banner

মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: November 15, 2024

 

মহিমান্বিত লাইলাতুল কদর

মহিমান্বিত লাইলাতুল কদর


ড. মেহরান মাহমুদ


মুসলিম জীবনে লাইলাতুল কদর অতিপুণ্যময় ও অনন্য এক রজনী। মর্যাদাময় এ রাতটিতে রয়েছে শান্তি, সান্ত¡না এবং সার্বিক কল্যাণ। এ রজনী ভাস্বর হয়ে আছে পবিত্র কুরআন নাজিলের মহিমায়, ভাস্বর হয়ে থাকবে স্বল্প সময়ে অধিক পুণ্য লাভের নিশ্চয়তায়। এ রাতের সম্মানেই পবিত্র কুরআনে ‘সূরা কদর’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা অবতীর্ণ হয়েছে।

লাইলাতুল কদরের অর্থ

‘লাইলাতুন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে রাত। ‘কদর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে পরিমাপ, পরিমাণ, নির্ধারণ ও ভাগ্য নিরূপণ। ‘কদর’ থেকেই ‘তাকদির’ শব্দ। অবশ্য কদর শব্দের অন্য অর্থ সম্মান, গৌরব, মর্যাদা ও মহিমা। সুতরাং ‘লাইলাতুল কদর’ মহিমান্বিত রজনী, সম্মানিত রাত্রি, ভাগ্য নিরূপণ, বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ রজনী অর্থে সাধারণত ব্যবহৃত হয়ে থাকে। হজরত আবুবকর আররাক রা: বর্ণনা করেন, এ রাতকে এ জন্য ‘লাইলাতুল কদর’ বলা হয় যে, যে ব্যক্তি ইতঃপূর্বে কোনো ইবাদত বন্দেগি করে ‘কদর’ বা সম্মানের অধিকারী হয়নি, সে ব্যক্তি এ রাতে তওবা ইস্তিগফার করে ইবাদত-বন্দেগি করলে ‘কদর’ বা সম্মানের অধিকারী হতে পারবে।

লাইলাতুল কদরের উৎপত্তি

ইবনে জারির র.-এর বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সা: একবার ইসরাঈল গোত্রের জনৈক ইবাদতকারী সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তিনি একাধারে এক হাজার মাস যাবত সমস্ত রাত্রি ইবাদতে মশগুল থাকতেন এবং সকাল হলেই জেহাদে বের হয়ে যেতেন। মুসলমানরা এ কথা শুনে বিস্মিত হন। রাসূলুল্লাহ সা: তার উম্মতের জন্য শুধু এক রাত্রির ইবাদতকেই সে ইবাদাতকারীর এক হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করেছেন। (তাফসিরে মাজহারি)

কদর কোন রজনীতে

পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট বর্ণনায় লাইলাতুল কদর রমজান মাসেই। তবে কবে? এ নিয়ে আলেমদের একাধিক মতামত পরিলক্ষিত হয়। তাফসিরে মাজহারির বর্ণনা মতে, ‘এ রাত রমজান মাসের শেষ ১০ দিনের মধ্যে আসে। কিন্তু এরও কোনো নির্দিষ্ট তারিখ নেই। সহিহ হাদিস দৃষ্টে এই ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে ‘লাইলাতুল কদর’ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মহানবী সা: বলেছেন, ‘লাইলাতুল কদরকে রমজানের শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে তালাশ করো।’ (বুখারি)
মহান আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের রমজনর শেষ ১০ দিন অধিক ইবাদত করার প্রতি আকৃষ্ট করার জন্যই মূলত লাইলাতুল কদরকে প্রচ্ছন্ন রেখেছেন। তারপরও অধিক সম্ভাব্য রাত হিসেবে ২৭তম রাতকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: গণিত সূত্র দিয়ে এর অধিক সম্ভাব্যতা প্রমাণ করেছেন। যেমন ‘সূরা কদর’-এ ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দটি তিনবার উল্লেখ আছে। আরবি বর্ণমালা অনুযায়ী ‘লাইলাতুল কদর’ লিখতে ৯টি অক্ষরের প্রয়োজন হয়। ৩ কে ৯-এর সাথে গুণ করলে গুণফল ২৭ হয়। উপর্যুক্ত হিসেবে ‘লাইলাতুল কদর’ রমজানের ২৭ তারিখ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। (তাফসিরে রুহুল বয়ান)

লাইলাতুল কদরের ইবাদাত

রাসূলুল্লাহ সা: যেভাবে এ রাত কাটাতেন এর পূর্ণ অনুসরণ করাই হবে আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে আমাদের নি¤œ বর্ণিত কাজগুলো করা আবশ্যক।
নিজে রাত জেগে ইবাদত করা এবং পরিবারের সদস্য ও অধীনস্থদের ইবাদতে উদ্বুদ্ধ করা।
তারাবিহের সালাত আদায়ের পর রাতে তাহাজ্জুদ ও সালাতুত তাসবিহ আদায় করা।
নফল নামাজের সিজদার মধ্যে তাসবিহ পাঠ শেষে দোয়া করা। কেননা, সেজদাবনত অবস্থায় মানুষ তার রবের অতি নিকটে চলে যায়। ফলে তখন দোয়া কবুল হয়।
নিজের কৃত পাপরাশির জন্য বেশি বেশি তওবা করা। ভবিষ্যতে যাতে আর কোনো পাপ না হয় তার জন্য দৃঢ়সঙ্কল্প করা।
অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করা। উত্তম হবে অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ কুরআন অধ্যায়ন করা।
সাধ্য অনুযায়ী জিকির আজকার ও তসবিহ তাহলিল আদায় করা।
কবুল হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে নিজ, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, জীবিত-মৃত ব্যক্তিদের জন্য সর্বপরি দেশ ও বিশ্ববাসীর শান্তি-সমৃদ্ধি কামনা করে একাগ্রচিত্তে দোয়া করা। বিশেষ করে মহানবী সা:-এর শিখানো এই দু’আটি বেশি বেশি করে পড়া, ‘হে আল্লাহ তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে তুমি ভালোবাস, অতএব আমাকে ক্ষমা করে দাও।’
লাইলাতুল কদরের ফজিলত : অগণিত ফজিলতে পূর্ণ এ রাতটির কতিপয় ফজিলত নিম্নে বর্ণনা করা হলো-

এ রাতের ফজিলত বর্ণনা

এ রাতের ফজিলত বর্ণনা করে এ রাতেই একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা অবতীর্ণ হয়েছে, যার নাম সূরাতুল কদর। এ এক রজনীর ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এ রাতে পৃথিবীতে অসংখ্য ফেরেশতা নেমে আসেন এবং তারা তখন দুনিয়ায় কল্যাণ, বরকত ও রহমত বর্ষণ করতে থাকেন। এ রাতে ইবাদতে লিপ্ত বান্দাদেরকে ফেরেশতারা জাহান্নামের আজাব থেকে মুক্তির বাণী শোনান।
এ রাতে নফল সালাত আদায় করলে মুমিনদের অতীতের সগিরা গুনাহগুলো মাফ করে দেয়া হয়।
মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াব লাভের আশায় কদরের রাতে নফল সালাত আদায় ও রাত জেগে ইবাদত করে আল্লাহ তার ইতঃপূর্বের যাবতীয় সগিরা গোনাহ ক্ষমা করে দেন’। (বুখারি, মুসলিম)।

এ রাতে তওবা কবুল করা হয়।

রাতটি চিহ্নিত করার কিছু আলামত 

এ রাতকে চিহ্নিত করার কিছু আলামত হাদিস শরিফে পাওয়া যায়। যেমন রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না। নাতিশীতোষ্ণ হবে।
মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে। ইবাদাতে অধিক তৃপ্তি পাবে। বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে। হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে, যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো। (বুখারি, মুসলিম)
লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির উত্তম মাধ্যম : লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির সুবর্ণ সুযোগ হচ্ছে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা। মহানবী সা: প্রতি রমজানের শেষ ১০ দিন নিয়মিত ইতিকাফ করতেন।

মুমিন বান্দাদের জন্য লাইলাতুল কদর অত্যন্ত মঙ্গলময় এবং বরকতময় রাত। এক রাত ইবাদত করে এক হাজার মাসেরও অধিক সময়ের ইবাদতের সাওয়াব পাওয়া যাবে, এর চেয়ে বড় সুবর্ণ সুযোগ আর কী হতে পারে? এ রাতের ইবাদত হতে বিমুখ ব্যক্তি সত্যিই হতভাগা। মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শবে কদর থেকে বঞ্চিত হয়েছে সে ব্যক্তি সর্ব প্রকার মঙ্গল থেকেই বঞ্চিত হলো। আর যে বঞ্চিত হলো প্রকৃতপক্ষে সে সব কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো’ (নাসাঈ)।
লেখক : গবেষক
সুত্রঃ নয়া দিগন্ত।

 

বয়স হার মেনেছে বৃদ্ধা মালঞ্চির জীবন সংগ্রামের কাছে


নারী সংবাদ


বর্তমানে বাংলাদেশের লোক সংখ্যা সাড়ে ষোল কোটির উপড়ে। যার মধ্যে ৬ দশমিক শতাংশের বয়স ৬০ বছরের ওপড়ে। বাংলাদেশে একজন ব্যক্তি যখন ৫৫ কিংবা ৫৭ বছরে পা রাখেন তখন তাঁকে সাধারণত প্রবীণ কিংবা বৃদ্ধ হিসেবে ধরে নেয়া হয়। কর্মক্ষম থাকলেও তাকে চাকরি এবং কাজ থেকে অব্যাহত দেয়া হয়। অনেক সময়ই তিনি কাজ করতে চাইলেও তাকে কাজে নেয়া হয় না। যে কারণে বৃদ্ধ বয়সে একজন মানুষের ভরসার পাত্র হয় তার সন্তান। তবে এ ক্ষেত্রে সমাজে গরীব মানুষের বেলায় ঘটে ভিন্ন কিছু। গরীবদের বেলায় কিছু কিছু সন্তানের নিষ্ঠুরতার কাছে মানবিকতা হার মানে। হার মানে অনেক বৃদ্ধ মা-বাবা। কারও নতুন ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রম। গরীবদের বেলায় কারও ঠাঁই মেলে রাস্তার ফুটপাতে। আবার কেহ কেহ সন্তানের ধিক্কার এবং নিষ্ঠুরতার কাছে না হেরে নিজেরাই নিজেদের বাকি জীবনটাকে নতুনভাবে গোছাতে শুরু করে। কেহ কেহ সফল হয়। তাদেরই একজন ৬৬ বছর বয়সী মালঞ্চি । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মালঞ্চি বেশ পরিচিত মুখ।
চারুকলা অনুষদের সামনে একটি বড় কাঠের বাক্সে চুড়ি নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় তাকে। প্রায় ১৮ বছর ধরে চুড়ির ব্যবসা করছেন মালঞ্চি। স্বামী, তিন ছেলে এবং দুই মেয়েকে নিয়ে ছিল মালঞ্চির সংসার। অভাব অনটনের কারণে তিন ছেলেকে অষ্টম শ্রেণীর পর আর পড়াতে পারেননি তিনি। সংসারের টানাপোড়নের মধ্যেই তিনি তার ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। এরপর মালঞ্চি এবং তার স্বামীর জীবন অনাকাঙ্খিত মোড় নেয়। তাদের ছেলে-মেয়ে তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। মালঞ্চি এবং তার স্বামীকে দেখাশোনা করতে চাইতো না তারা। তখন মালঞ্চি এবং তার স্বামীকে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার হতে হয়। এই বুড়ো-বুড়ি আলাদা একটি বস্তিতে থাকা শুরু করল। হাতে যে শেষ সম্বল নিয়ে তারা বের হয়েছিলেন তাও শেষ হবার পথে। পূর্ব থেকেই মালঞ্চির সংসারে অভাব-অনটন ছিল। তবে বুড়ো বয়সে সন্তানের সেবা পাবেন সেই আশায় ছিলেন তারা। তাদের আশা ছিল, ‘আমগো ছাওয়াল এই বুড়া-বুড়ীরে দেখব। জীবনে বড় কিছু হইব’। কিন্তু এই আশা যখন ভেঙ্গে গেল তখন তারা চোখের সামনে সরষে ফুল দেখতে লাগলেন। পরবর্তীতে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘আবার সংসারের হাল ধরন লাগব। এমনে বয়সের দোহাই দিয়া বইসা থাকলে চলবো না। আল্লাহ্ দিলে অহনও শরীরে যে শক্তি আছে কাজ কাম কইরা খাইতে পারমু’। চুড়ির ব্যবসা শুরু করার নিদ্ধান্ত নিলেন মালঞ্চি। কিন্তু তাদের এই সিদ্ধান্তে প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়ায় মূলধনের অভাব। তিনি বললেন, ‘ঐ সময় খাওনের পর্যন্ত টেকা আছিল না। কিন্তু একটা কাজ শুরু করন লাগব। আমার জামাই(স্বামী)তখন রিক্সা চালাইত। কিন্তু বুড়া মানুষটার কষ্ট বেশি হইত। বেশি একটা আয়-রোজগারও হইত না। পরে আল্লাহর নাম নিয়া নামলাম এই ব্যবসায়ে। মাইনষের থেইক্কা সাত হাজার টেকা ধার নিয়া শুরু করছিলাম’।
ব্যবসায়ী হিসেবে মালঞ্চিকে বেশ দূরদর্শী বলা যেতে পারে। তিনি ব্যবসায়ের জন্য এমন স্থান বেছে নিলেন যেখানে হরহামেশা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কিশোরীদের আনাগোনা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন হওয়ায় বেচা-কেনাও ভাল হয়। এখানে কোন প্রকার সমস্যারও সমুখীন হতে হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এহানের পোলাপানগুলাই আমার মাইয়া, হ্যারাই আমার পোলা। আমার কোন সমস্যা হইলে এরাই আমার দেখভাল করে। এই শীতে আমি যহন কম্বল চাইছি তহনই দিছে। এত বছর হইয়া গেলো এরা কেউ আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেনাই।’ তিনি ৪০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০ টাকা দামের চুরি বিক্রি করেন। তাঁর দৈনিক এক থেকে দুই হাজার টাকা আয় হয়। প্রথম দুই বছর কোন লাভের মুখ দেখতে পাননি মালঞ্চি। তিনি তার ব্যবসার মালামাল আনতেন চকবাজার থেকে বাকিতে। মাস শেষে যে আয় হত তা পাওনা পরিশোধ করতেই ফুঁড়িয়ে যেত। তবে পরবর্তীতে মালঞ্চি তার দক্ষতা এবং একাগ্রতার মাধ্যমে সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। বর্তমানে তার এই ব্যবসা থেকে যা লাভ হয় তা দিয়ে এই বুড়ো-বুড়ীর সংসার চলছে। মালঞ্চির বয়স প্রায় ৬৬। এই বয়সেও তিনি যেভাবে এই ব্যবসা অকপটে চালিয়ে যাচ্ছেন তা আমাদের সমাজের মানুষের জন্য একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি প্রমাণ করেছেন বয়স তো একটি সংখ্যা মাত্র। মনোবল থকালে একটি মানুষের পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব।
কেবলমাত্র মালঞ্চি নন, আমাদের দেশে অনেক গরীব মানুষ আছেন যারা পরের কাছে হাত না পেতে পরিশ্রম করে নিজেদের সংসার চালান। এমন কাজ সত্যিই অনুকরণীয়।

সুত্রঃ (আবিদা হক লোরা) বাস