banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 466 বার পঠিত

 

আমি কখনো ভালো মা হতে পারিনি 

আমি কখনো ভালো মা হতে পারিনি


নুর এ নাজনিন শামলিন


আমি কখনো ভালো মা হতে পারিনি, অন্য সব আদর্শ মায়েদের মতো জোর করে খুব সকালে বাচ্চাদের ঘুম থেকে টেনে তুলে স্কুলে পাঠায় নি। বরং উল্টো মনে হতো ঘুমিয়ে থাক, কিসের এত পড়ালেখা। অফিস যাওয়ার সময় খুব সংগোপনে রেডি হতাম যাতে ওদের ঘুম না ভাঙ্গে। আহারে ঘুমিয়ে থাক আমার সোনা বাচ্চা দুইটা, সারা জীবন ই তো পড়ে আছে কি হবে এত পড়ালেখা করে?ওরা যাতে আরাম করে ঘুমাতে পারে তাই আমি খুঁজে খুঁজে ডে শিফটের স্কুলগুলিতে ওদেরকে ভর্তি করেছি।

আমি ভালো মা হতে পারিনি কারণ আমি কোনদিন ওদের নিজ হাতেই স্কুলের ড্রেস পড়িয়ে আদর করে সঙ্গে করে স্কুলে নিতে পারেনি, সে সময় আমি থাকতাম অফিসে । প্রথম দু একদিন হয়তো স্কুলে বসিয়ে দিয়ে আমি চলে আসতাম।নূহা আমার মেয়ে, ছোটবেলা থেকেই সবকিছু যেন একটু বেশীই বুঝতো।ও যখন আমার হাতটা ছেড়ে দিত কেমন পিছন ফিরে তাকাতে তাকাতে স্কুলে ঢুকতো, কারণ ও জানতো অন্য সব মায়ের মতন ওর মা ওর জন্য স্কুলে বসে থাকবে না। অর্ণব আমার ছেলে, দুচোখ জলে টলটল করত আর কি আকুতি নিয়েই না বলত, আম্মু তুমি অফিস যেও না, আমার সাথে থাকো, ওর আকুতি আমার মন ছুঁয়ে যেত। মাঝে মাঝে চোখ মুছতে মুছতে অফিসে যেতাম।

আমি ভালো মা হতে পারিনি, অন্য সব মায়েদের মতো হোম ওয়ার্ক না করার জন্য কোন দিন বকা দেই নি। পড়া করতে না চাইলে বই খাতা বন্ধ করে দিয়ে বলেছি আর পড়তে হবে না অনেক হয়েছে। কোনদিন বাসার টিচারদের পিছনে লাগেনি,কত দিন কত ঘন্টা পড়িয়েছে তার হিসাব করিনি, বরং রিকোয়েস্ট করছি স্যার আমার বাচ্চাটা পড়তে না চাইলে জোর করবেন না, ও যাতে আনন্দ নিয়ে পড়ে, আপনি আপনার মত করে পড়াবেন। হ্যাঁ, আমি আমার মতো করে ওদের পরিয়েছি। আমার ছেলেটা খুবই ফাঁকিবাজ টাইপের। হুজুর আসলে প্রায়ই আমি দেখতাম হুজুরকে নিয়ে মোবাইলে গেম খেলছে মহানন্দে। হুজুর কে কখনো কিছু বলতে পারতাম না, মনে হতো থাকনা আমার বাচ্চাটা কি আনন্দ নিয়ে না খেলছে!!

আমি ভালো মা হতে পারিনি, পারিনি আমার বাচ্চাদের কোন একটি আনন্দের মুহূর্তে ওদের পাশে থেকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। আমার মেয়েটার যখন ফাইভে, এইটে বৃত্তির রেজাল্ট হয়, আমি হয়ত অফিসে অনলাইনে ওর রোল নাম্বার খুঁজছি, আমার মেয়েটা তখন বৃত্তি পাওয়ার আনন্দে একা একাই স্কুলের মাঠে ঘুরছে, কোন এক মায়ের কাছ থেকে মোবাইল চেয়ে ও আমাকে ফোন দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর বলছে জানো মা আমি না ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছি , মোবাইলের অপর প্রান্ত থেকে আমিও কাঁদচ্ছি গভীর আনন্দে কিন্তু ভালোবেসে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারিনি, পারিনি ওর ফুলা ফুলা গালে চুমু খেতে।

নূহার অভিমান ভরা কথা “আমি কোনোদিন কোনো ভালো রেজাল্টের পর তোমাকে জড়িয়ে ধরতে পারি নাই আম্মু, অপেক্ষা করতে হয়েছে কখন তুমি বাড়ি ফিরবে।” ভাবলাম এবার ক্ষ্যান্ত দেই।বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ, ওদের একটু সময় দেই। এই ভেবে চাকরি ছাড়া। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, ঠিক সেই সময় ধরা পড়ে আম্মার ক্যান্সার। আমি ছুটলাম আম্মার কাছে। আম্মার কাছ থেকে শুধু নিয়েছি কখনো কিছু দিতে পারি নাই। ভাবলাম এইতো সময় আমার সর্বোচ্চ দিয়ে আম্মার সেবা করব। নূহার ইন্টারমিডিয়েট, অর্নবের ক্লাস এইট খুব ইম্পর্টেন্ট সময়। আমি ভালো মা হতে পারি নাই কিন্তু আমার সন্তানরা, ওরা যেন আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। ওরা আমাকে অভয় দিলো, “আম্মু নান ভাই কে সময় দাও।” এমনও সময় গেছে ওদের এক গ্লাস হরলিক্স পর্যন্ত বানায় দিতে পারি নাই, ওদের পরীক্ষার সেন্টারে পর্যন্ত যেতে পারি নাই। আম্মার কেমো, অসুস্থ আম্মাকে নিয়ে দিনরাত আমি হসপিটালে, ওরা আমাকে নিরাশ করে নাই। নূহা ৯৩ পারসেন্ট মার্কস পেয়ে এইচএসসিতে গোল্ডেন আর অর্ণব ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়ে চমকে দিল আমাকে। আমি ভয়ে ছিলাম নূহা মেডিকেলে চান্স পাবে তো? নূহা বলল, ” আল্লাহ ভরসা’ ।ওর নান ভাইয়ের খুব ইচ্ছা ছিল নূহা ডাক্তার হবে। আম্মা মারা যাওয়ার কিছুদিন আগেই নূহার রেজাল্ট হল। নূহা ওর নান ভাই এর ইচ্ছা পূরণ করতে পেরেছিল, ও চান্স পেলো ঢাকায়।

আমি ভালো মা হতে পারি নাই আর এই জন্যই হয়তো ওরা ইন্ডিপেন্ডেন্ট। ওরা নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। ওরা প্রতিনিয়তই দেখেছে ওদের মা আর দশটা মায়ের মত না কি প্রচণ্ড পরিশ্রম ই না করতে পারে। অসম্ভব প্রাণশক্তিতে ভরা ওদের মা একজন স্বাবলম্বী নারী। আমার মেয়েটাও চায় ওর মায়ের মত প্রচন্ড আত্ম বিশ্বাসী, স্বাবলম্বী হতে। আমি ভালো মা হতে পারিনি কিন্তু ওদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিতে পেরেছি, কিভাবে আকাশ ছুঁতে হয় সে স্বপ্ন দেখাতে শিখিয়েছে আর সবশেষে ভালো বন্ধু হতে পেরেছি।

Facebook Comments