটা কি টি কোজিটা? অদ্ভুত রকম সুন্দর। এটা কি আপনার কন্যার তৈরি?
মিসেস সুরাইয়া গর্বিত কন্ঠে বলল, আলহামদুলিল্লাহ অবশ্যই আমার কন্যার তৈরি। আমার কন্যা ছাড়া সবকিছুতেই এমন গৃহের মায়া ফুটিয়ে তোলার মতো আর কেউ আছে নাকি?
জাওয়াদ হেসে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। আমি উনার ড্রয়ারে কয়েক কালারের উলের সুতো দেখেছিলাম। সেই আন্দাজের সাথে আপনার চেহারায় ছড়িয়ে থাকা গদগদ ভাব দেখে ঢিল ছুঁড়েছিলাম। তা না হলে আমার জানা ছিল না আপনার কন্যা এত চমৎকার উলের কাজও জানেন।
তুই জানিসই কতটুকুন আমার মেয়ে সম্পর্কে? আমার মেয়ে হচ্ছে ম্যাজিক। বুঝেছিস?
জাওয়াদ হেসে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। কিভাবে জানবো বলেন? বিয়ের পর শ্বাশুড়িরা মেয়ের জামাইকে পাশে বসিয়ে মেয়ের সম্পর্কে খুঁটিনাটি সবকিছু জানান। কিন্তু আমার শ্বাশুড়ির আমার পাশে এসে বসা মানেই বকাঝকা। যাইহোক, তা আপনার ম্যাজিক গার্ল কোথায়? স্বামী বাড়িতে থাকলে তাকেও যে একটু আধটু ম্যাজিক দেখানো আবশ্যক এই তথ্য কি উনি জানেন না? এখনো পর্যন্ত জেনে না থাকলে আপনার তো উচিত কন্যাকে জানানো।
আমার মেয়েকে আমি কি জানাবো, কি জানাবো না সেটা কি এখন তোর কাছ থেকে শিখতে হবে? চোখ পাকিয়ে বললেন মিসেস সুরাইয়া।
জাওয়াদ হেসে বললেন, শিক্ষা তো মামণি অক্সিজেনের মতো। আমরা যেমন নিয়ম তৈরি করি না যে, আমি কেবল মাত্র বটবৃক্ষ বা আম গাছ থেকে বের হওয়া অক্সিজেনই গ্রহণ করবো। অন্য গাছের অক্সিজেনে আমার এলার্জী আছে। শিক্ষা ব্যাপারটাও এরকম। আমরা যে কোন সময়, যে কারো কাছ থেকেই শিক্ষা অর্জন করতে পারি।
যে কোন সময়, যে কারো কাছ থেকে শিক্ষা অর্জন করতে আমার কোনই আপত্তি নেই। আমার শুধু তোর কাছ থেকে শিক্ষা অর্জনে এলার্জী। তুই যেমন চেরীফল সহ্য করতে পারিস না, আমি তেমন তোর জ্ঞানের কথা সহ্য করতে পারিনা।
আচ্ছা বাদ তাহলে জ্ঞানের কথা। মেয়ের সংসারে তার মায়ের প্রভাব মারাত্মক। শ্বাশুড়িকে তাই খুশি রাখাটা জরুরি। হাসলে হাসতে বললেন জাওয়াদ।
টিজ করা কি মানুষকে খুশি রাখার নতুন পদ্ধতি নাকি? কথা বলছিস না কেন? চুপ করে আছিস কেন? জবাব দে?
জাওয়াদ হেসে বললেন, মেয়েকে যে স্বামীর সেবাযত্ন বিষয়ক কোন শিক্ষাই দেননি। সেই জবাব না আপনি দেবেন।
মিসেস সুরাইয়া বললেন, মেয়ের স্বামীর ঘরে যাবার বয়স হবার মতো সময় পেলে অবশ্যই দিতাম। কিন্তু মেয়ের দুধের দাঁত সব পরে উঠতে না উঠতেই তো জাদু টোনা করে জামাই এসে হাজির।
হাসতে হাসতে জাওয়াদ বললেন, জাদুটোনা করে?
অবশ্যই জাদুটোনা করে। জাদুটোনা ছাড়া তোর মতো বুড়া ছেলেকে আমার মেয়ে পছন্দ করতে যাবে কোন দুঃখে।
জাওয়াদ হেসে বললেন, জাদুটোনা জানলে মেয়ের আগে মেয়ের মাকেই করতাম। তাতে তার ভিলেনিপনার হাত থেকে অন্তত মুক্তি মিলতো। মামণি একটা প্রশ্ন করলে সত্যি জবাব দেবে?
তোকে কি আমি ভয় করি নাকি যে ভয়ে মিথ্যা জবাব দেবো?
জাওয়াদ হেসে বললেন, তোমার কি আমাকে মেয়ের জামাই হিসেবে পছন্দ হয়নি?
উহু, হয়নি।
জাওয়াদ হেসে বললেন, কেন?
আমি আমার মেয়ের জন্য খুব সহজ সরল একটা জামাই চেয়েছিলাম। নির্ঝঞ্ঝাট, পিছুটান নেই এমন কোন ছেলে। আটটা থেকে পাঁচটা ডিউটি করবে। বাকি সময় আমার মেয়ের সাথে কাটাবে। যার মাথার মধ্যে জ্ঞানার্জনের ভূত থাকবে না, মহাজ্ঞানী টাইপ হবে না। সারাক্ষণ মিশন, ভিশন জপবে না। কথায় কথায় তর্জন গর্জন করবে না। একদম শান্ত ও মিষ্ট স্বভাবের হবে। সাধারণ কর্মী টাইপ ছেলে হবে। নেতাগিরি করে বেড়াবে না সর্বত্র। বিশাল বিশাল দায়িত্ব যার কাঁধের উপর থাকবে না। যার জগত হবে আমার মেয়েকে ঘিরে। আমাকে মেয়েকে খুশি রাখা, আনন্দে রাখাটা যার ফেব্রেট হবি হবে। এমন আরো নানান চিন্তাভাবনা ছিল। যার কোনটাই তোর মধ্যে নেই। সেই সাথে আমার অপছন্দনীয় সমস্ত কিছু আবার উপস্থিত তোর মধ্যে।
জাওয়াদ হেসে বললেন, তুমি তাহলে তোমার পছন্দের লিষ্ট আমাকে দাও। যেটা যেটা আয়ত্ত্ব করা সম্ভব আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো নিজের মধ্যে ধারণ করার। যেমন তোমার মেয়েকে খুশি রাখা, আনন্দে রাখাটাকে আমি হবি না আমার কর্তব্যকর্ম মনেকরি। শখ বদলে যেতে পারে মা। কিন্তু কর্তব্যকর্ম প্রতিটি বন্ধনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যতক্ষণ বন্ধন অটুট থাকে, কর্তব্যকর্ম না বদলে যায়, না হেলাফেলা করার সুযোগ থাকে। আচ্ছা চলো তুমি আর আমি আজ একটা ডিল করি। মেয়ের জামাইকে ঘিরে তোমার যত চাওয়া পাওয়া ছিলো সবকিছু মিলিয়ে একটা কোয়েশ্চেন পেপার তৈরি করে দাও আমাকে। আমি তোমার কাছে পরীক্ষা দেবো। যদি সব প্রশ্নের জবাবে উৎরে যেতে পারি, তাহলে নিশ্চয়ই তোমার আপত্তি থাকবে না আমাকে মেয়ের জামাই হিসেবে খুশি মনে মেনে নিতে?
মিসেস সুরাইয়া বললেন, আইডিয়া মন্দ না। চিন্তা ভাবনা করে এরপর আমার সিদ্ধান্ত জানাবো তোকে ইনশাআল্লাহ।
জাওয়াদ হেসে বললেন, এখন তাহলে বলে দাও আমার বৌ কোথায়?
মামণি বললেন, উপরেই কোথাও আছে। উঠছিস কেন? বোস চুপচাপ। তুই যেতে পারবি না এখন ওর কাছে।
জাওয়াদ বললেন, এটা আবার কেন?
মিসেস সুরাইয়া বললেন, আইমিন, একা যেতে পারবি না। আমিও যাবো তোর সাথে। চা নিয়ে আসি রান্নাঘর থেকে ততক্ষণ বসে থাক। এরপর একসাথে যাবো।
জাওয়াদ হেসে বললেন, নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। বৌকে একেবারে না দেখার চেয়ে ভিলেন শ্বাশুড়ির নজরদারীর মধ্যে দেখাও উত্তম। যান যান চা নিয়ে আসেন। আমিও বসে বসে দোয়া করতে থাকি আমার কানা মামা যাতে দুষ্টু গরু হয়ে না যায়। আমাকেও যাতে প্রবাদ উল্টে বলতে নাহয়, দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো।
মিসেস সুরাইয়া জাওয়াদকে ঘুষি মেরে হাসতে হাসতে চলে গেলেন চা আনার জন্য। কারো মৃদু ধাক্কা মূহুর্তেই অতীতের আনন্দঘন সময় থেকে বর্তমানে নিয়ে এলো মিসেস সুরাইয়াকে। নাবিহা হাসতে হাসতে বলল, নানুমণি কি হয়েছে তোমার? সেই কখন থেকে দেখছি টি কোজিটার দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে আছো। কি ভাবছো এমন করে?
বিরক্ত কন্ঠে মিসেস সুরাইয়া বললেন, তোদের যন্ত্রণায় শান্তি মতো কোথাও বসবো সেই সুযোগও নেই। কি চাই?
নাবিহা হেসে বলল, আমার পাপাকে খুঁজে পাচ্ছি না কোথাও। পাপা কোথায় বলে দাও। তাহলে তোমাকে আর বিরক্ত করবো না।
মিসেস সুরাইয়া বললেন, তোর পাজী পাপাকে তো আমিও খুঁজছি। মামণি নাস্তা দাও বলে সেই যে গেলো আর কোন খবর নেই।
নাবিহা হেসে বলল, তাহলে চলো আমরা দুজন মিলে পাপার সন্ধানে যাই। যে প্রথমে খুঁজে পাবে পাপাকে বিরক্ত করার প্রথম সুযোগ তার।
হেসে ফেললেন মিসেস সুরাইয়া। এরপর নানী, নাতনী মিলে খুঁজতে বের হলো জাওয়াদকে।
চলবে….