নীলজোসনা
স্বর্ণার মন খারাপ! শুধু মন? মেজাজ গরম! কারণ সকালে উঠেই দেখেছে কপালের ওপর প্রমাণ সাইজের একটা ব্রণ। রাগী লাল চেহারা করে আছে। তার ওপর সারা রাতের টুকরো চিন্তাগুলো, উফ!
এম্নিতে স্বর্ণা বেশ সময় সচেতন। মানে, সুযোগের অভাবে সৎ যাকে বলে। বাচ্চাদের আর প্রফেসর স্বামীকে একই সাথে বিদেয় দিতে হয় সকাল সাড়ে সাতে। তার আগে পর্যন্ত এলোখোঁপা আর রাতের কাপড়েই দৌড় চলতে থাকে। এর মধ্যে শাশুড়ির চা, বিস্কিট আর পেপারটা দিয়ে এসে বুড়ি ছোঁর মত করে নিজের কালো কফিটা করে ফেলতে পারলে ব্যাস! নয়টা পর্যন্ত নিজের কয়েকটা কাজ নিশ্চিন্তে সেরে ফেলা যাবে।
সকালে বাথরুমের সময়টা আর সাইক্লিং মেশিনে কয়েকশো প্যাডলের সময়টায় মেয়েদের গ্রুপগুলোয় কাল রাতের আড্ডাগুলো দেখে ফেলা যায়। একেকজন শশুরবাড়ির কাহিনী নিয়ে মস্ত গল্প লেখে, কেউ ধারাবাহিকও লেখে। একেকজনের আবার নিজের গ্রুপও আছে, তাতে সেসব গল্পের দানা ছাড়ানো হয়। কিছুদূর দেখতেই ‘স্বর্ণার মা’ ছোট্ট একটা বেল দেয়। ‘এতোবার বলি তোমাকে, বাব্বাহ একটু বাজিয়ে বেল দাও’। সহজ সরল মহিলা, স্বর্ণা নামটা বদলে ‘রোজীর মা’ করে দিলেও মিষ্টি একটা হাসি দিয়েছে। রোজ আঙুল একটু ছুঁইয়েই বেল দিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ পাতাল ভাবে, দুইবারে হয়ত স্বর্ণা টের পায়। কি যন্ত্রণা!
আজকের ব্রণ ওঠার রাগটা রোজির মা’টাকেও ছুঁয়ে গেছে। দরজা খুলেই মস্ত ধমক খেয়েও সেই বোকা হাসি। চোখ ফিরিয়ে নিলো স্বর্ণা, ‘কি সব পড়লাম কালকে? কি হবে এখন?’
পরের কয়েক ঘন্টা যেন ধুনুচির তুলো। উড়তে উড়তে শেষ। শাশুড়ির নাশতা দিয়ে, রান্নার আয়োজন সেরে বারোটায় গিয়ে শাড়ির পেইজের মেসেজ দেখে ও। মহিলারা আসলেই আশ্চর্য এক সৃষ্টি! এই সকালটাই সবাইর মহা ব্যস্ত সময়, আর এই সময়টাতেই সবচেয়ে বেশি মেসেজ আসে। আর আসে গভীর রাতে। স্বর্ণার রাত করে ফোন ধরতে ভালো লাগে না, বমি পায়। ওর এই দুপুর ছাড়া উপায় নেই।
এই সময়টায় মা আসেন গুটি গুটি পায়ে। কখনও বসার ঘরের বারান্দায়, কখনও স্বর্ণার মস্ত বেতের চেয়ারের কাছেকাছে হাঁটেন। কোন কমেন্ট পড়ে স্বর্ণা হেসে উঠলে উৎসুক তাকান। হয়ত কোনোদিন মাত্র পড়ে শেষ করা কোন শাশুড়ি-বউ-ননদের ট্রিলজি শোনায় স্বর্ণা। আশ্চর্য এক গুণ আছে তাঁর, নিষ্পলক মনযোগী চোখে গল্প শুনতে ভালোবাসেন। মাঝেমাঝে উস্কেও দেন, ‘ওই যে ওইদিনের মেয়েটা, তার গল্পটা আর দিয়েছে নাকি দেখ না’! স্বর্ণা খুঁজেপেতে বের করে পড়ে শোনায়। এম্নিতে শাশুড়ি বউর আশ্চর্য সুন্দর শ্রদ্ধার একটা সম্পর্ক। তবু এইসব গল্পে স্বর্ণার চোখে পানি আসে। নিজে পায় নি বলেই হয়ত, না দেখা কোন মেয়ের কষ্ট ওকে ছুঁয়ে যায়। সাদাচুলের মহিলাটা তখন কালো চুলভর্তি মাথাটায় হাত বুলান, ‘আহা থাক। অত ভাবে না। ওরা একদিন ঠিইক বুঝবে, দেইখো’।
এই এমন করেই কালও বউয়ের পড়ে শোনানো গল্প শুনছিলেন। মাঝেমাঝে থামে স্বর্ণা, মেসেঞ্জারের গ্রুপে টুং আসে। গ্রুপের কোন চেনা ভাবির গল্পের অন্য দিক আলোচনা হয় আবার এই গ্রুপে। ‘জানেন মা, ওই যে বউটা, সে নিজেই আস্ত এক…’ বেরিয়ে আসা গালিটা গিলে রাগ ফোটায় গলায় ‘আস্ত পাজী’। শাশুড়িকে আচ্ছামত চাপের ওপর রাখে, আবার মেয়েদের গ্রুপে কাঁদুনি গায়। নীলা ভাবীর বোনের জা, সত্যি’।
এই বলতে বলতে হঠাত ভয়ের চোরা স্রোত মনে, ‘আচ্ছা মহিলার বদনাম গাইছি তো, ঠিক হচ্ছে?’ ভাবনাটা উড়িয়ে দিলেও খুট খুট মনে বেজেই যাচ্ছিলো। আসরের আজানের পর টিভিতে একটা সূরার বাংলা অনুবাদটা দেখে সে অস্বস্তিটা বাড়লো। সন্ধ্যার পর বাচ্চাদের পড়াতে পড়াতে ফোনের স্ক্রীণে হারিয়ে যেতে যেতে ফিরলো স্বর্ণা। এ তো ভারি বিপদ। কারুর পেছনে তো বদনাম করাই যাবে না, সামনেও না? আরে বাবা, ভুল শুধরে দিবো কি করে তাহলে? এই যে এত গ্রুপ, এতো গল্প আড্ডা, সবকিছুতে তাহলে দুর্গন্ধ মিশে আছে?
সেই চিন্তা রাতভর, আর তার ফলাফল বিচ্ছিরি একটা ফুসকুঁড়ি। সকাল থেকে পেটটাও যেন ফুলে আছে, কারণ আজকে আর গ্রুপ বা মেসেজে প্রাণ পাচ্ছে না স্বর্ণা।
ফোনে বড় বেশি বিরক্ত করে মেসেজের টুং, তাই ছেলের কম্পিউটারে বসলো রাতের খাবারের পর। নতমস্তকে উঠে আসতে হল ঘন্টাখানিক পর। ইস, কত বড় অন্যায় হয়ে গেছে এদ্দিন। কাউকে শুধরানোর কাজটা এতো জটিল, কে জানতো! না করা যাবে হুমাযাহ বা সামনে তিরষ্কার, না বলা যাবে লুমাযাহ বা পেছনে। চারদিকে উঁচু থামে ঘেরা, আগুন ভর্তি জায়গাটায় ফেলে দেয়া হবে এইসব মানুষকে, তাও আবার স্বর্না যাদের দেখতে পারে না, এমন সুদখোরদের সাথে। উফ, মা গো!
তাহলে? ‘এই গল্পগাছা না হয় না শুনলাম, কাউকে তো টুকটাক উপদেশও দিতাম, তার কি হবে?’ খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেল আরেক আয়াত, ঘুণাক্ষরেও কুধারণা করা যাবে না, কারুর ব্যপারে জানতে চেয়ে তার অগোচরে ঘাঁটাঘাঁটি করা যাবে না। উপদেশ দিলেও দিতে হবে সামনে, সরাসরি তাকেই, খুব নরম ভাষায়, তিরষ্কার না করেই।
আর যায় কোথায়, সমস্ত গল্প, কমেন্ট, মেসেজের গ্রুপের স্পেশাল তথ্য সব যে কেমন তেতো লাগছে এখন। তাই তো, ওই ভাবিগুলোকে সবাই সামনে সে কী আহা উঁহু করে, আর পেছনে শুধু বিষ ঢালে। না মানুষগুলো শুধরাতে পায়, না সত্যিকারের বন্ধু পায়। আহারে!
আজকের মধ্য দুপুরের হালকা অবসর সময়টা পেয়েই একে একে টিপে টিপে সবগুলো গ্রুপ ছাড়লো স্বর্ণা। শাশুড়ি রুম থেকে বেরিয়েছেন, ‘স্বর্ণা, মশারি ধুতে দিবে মনে আছে? আমাকে বলেছিলা মনে করাতে।’ গলা তুলে রোজির মা’কে কথাটা শুনিয়ে এবার আবদার করলো, ‘মা আপনার বিয়ের গল্প বলেন’। শাশুড়ি ততোক্ষণে নিজের কুশনওয়ালা মোড়ায় বসে গেছেন। আজকের গল্পগুলো সাদা, স্বচ্ছ, পরিষ্কার হবে। অনেকক্ষণের আটকে রাখা বদ্ধ নিঃশ্বাসটা বেরিয়ে এসেছে নিজেই। উফফ!
‘রোজির মা’, বেল তুমি দুইবার দাও বা তিনবার, সাথেসাথেই দিও। নইলে তো বুঝতে পারি না গো! আচ্ছা দাঁড়াও, একবার দিয়ে দেখাও তো? হ্যাঁ, এমন করে তিনবার দিও। এখন যাও। এইইই, ভাতের হাঁড়িটা নাও, ইস কি ভুলো মন রে বাবা!’ রোজির মায়ের সরলতায় এখন সহানুভূতির প্রলেপ দিতে শিখে গেছে স্বর্ণা! আজকে কি দারুণ লাগছে মাঝবয়েসি সরল মহিলাটার হাসিটাও। বন্ধ দরজার এপাশেও এখন আলো, দুটো মানুষের মনেও।