উপবাসী ভোজন
ফাতিমা মারিয়াম
বাদল অনেকদিন পর চাচাতো বোন কেয়া আপার বাসায় এসেছে। ছোট বাচ্চারা মামাকে কাছে পেয়ে ভীষণ খুশি।মামার সাথে কিছুক্ষণ খেলা করার পর তারা নিজেদের রুমে চলে গেল। এবার কেয়া আপা এসে বাদলের সাথে গল্প শুরু করল। কথার এক পর্যায়ে কেয়া বাদলকে বলল-‘আম খাবি বাদল? তোর দুলাভাই রাজশাহী থেকে আম আনিয়েছে। একেবারে বাগান থেকে আনা, ফর্মালিন মুক্ত। কাল পাটিসাপটা পিঠা বানিয়েছিলাম, ফ্রিজে আছে। দিব তোকে?’
-‘আপা কী বলছ? আমি রোজা রেখেছি!’
-বাহ! ভালো, তুই তাহলে এখন রোজা রাখিস?
-হুমমম…আমি এখন বড় হয়ে গেছি।
এমন সময় পাশের বাসার ভদ্রমহিলা আসলেন। তিনি আসার পর বাদল উঠে অন্য রুমে গেল। উনি কিছুক্ষণ গল্প করে চলে যাওয়ার পর কেয়া আপা বাদলের কাছে এসে বসলেন। ‘আর বলিস না ভাই, এদের নিয়ে হয়েছে জ্বালা। পাশের বাসার ভাবী আসলেন না? উনি এসেই শুরু করলেন উনার ঈদের শাড়ির বাজেট কত? ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোন মার্কেট থেকে শপিং করবেন? উনার স্বামী উনাকে কত টাকা দিয়েছেন কেনাকাটার জন্য? এসব হাবিজাবি। আরে বাপু, আমরাও তো শপিং করি এইভাবে তো মানুষকে বলে বেড়াই না…হুঁহ!
বাদল মাথা নাড়িয়ে বলল- আপা কিছু মানুষের কাজই হল নিজেকে জাহির করা। এদের থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখাই ভালো।
– হুম ঠিক বলেছিস! এখন বল তোরা বাসার সবাই কেমন আছিস? বাবুলের বউ কেমন? সবার সাথে মানিয়ে চলে?
বাবুল হল বাদলের বড় ভাই। কয়েকমাস আগে বিয়ে হয়েছে।
-আর কি বলব আপা! ভাবী সংসারের কোন কাজই পারেনা। আম্মাকেই সব কিছু করতে হয়! ভাবীকে কিছু কাজ করতে বললেই সে আম্মাকে এসে বলবে আম্মা আপনি দেখিয়ে দেন। আরে! এত বড় মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে এসেছে কোন কাজ না শিখেই! আম্মার হয়েছে যত জ্বালা!
-হুম তুই ঠিকই বলেছিস। আমাদের পরিবারের বউগুলি একটাও ভালো পড়েনি। আমাদের মইন কে তো ওর বউ ভেড়া বানিয়ে রেখেছে। বউয়ের কথায় উঠে বসে।
– তারপর দেখনা আপু ভাবীর বিয়ের পর এইটা প্রথম রমজান। ভাবীর বাবার বাড়ি থেকে এখনও আমাদের বাসায় ইফতারি পাঠায়নি।
………
এসব কথোপকথন এভাবেই দীর্ঘায়িত হতে থাকে; আমার, আপনার এবং আমাদের সবার। এখানে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বাদল কিন্তু বোনের আহবানে কিছুই খায়নি। কারণ সে রোজা রেখেছে। কিন্তু কথার এক পর্যায়ে যখনই অন্যের সমালোচনা বা গীবত চলে এলো তখনই তারা দুজন একে অন্যকে উৎসাহিত করে যায়। এভাবেই আমরা আমাদের সিয়ামের মূল শিক্ষা থেকে দূরে চলে যাই। খাদ্যপানীয় গ্রহণ না করেও নিজেদের সিয়ামকে শুধুমাত্র উপবাসে পরিণত করে দিই।
অথচ আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত হাদিসে আমরা জানি যে আল্লাহর রাসুল ﷺ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি (রোযা রাখার পরও) মিথ্যা বলা ও খারাপ কাজ করা থেকে বিরত থাকে না তার পানাহার ত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।’ (বুখারী ও মুসলিম)
কিন্তু আমাদের বাস্তব জীবনে এর অনুশীলন আমরা করিনা। এই রোজার দিনে কেউ এক প্লেট সুস্বাদু খাবার দিলে সেটা এড়িয়ে যেতে পারলেও এক ঝুড়ি মন্দ কথা সানন্দে গ্রহণ করি এবং তাকেও এক ঝুড়ি বা তারচেয়েও বেশি উপহার দিই।
অথচ সূরা আল হুজুরাতে আল্লাহ গীবতকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। ‘হে ঈমানদারগণ, বেশী ধারণা ও অনুমান করা থেকে বিরত থাকো কারণ কোন কোন ধারণা ও অনুমান গোনাহ। দোষ অন্বেষণ করো না। আর তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত না করে। এমন কেউ কি তোমাদের মধ্যে আছে, যে তার নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? দেখো, তা খেতে তোমাদের ঘৃণা হয়। আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ অধিক পরিমাণে তাওবা কবুলকারী এবং দয়ালু।’ [আল হুজুরাত-আয়াত নং-১২]
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করে আমাদের সব ইবাদাত কবুল করে নিন। আমীন।