banner

মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: November 15, 2024

 

সন্দেহ

সন্দেহ


মিথিলা ফেরদৌস


দু’টি অভিজ্ঞতাই বাস থেকে নেয়া।খুব দুঃখজনক ঘটনা, দুটোই।

১.
কাউন্টারে বাসের টিকিট কেটে ঘুরে দাঁড়িয়েছি মাত্র,পাশেই লম্বা ফর্সা,কালো ফ্রেমের চশমা পরা ছেলেটা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

ঃকিউজ মি আপু,আপনি তো ডাক্তার তাই না?
ঃজ্বী?
ঃআপনাকে মনে হয় কোথাও দেখেছি।আপু,আমি আপনার জুনিয়র হবো।একটা দরকার ছিল।
ঃকি দরকার?
ঃআমার ওয়াইফের টিকিট আপনার সাথেই কেটেছি।আপনি যদি আপনার নাম্বার দিতেন, কখন পৌঁছায় জেনে নিতে পারতাম।

১০/১২ বছর আগের কথা,মোবাইল খুব একটা সবার কাছে না থাকাটা স্বাভাবিক ঘটনা তখন।আমি নাম্বার দিয়ে, একটু দূরে গোমড়া মুখ করে শুকনা এক মেয়ের দিকে তাকালাম।মেয়েটা ফাঁকে ফাঁকে এদিকে দেখছে,আবার অন্যদিকে তাকিয়ে উদাস!সেই মেয়েই ওই ছেলের বউ কিনা বুঝলাম না।নাম্বার দিয়ে,বাসের জন্যে অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ পর বাস ছেড়ে দিবে, বাসে গিয়ে বসলাম। আমার সিট জানালার পাশেই। পাশে সেই গোমড়ামুখো মেয়েটিই এসে বসলো। আমি মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটু হাসি দিতে গিয়ে দেখলাম, মেয়ে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।

আমি সাধারণত নিজে থেকে কারো সাথেই কথা বলিনা, কে কিভাবে নেয় সেইটা ভেবে। এই ক্ষেত্রেও বলতে গিয়ে লজ্জায় পরে গেলাম। বাস চলতে শুরু করেছে। জানালার ওপাশে তাকিয়ে নিজের চিন্তার জগতে চলে যাই।
ঘন্টাখানেক বা তারও বেশি পরে, মেয়েটা হঠাৎ কথা বলে উঠে।

ঃআপনি আমার হাজবেন্ডকে কিভাবে চেনেন?
আমি চমকায় উঠি। মেয়েটার মুখ থমথমে। শ্যামলা, অনেক হালকা পাতলা মেয়ে।
ঃআমি আপনার হাজবেন্ডকে চিনিনা।আপনি একা যাচ্ছেন তাই উনি আমার সাথে আপনার টিকিট করেছেন, তাই বললেন। আমার নাম্বার নিলেন, আপনার খবর নিতে।

মেয়েটা মনে হলো ব্যাপারটা সহজে মেনে নিতে পারছে না।
আমিও আর কথা বাড়াইনা।

এরপর মেয়ে আমাকে আরও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে নিশ্চিত হয়। আমার সাথে তার হাজবেন্ডের কোনও পুর্ব পরিচয় ছিল না।

মেয়ের কথায় যতটা বুঝি, হাজবেন্ড ডাক্তার, মেয়ে মেডিকেল স্টুডেন্ট। হাজবেন্ড খুব অত্যাচার করে। বাসা থেকেই বিয়ে। মেয়ের আগের পছন্দ ছিল, সেই ছেলে দেশের বাইরে। মেয়ের হাজবেন্ড মেয়েকে সন্দেহ করে, খুব টর্চার করে ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমার গন্তব্যে পৌছানোর আগেই একবার ছেলেটা ফোন করে, আমি সাথে সাথেই ফোন মেয়েকে দিয়ে দেই।

মেয়েটাকে দেখে আমার মনে হয়েছে, সে একটা মানসিক সমস্যার মধ্যে আছে।সমস্যা ছেলেটার না। আমার ভুলও হতে পারে। বহু পরে মেয়েটা একবার ফোন করে কেঁদেছিল। সম্ভবত বিয়েটা টেকেনি বা তেমন কিছু বলেছিল। আমার মনে নাই।

২.
বাসে আমি যথারীতি জানালার পাশে।পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে অপেক্ষা করছি, কখন বাস ছেড়ে দিবে। ঠিক সেই মুহুর্তে অপূর্ব সুন্দর একটা মেয়ে আমার পাশে বসে হাঁপাতে থাকে।

ঃআপু, আপনার কাছে পানি আছে?
আমি একটু অবাক হই। বাসে, বিশেষ করে এইসব বাসে এমন সবাই যায়!! সবাই নিজেকে সুপিরিয়র ভাবে। তাছাড়া নিরাপত্তার জন্যেই কেউ কারো কাছে পানি চায় না।
ঃআছে।
বলে, হ্যান্ড ব্যাগ থেকে পানির বের করে দিই। মেয়েটা পুরো পানি খেয়ে আমার দিকে তাকায়।
ঃস্যরি আপু, খুব পিপাসা পেয়েছিলো।জানালার পর্দাটা টেনে দিবেন আপু!আমার একটু সমস্যা আছে পরে বলছি।বাস চলতে শুরু করলে, আবার খুলে দিবেন।

মেয়েটা সুপারভাইজারকে ডেকে ডাব আর পানি কিনতে দেয়।

বাস ছাড়ার পর, পর্দাটা সরিয়ে দিলে, মেয়েটাকে খেয়াল করি। অতিমাত্রায় সুন্দর মেয়ে। গায়ের রঙ মধ্যপ্রাচ্যীয় টাইপ, গলায় নীলচে শিরা উপশিরাগুলি বোঝা যাচ্ছে। একহারা গড়ন। হালকা নীলের মধ্যে ডিপ নীল ব্লকের জামাটা অদ্ভুত সুন্দর মানিয়েছে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই চোখ পরে যায়, ঘাড়ে লালচে মারের দাগ, গালে অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া চড়ের দাগ। চোখে স্পষ্ট মেঘ জমে আছে।মন খারাপ হয়ে যায়। চুপ মেরে বাইরে তাকাই।

মেয়ে বাস কিছুদুর চলে আসার পর, নিজে থেকেই শুরু করে। সে ঠাকুরগাঁওয়ের মেয়ে। সেখানে তার হাজবেন্ড ব্যবসার কাজে গেলে, তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বিয়ে করে নিয়ে আসে।ঢাকার মগবাজারে শ্বশুরবাড়ি। বরের নিজেদের বাড়ি। বিয়ের পর ঢাকায় ইডেনে অনার্সে ভর্তি হয়। মেয়ে ভাল স্টুডেন্ট। বরের পড়ালেখা তেমন নাই।
বিয়ের কিছুদিন পর শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। সন্দেহ যার মুল কারণ।হাজবেন্ডের বন্ধু থেকে শুরু করে সবার সাথেই মেয়েকে সন্দেহ করে, প্রায়শই মেয়েকে অমানবিক নির্যাতন করা হতো।একবার আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টাও করা হয়েছে। মেয়েকে বাড়ির সাথে কোনও যোগাযোগ করতে দেয়া হয় না।আগেরদিন অনেক রাত পর্যন্ত মেরেছে, মাতাল স্বামী। সকালে ঘুমিয়েছিল। মেয়ে কলেজে যাওয়ার নাম করে বের হয়। সাথে গাড়ি পাঠানো হয়, যাতে পালাতে না পারে। মেয়ে গাড়ি বাইরে রেখে, কলেজে ঢুকে। কলেজ থেকেই কোনওমতে বাস স্ট্যান্ড এসেছে। রাত থেকে এখন অব্দি পানি পর্যন্ত খেতে পারেনি। ভয়ে ছিল, কেউ পিছে পিছে আসছে কিনা, ড্রাইভার খবর দিলো কিনা? গাড়িতে উঠে মোবাইল বন্ধ করে দিয়েছে।

মেয়েকে সারারাস্তা কারো সাথেই কথা বলতে দেখিনি। পলাশবাড়ির কাছে মোবাইল অন করে, বোনকে ফোন করে শুধু জানায়, সে রংপুর হয়ে বাড়ি ফিরছে।

খুব মন খারাপ হয় মেয়েটার জন্যে। মেয়ের যদি তেমন কিছুই থাকতো, তাহলে আজ তার সাথেই পালাতো। আমি মেয়েকে পুরা রাস্তায় কোনও ছেলের সাথেই যোগাযোগ করতে দেখিনি। এবং মেয়েকে দেখে খুব সরল মনে হয়েছে। যেই ছেলে এই মেয়ের সাথে এমন করলো, সেই ছেলে নিজের ভাগ্য নিজেই নষ্ট করলো।

অতিরিক্ত সন্দেহ আমাদের নিজেদের যেমন অসুখী করে, আমাদের পার্টনার, সন্তানদেরকেও অসুখী করে তোলে। এইটা একটা মানসিক রোগ। আমরা কেউই সন্দেহবাতিকের উর্ধ্বে নই। কিন্তু তা যাতে বাড়াবাড়ি হয়ে না যায়। আমার মনে হয়, সন্দেহ না করে ঠকে যাওয়াতেও শান্তি।যেই ঠকা বুঝলামই না, তাতে আর কষ্ট কি! কিন্তু খামোখা সন্দেহের কষ্ট আরও বেশি কষ্ট দায়ক। যদিও এইটা আমার নিজস্ব ভাবনা। তবে সুখী হওয়ার জন্যে, এইটা খুবই জরুরী বিষয়।