banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 892 বার পঠিত

 

আলো ও আলেয়ার গল্প


এম এস আবু নাছের


শাহবাগ সিগন্যাল পার হতেই কিছু বালক পড়িমরি করে উঠল বাসে। কারো পড়নে পাতলা জরাজীর্ণ জামা, কারও বা স্যান্ড্রো গেঞ্জি; কেউ লুঙ্গি পড়া আর কেউবা সস্তায় পাওয়া কোন প্যান্ট। চেহারার মলিনতা আর গালের ভগ্ন দশা আপনাকে জানিয়ে দিবে এরা এই ঢাকা শহরের পথশিশু। কার্টুনিস্ট রফিকুন্নবী যাদের নাম দিয়েছিলেন টোকাই। সারাদিন রাস্তায় পাওয়া বোতল, প্যাকেট কিংবা খাবার কুড়িয়ে জীবিকার সন্ধানে ব্যস্ত থাকার কারনেই হয়ত তাদের নাম হয়েছে টোকাই। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এদের ডাকতেন পথকলি বলে। হ্যাঁ, সত্যিই এরা পথকলি। পথের ধারে অজানা কোন পরিচয়ে হয়ত তাদের জন্ম; কিংবা দারিদ্রের নির্মম কষাঘাত আর ভাগ্যের পরিহাসে নাম পরিচয় হারিয়ে তাদের আজ পরিচয় পথকলি। হয় পথে ফোটে, নয় পথে ঝরে পরে।

বেশ কয়েকজন উঠার পর থেকেই বাসে নিজেদের মধ্যে নানারকম কথা বলছে, হাসাহাসি করছে আর আগামিকাল আবার কখন আসবে সেই কথাও জানান দিচ্ছে। আশেপাশের কিছু লোক এরই মাঝে তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ করে চলেছে। যেন দিনান্তে বাড়ি ফেরার সময় একটু বিনোদিত হচ্ছে। এদের মধ্যে একজন চুপচাপ এক পাশে সিটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তের-চৌদ্দ বছর বয়স হবে। বেশ গোলগাল চেহারা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। টানা চোখ দুটোতে যেন অদৃশ্য কোন মায়া লুকিয়ে আছে। সবাইকথা বলছে, কন্ট্রাক্টরের সাথে ভাড়া নিয়ে চিল্লাপাল্লা করছে আর সে একরকম নির্বাক। কন্ট্রাক্টর ভাড়া চাইতেই পকেট হাতড়িয়ে দুই টাকা বের করে দিল।

– কিরে, কনে যাবি?
– কমলাপুর।
– দুই টাকা দিছস ক্যান। ভাড়া দে। নাইলে নাইম্যা যা। উঠার সময় কইছি না, পুরা ভাড়া দেওন লাগবো।
কন্ট্রাক্টরের তর্জন গর্জনেও তার তেমন ভাবান্তর নেই। আস্তে করে বলল-

– আর টাকা নাই।
– টাকা নাই? না, শালা, ঘাড় ধরে নামায়া দিমু এখনি। বের কর টাকা।
– নাই, সত্যি কইতাছি টাকা নাই।

সিটে বসে চুপচাপ দেখছিল শফিক। সে তাকিয়ে আছে ছেলেটির দিকে। এত কড়া ভাবে বলার পরেও ছেলেটির মাঝে কোন ভাবান্তর নেই। কেমন উদাস ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চোখদুটো যেন কিছু কথা বলতে চাইছে কিন্তু কে শুনবে তার কথা? আর একটু হলে কেঁদে দিবে হয়ত। হাতে ছোট্ট এক পুটলি ধরে আছে। যা মনে হচ্ছে সত্যিই ওর কাছে কোন টাকা নেই। মানুষ তার মস্তিষ্ক নামক যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে কখনও মুখে আসা সত্যটি লুকিয়ে মিথ্যা বলতে পারে, কিন্তু একই সাথে শরীরের অন্যান্য অংগগুলো থেকে প্রকাশিত অভিব্যক্তি লুকোতে পারেনা। তার চোখ, তার কন্ঠের দৃঢতা, তার স্থিরতা সবকিছু মিলিয়ে সে যে মিথ্যা বলছেনা এ ব্যাপারে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আশেপাশের কয়েকজনের ভাড়া উঠিয়ে ফেরার সময় আবারও কন্ট্রাক্টর তার কাছে ভাড়া চাইল-

– কী রে, কী হইল? দে আরও তিন টাকা, বের কর।

এবারে সে সত্যিই নিরূপায়। কিছুই বলতে পারছেনা। রাতেরবেলা রাস্তায় নামিয়ে দিলে ছোট মানুষ যেতেও পারবেনা হয়ত। চোখেমুখে এক ভয় আর শঙ্কা দেখে শফিক ভাড়া মিটিয়ে ছেলেটিকে কাছে ডেকে নিল।

– তোমার নাম কি?
– আলো।
– কোথায় থাক?
– কমলাপুর বস্তিতে।
– কই গিয়েছিলে?
– শাহবাগ।
– কাজ কর?
– হুম
– কি কাজ?
– ফুল বেচি।
– কখন যাও, কোথায় পাও ফুল?
– সকালে যাই। আমাগো মহাজন আছে। প্রতিদিন অনেক ফুল আসে। পিছনে ঘুরে একে একে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে দিতে বলল- আমি, ভুট্টু, কামাল, আরিফ, জুঁই, হগগলেই ফুল বেচি। একেক দিন একেক জায়গায়। মহাজন ভাগ করে দেয়। যে বেশি ফুল বেচবার পারে হে বেশি ট্যাহা পায়। একশ গোলাপে দশ ট্যাহা, রজনীগন্ধার একশ ডাঁন্টা দশ ট্যাহা অন্য ফুলের থোকা বেচলে দুই ট্যাহা দেয়।
– আজ কত টাকা পেয়েছ?
– ষাট ট্যাহা।
– তাহলে যে বললে ভাড়া নাই।
– হ, সত্যিই ভাড়া নাই স্যার। ষাট ট্যাহার মধ্যে এক সের চাল লইছি, আর ছোট বোনের লাইগ্যা একটা জিলাপি, আর ঔষুধ।
– বোন আছে তোমার?
– হুম।
– কত বড়?
– এই এত বড়-

হাত তুলে ওর কোমরের কাছে পর্যন্ত দেখিয়ে দিল। যা বুঝলাম চার-পাঁচ বছর হবে বড়জোর।

– কে কে আছে তোমার বাড়িতে? কি হয়েছে তোমার বোনের।
– বাড়িত কেউ নাই। আমি আর আমার বোন থাকি।
– তোমার মা-বাবা?
– মা মইরা গেছে ছোট থাকতেই, বোনডা হওনের সময়। কপালপুড়ীডারে আমার কাছে থুইয়া মা চইল্যা গ্যাছে। আর বাপজান, সেই যে মর্জিনা চাচীর কাছে আমাগো থুইয়া গেছে আর ফিরেও আসেনি।

কথা বলতে বলতে কন্ঠ ভারী হয়ে এসেছে আলোর, মাথা হেলে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।

– তোমার বোনের নাম কী? কার কাছে রেখে এসেছো?
– বোনের নাম আলেয়া। সকালে আসার সময় মর্জিনা চাচীর কাছে থুইয়া আসি। রাত্তিরে যায়ে আমার সাথে থাকে। সাতদিন থ্যাইকা জ্বর হইছে। টাকা নেই, চাউল কিনমু না ঔষুধ? দোকান থাইক্যা কয়ডা বড়ি আইনা দিছিলাম কিন্তু খাইবার পারেনা। ভাল ঔষুধ কিনবারও পারিনাই। গরীবের আবার জ্বর কীসের? এমনিই ভাল হইয়া যাইব। মর্জিনা চাচী ভালমত তেল ডইল্যা দিলে জ্বর পালায় যাইব। ছোটবেলায় জ্বর হলে মা তেল ডইল্যা, মাথায় একটু ঘইষা দিত। আর কইত, বাজান তাড়াতাড়ি ঘুমায় যা। সকালে উঠে আর জ্বর থাকতনা। কিন্তু আলোর জ্বর ভাল হইতাছেনা। কয়দিন কিছুই খায়না। আজ তাই ভাল ঔষুধ লইছি।

– কাল রাইতে এক থাল ভাত আর ডাল ধার নিছিলাম মর্জিনা চাচীর কাছে।তাও খায় নাই। একবার জিলাপি খাইতে চাইছে। কন স্যার,কোত্থেকে দিমু জিলাপি? ভাতই হয়না আর মুখপুড়ী জিলাপি খাইবার চায়। কথাগুলো বলতে বলতে হঠাত আলোর মুখ শুকিয়ে গেল যেন আড়ষ্ঠ হয়ে এল। চোখের সামনে গতরাতের ঘটনা ভেসে উঠলো-

– আলেয়াকে বড়ি খাওয়ানোর জন্য আলো জোর করছে। আর আলেয়া বারবার বলছে-“ও ভাই, বড়ি খুব তিতা রে, বমি হইবো খাইলে। আমি খাইবার পারুম না, খুব তিতা লাগে ভাই। আমারে মিষ্টি আইনা দিবি? গুঁড় হলেও থেঁতলা করে পানি মিশায়ে খাইয়া লইমু। দে, না ভাই একটু মিষ্টি আইনা।

– মিষ্টি কই পামু? বড়ি ডা খাইয়া ল। জিদ করিস
– ও ভাই, আমার না জিলাপি খাইবার মন চাইতাছে। আজকা বিকালবেলা করিম চাচা মেলাগুলা জিলাপি আনছিল। সাথে সাথে ও বাড়ি পর্যন্ত যাইয়া ঘুইরা আইছি।

এমনিতে হাঁড়িতে চাউল নাই। রাতের ভাতটুকু চেয়ে এনেছে মর্জিনা চাচীর কাছে থেকে। নিজে অভূক্ত থেকে বোনের মুখে একটু খাবার তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে আবার মিষ্টি খাবার আবদার! সারাদিনের সকল ক্লান্তি, নিজের অক্ষমতা আর আক্ষেপ সব গিয়ে পড়ল আলেয়ার উপরে। সজোরে এক চড় বসিয়ে দিল গালে।

– মুখপুড়ী তুই মরিস না ক্যান। হওনের সময় মা’রে মাইরা ফেলাইছিস। তুই ও মায়ের সাথে চইলা যাইবার পারস নাই? এখন আমার কইলজা পোড়াইতে তোর শান্তি? কাল সকালেই তোরে ট্রেনে করে অনেক দূরে থুইয়া আইমু। আর বেশি বায়না ধরলে জ্যান্ত মাইরা ফ্যালামু।

মা মরা মেয়ে আলেয়া। জন্মের পর থেকে এই ভাইটিই তার বাপ,মা, ভাই সব। হঠাত ভাইয়ের এমন আচরণে সে এক্কেবারে চুপসে গেল। ভয়ে ভয়ে পানি আর বড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ল। রাতের মধ্যে প্রচন্ড জ্বরে আলেয়া মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে। মধ্যরাতে আলো একবার ঘুম থেকে জেগে আলেয়ার গায়ে ছেঁড়া কাঁথা তুলে দিল। কিন্তু জ্বরের প্রচন্ডতায় যে কাঁপুনি তা এই পাতলা কাঁথায় কিছুই হচ্ছেনা।

সকালে আলেয়াকে ঘুমিয়ে রেখেই আলো আজ বেড়িয়ে এসেছে কাজে। বিগত ছয় সাত বছরে আলেয়াকে অনেকবারই বকাঝকা করেছে, কখনও দুই চার টা চড় থাপ্পরও দিয়েছে। কিন্তু গতকাল আলেয়াকে মারার পর থেকে আলোর মনে তা খুব পীড়া দিচ্ছে। বড় ভাই হিসেবে শাষন সে করতেই পারে। কিন্তু গতকাল কি শাষন ছিল? আলেয়ার ত কোন ভুল ছিলনা।ছোট মানুষ কিছু খেতে চাইতেই পারে। কার কাছেই বা চাইবে? ভাই ছাড়া। না শাষন নয় বরং আলো তার নিজের অযোগ্যতা, অক্ষমতা আর ছোট বোনের আবদার পূরনের ভারসাম্য রক্ষায় ব্যর্থ হয়েই সকল আক্রোশ গিয়ে পড়েছে আলেয়ার উপরে।

গুলিস্তান মোড়ে বাস থেমে আছে অনেকক্ষন ধরে। ট্রাফিক সিগন্যালে সবুজ বাতি জ্বলা মাত্রই গাড়ি সামনের দিকে টান দিল। অন্যমনষ্ক থাকার কারনে স্থিতি জড়তার প্রভাবে আলো প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। শফিক তার হাত ধরে, আটকালো।

– আলো, কী ব্যাপার একবারে চুপ হয়ে গেলে?

শফিকের ডাকে মাথাটা একটু উপরে তুলল। বাসের হালকা আলোতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ঐ মায়াবী কালো চোখের নীচ দিয়ে শীর্ণ কোন নদীর ধারা বয়ে চলেছে সবার অলক্ষ্যে।

– তোমার বোনের জন্য কী ঔষুধ নিলে?
– আলেয়া বড়ি খেতে পারেনাত, তিতা লাগে তাই দোকানে বইলা একটা মিষ্টি সিরাপ লইছি। আইজকা বোন ঔষুধ খাইতে আর কষ্ট পাইবনা। কাল জিলাপি খাইতে চাইছিল, তাই দশ টাকা দিয়া একটা জিলাপিও লইছি।

কথায় কথায় বাস চলে এল কমলাপুর। হেল্পারের ডাকে উঠে দাঁড়ালো শফিক, পিছে পিছে আলো ও তার বন্ধুরা। বাস থেকে নেমে শফিক সবাইকে ডেকে নিয়ে গেল সামনের মিষ্টির দোকানে। দোকানীকে বলে দিল সবাইকে একটা সন্দেশ আর কালোজাম দিতে। আর কিছু সন্দেশ ও কালোজাম প্যাকেট করে দিতে। দোকান থেকে বের হবার সময় শফিক মিষ্টির প্যাকেট আলোর হাতে দিয়ে দিল।

-আলো, এইগুলো তোমার। তুমি আর আলেয়া মজা করে খেও।
– স্যার, এইগুলা সব আমার?
– হ্যাঁ, সব তোমার আর আলেয়ার জন্য।

মলিন মুখখানি মূহুর্তেই টিউব লাইটের মত জ্বলে উঠলো, ঠোঁট দুটো প্রসারিত হল দুপাশে। কৃষ্ণকায় চেহারার মাঝে সাদা দাঁতগুলো যেন শাপলা শালুকের ন্যয় সুন্দর দেখাচ্ছে। যেন এই চেহারা, এই হাসি আচ্ছন্ন করতে পারে দুনিয়ার সবাইকে, মোহাবিষ্ট করতে পারে অন্তরকে, গলাতে পারে পাষান। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে আলোর হাতে ২০ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিল।

-আলো, যাও। সবাই সাবধানে চলে যেও। বলে সবাইকে বিদায় জানালো শফিক।

দ্রুতলয়ে বাড়ির দিকে এগোচ্ছে আলো। অজানা কোন এক উচ্ছাস কাজ করছে তার মধ্যে। সারাদিন মনের মধ্যে যত খেদ ছিল, শফিকের সাথে কিছুক্ষণের আলাপে তা উবে গিয়েছে। আজ তার কাছে রাতের খাবার চাউল আছে, অসুস্থ বোনের জন্য ঔষুধ, জিলাপি, মিষ্টি; আর কী চাই! সে জগতের সবচেয়ে সুখী মানুষ, সুখী ভাই। অদূরে মিলিয়ে যাচ্ছে আলো আর তার সঙ্গীরা। শফিক দূর থেকে দেখছে। কী সেলুকাস! সারাজীবন এই পথশিশু আর তাদের জীবনগাঁথা থাকে সোডিয়াম বাল্বের আবছা আলোর মতই আঁধারে। উদ্ভাসিত আলোয় ঝলমলে দুনিয়ার চেহারা তাদের দেখা হয়না কখনই।

দূর থেকে ছোট্ট এক কামরার বাড়ি আলো ও আলেয়ার। আলোর পা আরো দ্রুত চলছে। আলেয়াকে গিয়ে মিষ্টি সিরাপ দিবে, কাছে ডেকে আদর করে বলবে- “তোকে আর বড়ি খাইতে হইবেনা বোন”

মিষ্টি আর জিলাপি লুকিয়ে রেখে আলেয়াকে চোখ বন্ধ করতে বলে হাতে দিবে। এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির একদম কাছে চলে আসল আলো। ভিতর থেকে কিছু মানুষের হালকা আওয়াজ ভেসে আসছে। আলো দ্রুত ঘরে প্রবেশ করতেই মর্জিনা চাচী বলে উঠলো-

-এতক্ষনে তোর সময় হল আসার? সকাল থাইকা মাইয়াডা ভাই ভাইকইরা মুখে ফ্যনা তুইলা ফ্যালাইলো। জ্বর একবার আসে তো আবার যায়। আয় আয়, তাড়াতাড়িকাছে আইয়া বস।

হাতের পুটলি, মিষ্টির প্যাকেট বিছানার পাশে রেখে হাঁটু গেঁড়ে বসলো আলো।

-আলে, এই আলে। বোন! কী হইছে রে? জ্বর কমেনি? আমি মিষ্টি সিরাপ লইয়া আইছি বোন। ভাল হইয়া যাইব।

ভাইয়ের গলা শুনতে পেয়ে আলেয়া চোখ মেলে তাকালো। একটু হেসে হাত বাড়িয়ে দিল ভাইয়ের দিকে। আলো বোনকে কোলে তুলে নিল। গালে, মুখে, কপালে চুমো দিয়ে যেন সারাদিনের মনের অশান্তি কিছুটা হলেও মিটিয়ে নিল। কোলের মাঝে আলেয়াকে রেখেই আলো মর্জিনা চাচীকে চাউলের পুটলি এগিয়ে দিয়ে রাতের জন্য আলু সেদ্ধ ভাত একটু রান্না করে দিতে বলল। আর মিষ্টি, জিলাপি বের করে আলোকে দেখিয়ে বল, দ্যাখ বোন তোর জন্য কত্ত মিষ্টি লইয়া আইছি, জিলাপিও আছে, দ্যাখ।

আলেয়া একটু হেসে জিলাপি খেতে চাইলে আলো জিলাপি নিয়ে তার মুখের কাছে ধরল। আলেয়া তার হাত থেকে জিলাপি নিয়ে ভাইয়ের মুখের দিকে নিয়ে গেল। কয়দিন তেমন কিছু খায়নি। তার উপরে জ্বরের প্রকোপ। হাত উঠাতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে আলেয়ার। আলো বোনের হাত ধরে জিলাপি মুখের কাছে এনে এক কামড় খেয়ে আলোর হাত নামিয়ে আনলো। আলেয়ার হাত ছেড়ে দিতেই তা নীচে পড়ে গেল। আলেয়ার চোখ দুটো শান্ত, স্থির যেন ভাইকে দেখছে কত প্রশান্তিতে।

আলো কিছু না বুঝে বার বার বলে চলেছে, কী রে, জিলাপি খা। বোন, জিলাপী খা। একটা এনেছি বলে রাগ করেছিস?

-পাগলি, এইতো আমি এক কামড় খাইছি। বাকিটা তুই খা। বেশি ক্যামনে কিনমু বোন, বল? যে কয়ডা ট্যাহা কামাই করি তা দিয়ে ত পেটের ভাতই জোটেনা রে। তুই খা, বোন। মন খারাপ করিসনা। এইবার আরো বেশি আইনা দিমুনি। আরে, দ্যাখ কত্তগুলা মিষ্টি, সন্দেশ লইয়া আইছি তোর জন্য। নে, নে তাড়াতাড়ি খাইয়া ল।

আলেয়ার হাত ধরে ওর মুখের কাছে নিয়ে যেতেই আলো ভয় পেল। হাতে কোন শক্তিই নেই। একটু উপরে তুলতে জিলাপিও পড়ে গেল হাত থেকে। আচমকা আলেয়া বার কয়েক হেঁচকি তুলল। আবার চোখ খুলে তাকালো। বিরবির করে আওড়াচ্ছে-

-দে না ভাই, আমায় একটু মিষ্টি আইনা। ঔষুধ খুব তিতা রে ভাই। খু—উ—ব– তি—তা। আমি ট্রেনে যামুনা ভাই। আমায় ফ্যালায়ে যাসনা ভাই। তোকে ছাড়া আমি রাইতে কার কাছে থাকমু ভাই? আমায় ছাইড়া যাসনা ভাই। আর কক্ষনও জিলাপি খাইবার চাইমুনা ভাই।

পাগলের মত আলো আলেয়াকে কোলের সাথে জাপটে ধরে আছে, হাতে মুখে চুমো দিচ্ছে।

-তোকে কোথাও যাইতে দিমুনা বোন, কোথাও ফ্যালায়া যামুনা। আর তিতা ঔষুধ খাওয়ামুনা।

কোলের মাঝে আলেয়া ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে আওড়িয়ে শেষবারের মত বলে চলেছে-

-ভাই, দ্যাখ, মা কত্ত জিলাপি লইয়া আইছে। মা মিষ্টি ঔষুধওআনছে ভাই। আমি মা’র কাছে গেলাম। তুই মন খারাপ করিসনা। আমি মা’র কাছে যা—ই—ই—ই—ই ভা—–।

আলো শক্ত করে বুকের সাথে আলেয়াকে ধরে আছে।

-তোকে কোত্থাও যাইতে দিমুনা আমি, কোত্থাও না। আর বকাও দিমুনা বোন।

মর্জিনা চাচী এসে আলেয়াকে আলোর কাছে থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। পাশের ছেঁড়া কাঁথাটা তুলে দিল মুখ ঢেকে সারা শরীরের উপরে। বিচ্ছিন্ন হল আলো হতে আলেয়া। বিচ্ছিন্ন হল ভাই-বোন, দুটি প্রাণ।

Facebook Comments