ঘূর্ণিঝড় সিডরের সাত বছর পেরিয়ে গেলেও বরগুনায় এখনো স্বজনহারা পরিবারের আহাজারি থামেনি। নিহতদের সন্তানেরা লেখাপাড়া শিখে বড় হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা মানুষ হতে চায়।
বরগুনার তালতলীর কবিরাজপাড়া গ্রামের বাসিন্দা খলিলুর রহমান তার মেয়ে ডলি (৭) ও কলিকে (১১) নিয়ে বেঁচে আছেন। তার পরিবারের বাকি ১১ জন সদস্যের সবাই মারা গেছেন। বেঁচে থাকা মেয়ে দু’টি মায়ের আদর যত ছাড়াই বড় হয়েছে। ছোট মেয়ে নানার বাড়িতে থেকে কবিরাজপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে লেখাপড়া করছে। তেঁতুলবাড়ীয়া গ্রামের আরেক পরিবারের নয়জন নিহত হন। তাদের পরিবারে বেঁচে থাকা আলমগীর বলেন, পরিবারের সবাইকে হারিয়ে আজ আমি অসহায়। লেখাপড়া করার অদম্য ইচ্ছা থাকলেও পারিনি। পরিবারের অভিভাবক হারিয়ে সংসারের হাল ধরতে বাধ্য হয়েছি।
বরগুনার আমতলী ঘটখালী গ্রামের ১৪ জন দিনমজুর পানের বরজের ধানশি লতা সংগ্রহের জন্য ট্রলার নিয়ে সাগর কাছে চরনিদ্রা ছকিনা গিয়েছিলেন। সিডরের ভয়াল সেই রাতে সবাই জলোচ্ছ্বাসে হারিয়ে যান। তাদের মধ্যে চারজন ফিরে এলেও ১০ জন আর ফিরে আসেননি। তারা হলেন ইউসুফ (৪০), জব্বার (৫৫), ছোবাহান (৪২), হোসেন (৫০), খলিল (৩৫), রতন (৪০), সোহেল (১৮), মনিরুল (২৫), দেলোয়ার (২৫) ও আলতাফ (২০)।
আমতলীর দিনমজুর ইউসুফ সরদার ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র অভিভাবক। তিনি রেখে গেছেন তিন সন্তান ও স্ত্রী আমেনা বেগমকে। আমেনা বেগম জানান, তার বড় মেয়ে সারমিন পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। সে এ বছর এসএসসি পরীার্থী। ছোট মেয়ে নীল দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী এবং ছেলে শাওন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছে। আমেনা বেগম আরো বলেন, আমি স্বামী হারিয়েছি, এতিম সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহন করতে পারছি না।
নিহত মনিরুলের স্ত্রী হামিদা বেগম বলেন, আমি দিনমজুরের কাজ করে একমাত্র মেয়ে সাইফাকে (৯) লেখাপাড়া শেখানোর স্বপ্ন নিয়ে সংগ্রাম করে যাচ্ছি। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়–য়া সাইফা জানায়, বাবাকে হারিয়েছি। মায়ের মধ্যেই বাবার স্মৃতি খুঁজে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে লেখাপাড়া করছি। নিহত রত্তনের বাবা আবদুর বারেক মিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘মোর চাওয়া পাওয়ার কিছুই নাই, মোর পোয়ায় দুই ছেলে রাইখ্যা গেছে, হ্যাগো ল্যাহাপাড়া হরাইতে বড় কষ্ট অইতেছে। সরকার এই এতিম সন্তানদের দিকে তাকাইলে বড় ভালো অইত।’
বৈঠাকাটা গ্রামের একই পরিবারের দুই ছেলে দেলোয়ার ও আলতাফ সিডরে নিহত হয়েছে। তাদের প্রতিবন্ধী বাবা আলী আজম গত বছর মারা গেছেন। দেলোয়ারের দুই ছেলে এখন অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।
সোবাহানের দুই ছেলে। বড় ছেলে রাসেল ঘটখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে আমতলী ডিগ্রি কলেজে লেখাপাড়া করছে। অর্থের অভাবে ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারছে না। অন্যের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করে। কাজের ফাঁকে লেখাপড়া করে। রাসেল জানান, ‘বাবা ছিলেন দিনমজুর। অর্থের সন্ধানে সাগরে গিয়ে আর ফেরেননি। আমার পরিবারের আর যেন কোনো সদস্যের সাগরের বুকে হারিয়ে যেতে না হয় এ জন্যই লেখাপড়া করছি। কষ্ট হলেও একদিন সমাজের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াব।’
ঘটখালীর সমাজসেবক আলমগীর হোসেন জানান, নিহত পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর অদম্য বাসনা নিয়ে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকে মেধাবী ও প্রতিভাবান। আমার বিশ্বাস তারা উচ্চশিা গ্রহণে সহযোগিতা পেলে দেশের সুনাগরিক হয়ে উঠবে।
ঘটখালী ও বৈঠাকাটা গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে সিডরে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের আজো তারা ভুলেনি। এখনো মাঝে মধ্যেই তাদের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।
সূত্র- নয়া দিগন্ত