banner

মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: November 15, 2024

 

অভিমানী মনের আত্মদহন… শেষ খন্ড

অভিমানী মনের আত্মদহন… শেষ খন্ড


আফরোজা হাসান


আফরা হেসে বলল, জ্বি আপি। আমি গতকাল ধরতে চেষ্টা করেছিলাম। ধরতে যাচ্ছিলাম তখনই প্রজাপতি উড়ে অন্য আরেকটি ফুলে বসছিল। আমি পা টিপে টিপে সেই ফুলের কাছে গিয়ে ধরতে চেষ্টা করলাম প্রজাপতিটি আবারো উড়ে গেলো। এমন কয়েকবার করার পর শেষপর্যন্ত প্রজাপতিটি উড়তে উড়তে আমাদের বাগান থেকেই বাইরে চলে গেলো।
মারওয়া হেসে বলল, গতকাল তোমার আর প্রজাপতির কর্মকান্ড আমি দেখেছিলাম। জানো আফরা আমাদের মন বাগিচায়ও এমন বর্ণিল প্রজাপতির রূপে সুখ-শান্তি বসে থাকে চুপটি করে। সেই বর্ণিল প্রজাপতির সৌন্দর্যে লালায়িত হয়ে আমরা ছুটে যাই ধরার জন্য। সুখকে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলতে চাইলে বেশির ভাগ সময়ই সেটা উড়ে আরেকটু দূরে সরে বসে। ধরে ফেলার চেষ্টা অব্যহত থাকলে একসময় বিরক্ত হয়ে সুখ মন বাগিচা ছেড়েই চলে যায়। সুখকে তাই কখনোই ধরতে চাওয়া ঠিক না। তাছাড়া মনের বাগিচাটা যেহেতু তোমার সেহেতু বাগিচার ফুল, পাখী, ফড়িং, প্রজাপতি, জোনাকি সবকিছুও তোমার। যা তোমার তাকে শুধু শুধু খাঁচায় কিংবা স্বচ্ছ কাঁচের জারে বন্দি করতে যাবে কেন? আকাশে ডানা মেলা পাখী আর খাঁচায় বন্দি পাখীর আনন্দ কি কখনো একই রকম হতে পারে? ফুলের বুকে প্রজাপতি আর তোমার দুই আঙ্গুলের মাঝে ছটফট করতে থাকা প্রজাপতি সৌন্দর্য কি এক? আমরা জানি এক না। অনেক পার্থক্য বিদ্যমান দু’য়ের মাঝে। কিন্তু তবুও শুধু নিজের করে পাবার লোভে আমরা কোন কিছুকে তার স্বকীয়তা থেকে আলাদা করতে দ্বীধা করি না। আমাদের জীবনের সম্পর্কের বন্ধনগুলোও কিন্তু এমনই। নিজের করে পেতে গিয়ে, নিজের মনের মত করে চাইতে গিয়ে আমরা সম্পর্কগুলোর প্রকৃত সৌন্দর্য ও আনন্দানুভূতি হারিয়ে ফেলি।
আমিও কি এমনটা করছি আপি?
মারওয়া হেসে বলল, আমার কাছে অভিমানে সবচেয়ে খারাপ দিক কি মনেহয় জানো? অভিমানের ভেতর সুপ্ত অবস্থায় থাকে জেদ। সেই জেদ মনে একধরণের প্রতিযোগী মনোভাবের জন্ম দেয়। মানে হচ্ছে, অপর পক্ষকেই আগে নিজের ভুল বুঝে সরি বলতে হবে। আমি কেন আগে যাবো? তাকেই আগে আসতে হবে! এই যে একটা হার-জিতের মনোবাসনা তৈরি হয়! এটাই আসলে যত সমস্যার মূলে। আমাকেই কেন সবসময় বুঝতে হবে? আমাকেই কেন ত্যাগ স্বীকার করতে হবে? সবসময় কি আমিই ছাড় দিয়ে যাবো? আমার আবেগই কেন সবসময় এমন মূল্যহীন থেকে যাবে? ইত্যাদি আরো নানা প্রশ্নের উদ্রেক ঘটে অভিমানী মনে! অভিমান মনকে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় জমিয়ে দেয়। সমস্যা হচ্ছে, সেই বরফকে গলানোর মত সঠিক উষ্ণতা বেশির ভাগ সময়ই অপর পক্ষ দিতে ব্যর্থ হয়। যেহেতু অপর পক্ষের জানা থাকা না মনের ঠিক কতটা তাপমাত্রা প্রয়োজন। মনকে তাই কখনোই বরফ হতে দিও না। তো কি হয়েছে স্বামী কথা দিয়ে কথা রাখতে পারেনি?! চোখ পাকিয়ে কঠিন করে একটা ধমক এবং সাথে পরবর্তীতে এমন করলে শাস্তি দেয়া হবে সেই থ্রেট দিয়ে দুষ্টুমি করেই তো মিটিয়ে দেয়া সম্ভব ঘটনাটি। আমার এক যুগের দাম্পত্য অভিজ্ঞতা বলে যে, ভালোবাসার চেয়েও পার্টনার আমার ব্যর্থতা, অপারগতা, অসহায়ত্ব বোঝে, প্রতিকূল পরিবেশে আমাকে সাপোর্ট করে। এটা অনেক বেশি প্রভাব ও শ্রদ্ধাবোধের জন্ম দেয় তার মনে অপর পার্টনারের প্রতি।
আমি বুঝতে পেরেছি আপি।
মারওয়া হেসে বলল, না তুমি এখনো বুঝতে পারোনি। এত দ্রুত আসলে বোঝার দরকারও নেই। তবে প্রথম যে জিনিসটা তোমাকে বুঝতে হবে সেটা হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর ভিন্ন গ্রহ থেকে আসা কোন সম্পর্কের নাম নয়। আমাদের জীবনে বিদ্যমান অন্যান্য সম্পর্কের মতই এটি আরেকটি সম্পর্ক। আমার কথাই যদি বলি। এমন কতবার হয়েছে বাবা কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবার কথা বলে নিয়ে যাননি। ভাইয়ারা পছন্দের মূল্য না দিয়ে জোড় করে অপছন্দনীয় কিছু চাপিয়ে দিয়েছেন। বোনেরা নষ্ট করে ফেলেছে খুব প্রিয় কিছু। মামণি অকারণেই বকাঝকা করেছেন। সেসব কি মেনে নেইনি আমি? ভুলে যাইনি কি? ছেড়ে দিয়েছি কি তাদেরকে অন্যায় আচরণের জন্য? এর কারণ কি বাবা-মা-ভাই-বোনকে ডিভোর্স দেয়া যায় না এটা? নাকি অকৃত্রিম ভালোবাসা? তাহলে স্বামীর ভুল কথা বা ভুল কাজ মেনে নিতে সমস্যা কোথায়? যেখানে সেই মানুষটাকে জড়িয়েই আমার জীবনের সবকিছু। নাকি ছেড়ে দেয়ার অপশন থাকার কারণেই এই সম্পর্কটির ক্ষেত্রে আমাদের মন ত্যাগ স্বীকার করতে এত বেশি কার্পণ্য করে? এটাই আসলে ফ্যাক্ট বুঝলে। জীবনের অংশ করে নিতে পারি না বলেই ছোট ছোট কথা, কাজকে ইস্যু করে একে অন্যেকে জীবন থেকে বের করে দিতে পারি। তাই এটা বোঝার চেষ্টা করো তোমার স্বামী তোমার জীবনের জন্য কতটা জরুরি। এই বিষয়টা বুঝতে পারলেই বাকি সবকিছু বোঝাটা তোমার জন্য সহজ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
আফরা হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ আপি আমি এখন থেকে এভাবেই ভাবতে চেষ্টা করবো। অভিমানের অনলে নিজেদের সম্পর্ককে আর কখনোই জ্বালাবো না। বরং যখনই কোন কিছু আমাদের মাঝে সমস্যার উদ্রেক করতে চেষ্টা করবে, আমরা দুজন মিলে সেটা নিয়ে মন খুলে কথা বলবো। এবং দুজন মিলে সেটার সমাধান করার চেষ্টা করবো।
মারওয়া হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ। এখন চলো আমরা রান্নায় মনোযোগ দেই।

লিখেছেন- আফরোজা হাসান

 

ছায়াদানকারী বট বৃক্ষ

ছায়াদানকারী বট বৃক্ষ


শামছুন নাহার মলি


২০১২ সালে প্রথম যে বার দেশ ছাড়লাম।আব্বা আমার জিপি নাম্বারে কল দিতেই থাকতেন।দুঃক্ষিত আপনার কাঙ্খিত নাম্বারে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা,অনুগ্রহপূর্বক আরেক টু পর আবার ডায়াল করুন। আব্বা আরেকটু পর আবার ডায়াল করছিলেন।বারবার,যদি মলির ফোনে কল যায়।এখন কি মলি আকাশে?নেটওয়ার্কেরর বাইরে?আবার কল দেয়।কল আসলে অন্যদের বলে মলিকে কল দিচ্ছি,একজন মেয়ে বলে একটুপর আবার কল করুন।এতবার কল দিচ্ছি মলি তো ধরেনা। অনেক পরে আব্বাকে বোঝানো গেছিলো মলি এখন নেটওয়ার্কেরর বাইরে।
ফিনল্যান্ডে আসার পর বুঝলাম আব্বা কতটা ভালবাসে,আমার একাকিত্বে কতটা ভয় পায়।প্রতিদিন কল দিলে আব্বা কথা বলতেন।আমি কি বলবো, কেমন আছেন আব্বা?ব্যাথা কমেছে?গরম কেমন?
এর পর আর কিছু বলার আসতো না।
আব্বার প্রশ্নের পর্ব শুরু।বাছা,ওখানে কি কি পাওয়া যায়?কি মাছ খাও?স্যালমন ফিস?স্যালমনের মাথা দিয়ে মুড়ো ঘন্ট করো খুব ভাল লাগে।লন্ডনে গিয়ে তোমার ভাইয়ার বাসায় খেতাম।বাছা বাংলাদেশি সবজি,ফল পাও তো?আরো কত কি?
সাম্মান কে পেটে নিয়ে দেশে গেলাম ৫ মাসের জন্য,একটা সেমিস্টার করবো।আগে আব্বাকে ফল কেটে আমি খাওয়াতাম।এবার অবাক করে দিয়ে আব্বা নিজেই আমাকে এলাকার মিষ্টি পেয়ারা ভাত খাওয়ার পর ঔষধের মত নিয়ম করে কেটে খাওয়াতেন। কারণ ভাত খাওয়ার পর পেয়ারা না খেলে মলির বমি বমি লাগতো।
দেশি ফল কেটে দিতেন পাশে বসিয়ে।আমার কি যে অস্বস্থি লাগতো।তারা নিজেই অসুস্থ।আমি তাদের সেবা করার চান্স পাইনি সেবার।৭ মাসে চলে আসবো ঢাকা থেকে।আব্বা আম্মা নাতির জন্য কাঁথা,আমার জন্য খাবার নিয়ে মেজ আপুকে নিয়ে রওনা হবেন ঢাকার উদ্দেশ্যে।দেশে তখন ভয়ংকর পরিস্থিতি।পরদিন সকালে সারা দেশে হরতাল।রাতের গাড়িতে সাতক্ষীরা থেকে রওনা হলে সকালে গাবতলি থেকে মীরহাজির বাগ যাওয়াটা কঠিন হবে।সিএনজি,বাসে আগুন জ্বালিয়ে দিতো,গুলি,এ্যারেস্ট ও তুমুল ভাবে।
আমি কাঁদলাম প্লিজ আসবেন না আব্বা ঢাকায়,এই পরিস্থিতিতে আপনারা ঢাকায় আসলে বিপদ।আমরা টেনশনে মরে যাবো।আব্বা আম্মা টিকেট নিয়ে গাড়ীতে উঠবে,আমি আর ছোট ভাইয়া হাতে পায়ে ধরে বল্লাম আব্বা বাড়িতে নিরাপদ এ থাকলে তাতেই আমাদের শান্তি।দেশের এ পরিস্থিতি তে বের হয়েন না।আম্মা বলে,মলি পরীক্ষা দিয়ে আর বাড়ি এলো না।আমি একটু না দেখে অসুস্থ মেয়েকে কিভাবে যেতে দিই।
আমার মণ কে পাষাণ বানিয়ে বল্লাম,আম্মা বাড়ি ফিরে যাও,আমার জন্য তোমাদের কিছু হয়ে গেলে সারা জীবনেও শান্তনা খুঁজে পাবোনা।আব্বা আম্মা বল্লেন এত টাকা দিয়ে টিকেট কাটলাম।বল্লাম জীবনের দাম আরো বেশি।কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে গেলেন।আমি ফিনল্যান্ডে আসার পর ডিলিভারি রুমে যাওয়ার পরও আব্বার সাথে কথা বলা লাগছে।
সাম্মান হলো,আব্বা সহ সবাই কি খুশি।আলহামদুলিল্লাহ্‌।আব্বার আর কথা বলার তোড়জোড় নাই।দু তিন দিন হয়ে গেলো।আম্মাকে বল্লাম আব্বা কই?বলেন,আছে।এখন তোমার একটা খেলার সাথি হয়েছে,ব্যস্ত থাকার সম্পদ হয়েছে তাই তোমার আব্বা নিশ্চিন্তে আছে তোমাকে নিয়ে।বাবা নামের মানুষ গুলো আসলেই অন্যরকম।আল্লাহ সকল মাকে নেক হায়াত দিন।সন্তানদের ছায়াদান কারী বটবৃক্ষ গুলো ভালো থাকুন দুনিয়া ও আখিরাতে।আমিন।