আবু হেনা মোস্তফা কামাল পিন্টু
কৃষ্ণচূড়া গাছ কতদিন বাঁচে? যতটা দিন তাতে কুঠারাঘাত না পড়ে? যে কিশোরী জীবন দেখেছে কৃষ্ণচূড়ার লালে, ফাগুন চিনেছে কৃষ্ণচূড়ার জাগরনে এবং সেই দেখা আর চেনা বয়ে চলেছে গোটা জীবনভর, কৃষ্ণচূড়ারা কি ঐ কিশোরীর জীবনেও বাঁচে না! জীবনকালব্যাপী বাঁচে না! কষ্টে উঁকি দেয়, সুখে দোলা দেয়, স্বস্তিতে দেয় উদাস! প্রথম যেদিন কৃষ্ণচূড়ার লালে অবাক হয় কিশোরী সেই মুহূর্তটি, সেই স্থানটিও কি বাঁচতে থাকে না কিশোরীর জীবনভর? হোক সে মাঠের ধার বদলে পাকা রাস্তা, হোক সে খালের উপরের সাঁকোটি আজ কালভার্টের চেহারায়, থাকলোই বা সে কিশোরী আজ শত ক্রোশ দূরের কংক্রিটের রাস্তার পাশে ন্যাড়া কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকিয়ে.. তবুও আমি নিশ্চিত, সে কিশোরী সেখানে থাকে না; যেখানে সে থাকছে।
এ তো এক অনাদিকালীন অদৃশ্য মনোদূর্ঘটনা। বারবার জিদ আর আবেগের সংঘর্ষ। কৃষ্ণচূড়া ভূপাতিত সেই কবে! জানতেও পারেনি কিশোরী। যখন কিশোরী সংসারে ঢোকার ক’বছর পর নিঃশ্বাস নিতে কৈশোরে ফিরেছিল..। বাস থেকে নেমে ভ্যানে করে পা ঝুলিয়ে মন দুলিয়ে বাড়িতে পৌঁছেই সোজা গিয়ে মাঠের ধারে, খালের পাড়ে। ঘাড় উঁচিয়ে, বাঁকিয়ে বিভিন্ন উপায়ে নোনতা স্বাদের হাহাকার আর ঘন নিঃশ্বাসের পতন নিয়েও খুঁজে কৃষ্ণচূড়াকে পায়নি। খুব মন খারাপ করে বাড়ি ফিরেছিল এই ভেবে যে, কিশোরীবেলাটা কি তবে তার সত্যিই হারিয়ে গেছে? প্রশ্নটা কাকে যে করতে পারা যাবে সে উত্তরও পায় না। বিষন্ন মনে ভাবে কালই শহরে ফিরে যাবে সে। সংসারে ঢুকে যাবে। তাহলে আর কোনো প্রশ্নই জন্মাবে না মাথায় মনে।
গ্রীষ্মের দুপুরে উঁচুতলার জানালার শার্সির ভেতর দিয়ে চোখ ছড়িয়ে দেবে দূরের কোনো শহুরে কৃষ্ণচূড়ায়; ধুলোয় যেখানে লাল কিছুটা বয়সী, ফিকে আর ক্লান্ত। উদাস হবে, আনমন হবে, বুকের ভেতর ঢেউ জাগলে কিছুটা কেঁদেও নেবে। কেউ তো আর দেখছে নাহ্! কিন্তু কোনদিন আর গ্রামে ফিরে গিয়ে কৈশোরের কৃষ্ণচূড়াটিকে খুঁজবে না। স্থিরসংকল্প করে। শুধু কোথায় কোন্ স্থানটিতে সে দাঁড়িয়ে ছিল সেই স্থানটিকে স্মরণের আবরণে যত্নে ঢেকে রাখবে। কোন্ টানে আর গ্রামে ফিরবে সে! কৈশোরের কৃষ্ণচূড়া, যে তাকে অপার মায়ায় রঙ চিনিয়েছিল, যে লালের সাথে মিলেমিশে নিজের রক্তলাল বয়ঃসন্ধি বুঝতে শিখিয়েছিল, সে কৃষ্ণচূড়া আজ আর নেই, সাথে তার কৈশোরবেলাটাও নেই। সব হারিয়ে গেছে!
তবুও কিশোরী কোনো এক অদৃশ্য সামর্থ্যে কল্পলোকে ভাসতে থাকে। ডোবে গহীন ঘোরের অতলে। মানষচোখে স্পষ্টতই দৃশ্যমান কৃষ্ণচূড়া। মূল থেকে শরীর বেয়ে প্রতিটি ডালপালা, পাতার শেষ প্রান্ত অবধি চাহনির ভ্রমন..। টের পেতে থাকে কিশোরী… বুকের ভেতর কালভার্টটি নিমিষেই বিলীন; দিব্যি সাঁকো পার হয়ে পৌঁছে গেছে কৈশোরে.. কৃষ্ণচূড়াটি জীবন্ত দাঁড়িয়ে আছে, আকাশে ছোপ ছোপ রক্ত বিছিয়ে, অসংখ্য আগুন ছেয়ে আছে আকাশ জুড়ে..। প্রতিটি কৃষ্ণচূড়া কিশোরীর দিকে হাত বাঁড়িয়ে কাছে ডাকছে আর বলে চলেছে, “ও মেয়ে, আলতা নেবে গো আলতা…”
ঝরঝর করে গড়িয়ে নামা নোনতা চোখের জল মুছতে আঁচল তোলে কিশোরী। ওদিকে উনুনে চাপানো প্রেশার কুকারের সিটি ক্রমাগত বেজেই চলেছে।