করোনাভাইরাস মোকাবেলায় হৃদরোগীরা মেনে চলুন কিছু পরামর্শ
ডা. মারুফ রায়হান খান
করোনা’ শব্দটির চেয়ে বড় আতঙ্কের নাম পৃথিবীতে এখন আর কিছু নেই। বিশ্ব এমন মারাত্মক মহামারী খুব কমই দেখেছে৷ ইতিমধ্যে লাখ ছাড়িয়েছে মৃতের সংখ্যা। আমাদের দেশে হু হু করে বেড়ে চলেছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। কোভিড-১৯ রোগটি যে কারোরই হতে পারে। তবে কিছু কিছু রোগীদের আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি রয়েই যায় এবং আক্রান্ত হলে জটিলতার আশংকা বেশি থাকে। যেমন :
১. হৃদরোগ
২. বয়স ৭০ বছরের বেশি
৩. উচ্চ রক্তচাপ
৪. গর্ভকালীন সময়
৫. ডায়াবেটিস
৬. ফুসফুসের রোগ
৭. দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ
৮. স্ট্রোক
৯. ধূমপায়ী
চীনের গবেষণায় প্রমাণিত কোভিড-১৯-এর সঙ্গে যাদের আগে থেকে হার্টের রোগ ছিল তাদের মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি। তবে আশার কথা হচ্ছে বেশিরভাগ মানুষই করোনা রোগ থেকে সুস্থ হয়েই বাড়ি ফেরেন। আতঙ্কিত না হয়ে এ সময়ে হৃদরোগীরা কিছু পরামর্শ মেনে চললে সুফল পাবেন।
১. অবশ্যই ঘরে থাকুন। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কোনোভাবেই বাসার বাইরে যাবেন না। ওষুধপত্র বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের প্রয়োজনে অন্যদের সহায়তা নিন। যদি একান্তই বাইরে বের হতে হয় তবে অবশ্যই ভালোমানের মাস্ক পরে নিন।
২. চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তাই নতুন করে হৃদরোগের উপসর্গ যেমন : তীব্র বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড় জাতীয় সমস্যা না হলে চিকিৎসকের কাছে এসময়ে না যাওয়াই শ্রেয়। প্রয়োজনে চিকিৎসকের কাছে ফোনে/অনলাইনে পরামর্শ নিন। বেশিরভাগ চিকিৎসকই এখন তাদের ফোন নাম্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছেন।
৩. অন্তত ২০-৩০ সেকেণ্ড সময় নিয়ে হাত ধৌত করুন। এমনভাবে ধৌত করুন যেন সাবানের ফেনা দেখা যায়। প্রথমেই পানি দিয়ে হাত ভিজিয়ে নিন এবং হাতে সাবান মেখে নিন। দুহাতের তালু ভালোভাবে ঘষুন। প্রতিটি আঙুল ও দুআঙুলের মধ্যবর্তী স্থান ভালোভাবে ঘষুন। নখ ও হাতের তালু ভালোভাবে ঘষুন। হাতের পৃষ্ঠদেশ ও দুআঙুলের মধ্যবর্তী স্থান ভালোভাবে পরিষ্কার করুন। পরিষ্কার পানি দিয়ে হাত ধোয়ার পর টিস্যু বা পরিষ্কার তোয়ালে দিয়ে হাত মুছে ফেলুন।
৪. যেকোনো গণজমায়েত অবশ্যই পরিহার করুন। করমর্দন বা কোলাকুলি পরিহার করুন।
৫. চোখে, মুখে, নাকে যতো কম সম্ভব স্পর্শ করুন।
৬. হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলুন। হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় টিস্যু বা রুমাল চেপে ধরুন। নইলে কনুই দিয়ে চেপে ধরুন।
৭. হৃদরোগের চিকিৎসা সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি হয়। ওষুধ নিয়মিত না খেলে বা বন্ধ করে দিলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা থাকে। তাই পূর্বের ওষুধগুলো চালিয়ে যান। চিকিৎসকের অনুমতি ছাড়া ওষুধ বন্ধ করা যাবে না। তবে যদি কোনো রক্তপাত দেখা দেয় তখন এসপিরিন/ওয়ারফেরিন জাতীয় ওষুধ বন্ধ রেখে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
৮. অতিরিক্ত লবণ খাওয়া যাবে না। সেটা কাঁচা লবণ হোক বা ভাজা লবণ। চিনিযুক্ত খাবার, ডিমের কুসুম, কলিজা, মাছের ডিম, গরু-খাসির চর্বিযুক্ত মাংস, হাঁস-মুরগির চামড়া, হাড়ের মজ্জা, ঘি, ডালডা, মাখন, নারকেল জাতীয় খাবার কম খেতে হবে। যেসব শক্ত খাবার খেতে বেশি কষ্ট হয় সেসব খাবার না খাওয়াই ভালো।
৯. বেশি বেশি ফলমূল, শাকসবজি, সামুদ্রিক মাছ, ছোট মাছ, মাছের তেল, সানফ্লাওয়ার অয়েল ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
১০. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার বেশি খান। যেমন : লেবু, কমলা, জাম্বুরা, আমলকি, পেয়ারা ইত্যাদি।
১১. প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটাচলা/ব্যায়াম করতে হবে। প্রয়োজনে ছাদে হাঁটুন৷ বাসায় ব্যায়ামের জন্য একটা জায়গা আলাদা করে নেয়া যেতে পারে। তবে যতোটা হাঁটলে/ব্যায়াম করলে বুকে ব্যথা শুরু হয়ে যায় অতোটা হাঁটা/ব্যায়াম করা যাবে না। এ বিষয়টি সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখতে হবে।
১২. ধূমপান বন্ধ করতে হবে। এটি হৃদপিণ্ডের অত্যধিক ক্ষতি যেমন করে সেই সাথে করোনার ঝুঁকিও অনেক বাড়িয়ে দেয়।
১৩. মদ্যপান করা যাবে না।
১৪. বাসায় নিয়মিত রক্তচাপ মাপুন। ডায়াবেটিস থাকলে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়মিত চেক করুন এবং নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
১৫. শেষে যে পরামর্শটি না দিলেই নয়, যতো কম সম্ভব টেলিভিশনে/পত্রিকায়/সোশ্যাল মিডিয়ায় করোনার নিউজ আপডেট দেখুন। বেশি বেশি এসব সংবাদ শুনলে অতিরিক্ত উত্তেজনা এবং আতঙ্ক তৈরি হতে পারে। যা হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই সারাক্ষণ সংবাদ না দেখে সৃষ্টিশীল কাজে বা পরিবারের সাথে সময় ব্যয় করুন। গড়ে তুলতে পারেন নতুন কোনো ভালো অভ্যেস। প্রার্থনা বা মেডিটেশানে সময় দেওয়া যেতে পারে।
এই প্রতিকূল সময়ে ভালো থাকুক প্রতিটি হৃদরোগী। ভালো থাকুক প্রতিটি মানুষ।
লেখক: ডা. মারুফ রায়হান খান
হৃদরোগ বিষয়ে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ
মুল সুত্রঃ যুগান্তর।