banner

শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 180 বার পঠিত

নারীর অগ্রগতির জন্য নারী সহায়ক পরিবেশ প্রয়োজন

regular_5522_news_1394215149সেলিমা আহমদ। মা-মরহুমা রহিমা হক, বাবা-মরহুম এ কে এম ফজলুল হক। বাবা মেয়েকে ভীষণ আদর করতেন। কারণ, কন্যাটি ছিল বাড়ির সবচেয়ে ছোট্ট মেয়ে। পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া স্বচ্ছ জলের মতো সারা দিন ননস্টপ কথায় বাবা ফজলুল হক এতটুকু বিরক্ত হতেন না। মেয়েকে তার বুকের কাছে আগলে রাখতেন আর ইহলৌকিক, পারলৌকিক ও দিব্য জগতের নানান বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান দিতেন। গল্পচ্ছলে বাবা মেয়েতে চলত নানা আলাপচারিতা সারা দিন ঘরেবাইরে পুতুল খেলার ঘরে, মাঠে, স্কুলের সব আলাপ যেন ছোট্ট সেলিমা জমিয়ে রাখত বাবা অফিস থেকে ঘরে ফেরার অপেক্ষায়। স্কুলের নিয়মশৃঙ্খলা, সময় ধরে একটানা দুই ঘণ্টা পরীক্ষার হলে বসে লেখা এসব সেলিমার একদম ভালো লাগত না। কখনো মা এতটুকুন ফুটফরমাশ দিলে বাবা তাতে বাদ সাধত আর বলত ‘আমার ছোট্ট রাজকন্যাকে একদম কাজ করতে বলবে না ও আমার ছোট্ট টুনটুনি পাখি। মা, রাগ করলে বাবা বলত দেখো একদিন তোমার মেয়ে দেশবরেণ্য মানুষ হবে ওর মেধা আছে একদিন তা কাজে লাগবে।’ বাবা যেন ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন। বাবার কথা আসতেই সেলিমা আহ্মাদ একটু যেন থেমে গেলেন।

 

বাবাকে তিনি ভীষণ ভালোবাসতেন বাবার উৎসাহ, প্রেরণা, স্নেহমাখা আদেশ উপদেশ সব যেন পাথেয় হয়ে রয়েছে তাই ছোট্টবেলায় পড়ায় ফাঁকিঝুঁকি মারলেও কাস নাইন-টেনে এসে তা পুষিয়ে নিয়েছেন পড়াশোনায় ভীষণ রকম সিরিয়াস হয়ে। এমনি করে খুলনার ফাতেমা হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন।

 

কলেজে ভর্তি হওয়ার পরপরই তার বিয়ে হয় আবদুুল মাতলুব আহমাদের (নিটোল নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান) সাথে। ভীষণ রকম উদ্যমী ও বিনয়ী এই মানুষটি স্ত্রী সেলিমাকে সব সময় তার কাজের ব্যাপারেও সহযোগিতা করেছেন, এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ১০০% সাহস জুুগিয়ে। আর তাই কোনো রকম ব্রেক ছাড়াই হলি ক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে বিকম (সম্মান) এমকম ডিগ্রি অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই বড় ছেলে আবদুল মুসাব্বির আহমাদ, নিটোলের জন্ম হয়। সেলিমা আহমাদ ছাত্রাবস্থায়ই সংসার-সন্তান লালনপালনের সাথে সাথে হ্যান্ডিক্রাফট রফতানির মাধ্যমে তার বিজনেস শুরু করেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের তৈরি নানা রকম প্রয়োজনীয় সব উৎপাদিত পণ্য দেশে-বিদেশে সম্মান ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে সহায়তা করছে আজো। সারা দেশে তার কর্মীবাহিনীর সংখ্যা হাজার হাজার। যারা নিজেরাও আজ স্বাবলম্বী। উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ফাউন্ডার প্রেসিডেন্টও তিনি। বর্তমানে তিনি নিটল নিলয় গ্রুপে অব ইন্ডাস্ট্রিজ-এর ভাইস চেয়ারপাসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিশাল এ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান তিনি পরিচালনা করেন সফলতার সাথেই।

 

ব্যক্তিগত জীবনে সেলিমা আহমাদ অত্যন্ত বিনয়ী, সদালাপী ও মমতার আধার। তাই তো তার শুভাকাক্সীর সংখ্যা অনেক। সেলিমা আহমাদের ছোট ছেলে আব্দুল মারিব আহমাদ নিলয় (ভাইস চেয়ারম্যান নিটোল নিলয় গ্রুপ) মায়ের কাজকর্মে সব সময় সহযোগিতা করেন। তাদের গ্রুপ অব বিজনেসে সবাই অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা এই নারী ব্যক্তিত্বকে ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস নিয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি জানান ‘আজকে এই সময় নারীরা সারা বিশ্বে তার মেধা মননে অনেক বেশি এগিয়ে এসেছে। বিশ্বায়নের এই যুগে গ্রামবাংলার নারীরাও অনেক বেশি কর্মক্ষম হয়ে নিজের ও পরিবারের অবস্থার পরিবর্তন করছে। এতে একটি পরিবার, তারপর সমাজ, তারপর দেশের আপাত চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। খুব বেশি দিন লাগবে না এর ব্যাপক প্রসার হতে। তবে এর জন্য প্রয়োজন ঘরের পিতা-মাতা ও পরে স্বামী বা শ্বশুর বাড়ির মানুষদের সহযোগিতা। তা না হলে বাংলাদেশের উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, ৮০-র দশকে আমি যখন ব্যবসায় শুরু করি তখন একজন নারীর জন্য ব্যবসায় বাণিজ্যের সাথে যুক্ত হওয়া অনেক বেশি সমস্যা ছিল। নারীকে ব্যবসায়ী হিসেবে দেখতে তখনো সমাজ অভ্যস্ত ছিল না। কিন্তু আজকে উদ্যোক্তারা নিজ কর্মক্ষেত্রে, ব্যাংকে, এয়ারপোর্ট এসব জায়গায় গেলে তেমন উল্লেখযোগ্য বিরূপতা ফেস করতে হয় না। তবে আজকে বড় সমস্যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এ অবস্থা এমনই ভয়ঙ্কর যে নারীর জন্য এটা মিট করে ব্যবসায় করা খুবই কঠিন হচ্ছে। পুলিশের অপ্রতুল সহযোগিতা মাস্তানদের উপদ্রব, এসব নারী উদ্যোক্তার জন্য বর্তমানে বড় প্রতিবন্ধকতা। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্স, ইআরসি, আইআরসি, টিআইএন করতে হয়। এগুলো করতে নানা রকম অনিয়ম ও ঘুষের আশ্রয় নিতে হয়। এসব করতে যেসব অযাচিত হয়রানি তা আমাদের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রতিবন্ধকতা। কারণ ব্যবসায়ী কর্মজীবী নারীকে একই সাথে পরিবার, ব্যবসায় ও অন্যান্য সেক্টর দেখতে হয়। ফলে নারীর জন্য উৎকোচ হাতে ফাইলের পিছে পিছে ফেরা ও তদবির করা কঠিন এবং ওই বাধাটা কাজের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হয়। তিনি আরো বলেন, নারীর অগ্রগতির জন্য নারী সহায়ক পরিবেশ প্রয়োজন। নারী উদ্যোক্তারা অনেক পণ্য উৎপাদন করছে কিন্তু বাজারব্যবস্থায় প্রবেশ করতে পারছেন না। এসব ব্যাপারে সরকারি সহযোগিতা দরকার, পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের স্বার্থে আরো প্রতিষ্ঠান হওয়া দরকার।

 

উদ্যোক্তা হিসেবে বাজারে আত্মপ্রকাশের জন্য একজন নারীকে কী কী শর্ত পালন করতে হবে? এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য সর্বাগ্রে দরকার কমিটমেন্ট ও জ্ঞান, বিশেষ করে ব্যবসায়িক বিষয়ে জ্ঞান থাকা ও নিজস্ব ক্যাপাসিটি বিল্ডআপ করা। নিজের সেক্টরে সব নখদর্পণে থাকা। একজন সার্থক মালিক বা ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব হয় যখন তার মধ্যে সব সেক্টরের জ্ঞান থাকে। সমাজে বিদ্যমান নারী-পুরুষ বৈষম্য বা বিদ্বেষটাকে দূর করতে হবে। আর নারী বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলে ও দায়িত্ব নিলে অচিরেই তা দূর হবে।

 

নারীর ব্যক্তি চরিত্রে ধৈর্য, ডিগনিটি, বাঙালিত্ব এসব থাকতে হবে। অনেক নারী আজকে নিজেদের বেশি স্বাধীন ভেবে স্বাধীনতার অপব্যবহার করে। বস্তুত সমাজের রীতিশৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে সবার সহযোগিতা পাবে, অন্য রূপ হলে সব মহল থেকে সহযোগিতা চলে যাবে। সেলফ রেসপেক্ট থাকতে হবে এবং সর্বক্ষেত্রে তা বজায় রাখতে হবে। অন্যথায় আজকের কোনো ভুল পদক্ষেপ পরবর্তী প্রজন্মকে ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা হতে নিরুৎসাহিত করবে।-নয়াদিগন্ত

সেলিমা আহমদ:ফাউন্ডার প্রেসিডেন্ট, বিডব্লিউসিসিআই এবং ভাইস চেয়ারপারসন, নিটল নিলয় গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি

Facebook Comments