ঘরকন্যা
রংপুর মহানগরীর বিভিন্ন সড়কে গতকাল শুক্রবার বিকেলে দেখা গেল যানবাহনে ও হাঁটা বহু নারীর মাথায় হিজাব। সর্বাধুনিক ডিজাইনের বাহারি রঙের হিজাবে সব বয়সী নারীর মুগ্ধ পদচারণা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আড্ডারত দুই তরুণীর কাছে মাথায় হিজাবের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা জানালেন মাথার চুল আবৃত করতেই হিজাব পরি। এটা এখন আমার ফ্যাশন। এক দিকে চুলও আবৃত করা হলো। চুলও ধুলাবালু থেকে রেহাই পেল। ধর্মীয় অনুশাসনও মানা হলো অন্য দিকে আধুনিক ফ্যাশনও করা হলো। তবে ১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব হিজাব দিবস সম্পর্কে কিছু জানা নেই তাদের। বস্তুত নানা রঙের নানা ডিজাইনের হিজাবে আবৃত নারীদের ফ্যাশনে এনে দিয়েছে ভিন্নমাত্রার নান্দনিকতা। নারী পোশাকে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আবহমান বাংলার চিরায়ত সাংস্কৃতিতে এনে দিয়েছে নতুন মাত্রা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হিজাবকে স্মরণীয় করে রাখা এবং পর্দার ব্যাপারে ইসলামী বিধান অনুসরণকারী সব মুসলিম নারীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রতি বছর ১ ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে বিশ্ব হিজাব দিবস। এবার হিজাব দিবসের স্লোগান ‘হিজাব ইজ মাই ফ্রিডম’, ‘হিজাব ইজ মাই প্রটেকশন’, ‘হিজাব ইজ মাই চয়েস’, ‘হিজাব ইজ মাই কভার’। কয়েক বছর আগে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক সিটিতে নাজমা খান নামে এক বাংলাদেশী ছাত্রী পোশাকের কারণে জ্যামাইকায় আক্রান্ত হন। ওই ঘটনার প্রতিবাদ, নিন্দা এবং সর্বসাধারণকে সচেতন করার জন্য গত ছয় বছর থেকে আমেরিকায় হিজাব দিবস পালন শুরু হয়।
রংপুর মহানগরসহ এখন সারা দেশে সব বয়সী নারীরাই নানা রঙের শাড়ি কিংবা জামার সাথে মাথায় নানা ডিজাইন-রঙের হিজাব ব্যবহার করছেন। হিজাব দিবসের সাথে ইতোমধ্যে সংহতি প্রকাশ করেছেন ৪৫টি দেশের ৭০ জনের অধিক রাষ্ট্রদূত, খ্যাতনামা রাজনীতিক ও স্কলারসহ টাইম ম্যাগাজিন, সিএনএনের মতো বিশ্বখ্যাত গণমাধ্যম। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে ওয়ার্ল্ড হিজাব ডে ডট কম পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, শতকরা ৯৪ ভাগ নারী হিজাবে নিজেদের নিপীড়িত মনে করেন না। শতকরা ৯৩ ভাগ নারী মনে করেন তাদের ওপর হিজাব চাপিয়ে দেয়া হয়নি।
বাংলাদেশে নারীদের হিজাবের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার মাত্রা বেড়ে গেছে বহুগুণ। এক সময় রাস্তায় পাশ্চাত্যের আদলে শর্ট কামিজ, খোলামেলা পোশাক পরিধানের যে ধুম পড়েছিল, তা থেকে এখন বেরিয়ে আসছেন নারীরা।
বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে জানা গেল নানান কথা। হিজাব শুধু নান্দনিক ফ্যাশনই নয়, এটি নারীদের মর্যাদাকেও বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে হিজাবে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে। শাড়ি, জামার সাথে হিজাব পরে কর্মক্ষেত্রসহ সব ক্ষেত্রে নারীদের সরব উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। প্রাচীন বাংলার জনগণ দেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি টিকিয়ে রেখে যা করেছিলেন হালের নারীরাও তা আবার ফিরিয়ে আনছেন। যে দেশের নারীরা বেশি বোরকা কিংবা হিজাব পরবেন তারা অধিকতর ডান, গোঁড়া বা রক্ষণশীল বলে কথিত যে বুলি আওড়ানো হচ্ছিল একবিংশ শতাব্দীতে। বাংলাদেশের নারীরা সেই বুলিকে অগ্রাহ্য করে হিজাবকে নান্দকিভাবে উপস্থাপন করেছেন। হিজাব এখন নারীদের কাছে এতটাই গ্রহণযোগ্য পোশাক হয়েছে যে বাংলাদেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের প্রচারেও মডেল হিসেবে হিজাব পরিহিতা নারীকে বেছে নিয়েছে।
জানতে চাইলে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী মাসুমা আখতার নদী নয়া দিগন্তকে জানান, জাতি হিসেবে মুসলিমরা সেরা। তাই তাদের ফ্যাশনের নান্দনিকতাও ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে সেরা হওয়া উচিত। এখন তাই আমরা মুসলিম নারীরা শালীন পোশাকের সাথে হিজাব ব্যবহার করে বিশ্বের সর্বাধুনিক নারী হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছি। আমরা শাড়ি ও জামার সাথে হিজাব পরে সব উৎসবকে নান্দনিক করে তুলছি। এর মাধ্যমে ইসলামের প্রগতিশীলতাকে আমরা রিপ্রেজেন্ট করছি।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী লুবনা হক জানালেন, মুসলিম নারীদের যারা গোঁড়া রক্ষণশীল বলে গালমন্দ করার চেষ্টা করে থাকেন মুসলিম নারীরা সর্বাধুনিক হিজাব পরিধান করে বড় বড় অনুষ্ঠানসহ সর্বক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে তাদের মুখে কুলুপ এঁটে দিয়েছে।
রংপুর হোমিও কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মুমতাহিনা কাউছার নয়া দিগন্তকে জানান, প্রথমত আমি একজন মুসলিম নারী হিসেবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতেই হিজাব পরি। এর বাস্তব সুবিধা অনেক। যেমন এক দিকে হালের সবচেয়ে ফ্যাশন হচ্ছে এই হিজাব। অন্য দিকে চলতে-ফিরতে খারাপ মানসিকতার লোকদের থেকে রক্ষা করা যায়। এ ছাড়াও হিজাব পরা নারীদের চলতে-ফিরতে সম্মান করে সবাই। কিন্তু খোলামেলাভাবে পোশাক পরলে মানুষ একটু অন্যভাবে দেখে। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় উপকার হয় স্বাস্থ্যের। ধুলাবালু থেকে নিরাপদ থাকা যায়। কারণ নারীদের ত্বক নরম। ধুলাবালুতে দ্রুত ত্বক নষ্ট হয়ে যায়। বাড়তি পরিচর্যার দরকার হয়। কিন্তু হিজাবের কারণে চুল এবং ত্বক রক্ষা পায়। বাড়তি পরিচর্যার সময় বেঁচে যায়।
কারমাইকেল কলেজ ইসলামের ইতিহাসের ছাত্রী ফারহানা আখতার নয়া দিগন্তকে জানান, কথিত খোলামেলা পোশাকের এই সময়ে নারীরা যে সর্বাধুনিক ফ্যাশন হিসেবে হিজাব ব্যবহার করছে, এটা খবুই তাৎপর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে মুসলিম নারী হিসেবে আধুনিক বিশ্বকে প্রভাবিত করতে পারছি আমরা।
জাতীয়ভাবে স্বীকৃত সেরা ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রংপুর ধাপসাতপাড়া মডেল কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ আনম হাদিউজ্জামান নয়া দিগন্তকে বলেন, নারীদের হিজাব পরার এই মানসিকতা একটি সভ্যসমাজ বিনির্মাণের জন্য ইতিবাচক দিক। বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে এখন নৈতিকতাবোধ সৃষ্টি হচ্ছে। তারা গড্ডালিকা প্রবাহে থাকতে চান না। এ ছাড়াও মানুষের মধ্যে এখন যে ধর্মই পালন করুক না কেন সেই ধর্মের অনুশাসন মেনে চলার আগ্রহ বেড়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন স্টাডিজ সেন্টার সব থেকে প্রিয় পোশাক কী তা জানতে একটি সমীক্ষা করে। ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পরিচালিত সমীক্ষায় ৩২ শতাংশ পাকিস্তানি নারী-পুরুষ বলেছেন, তাদের প্রিয় পোশাক নেকাব। সমীক্ষায় থাকা দেশগুলো ছিলথÑ তিউনিসিয়া, পাকিস্তান, মিসর, ইরাক, লেবানন, সৌদি আরব ও তুরস্ক। ওই সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়, ইরান, ইরাক ও লেবাননে এই পোশাকের চল রয়েছে। এতে হাত ও মুখের কিছু অংশ খোলা থাকে। তবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে যে পোশাকটি রয়েছে, সেটা মাথায় স্কার্ফ ধরনের এবং লম্বা পোশাকের সাথে পুরো মুখাবয়ব খোলা থাকে। মিসরের নারীদের ৫২ শতাংশ এটি পরেন। রিপোর্টে বলা হয়, বর্তমান মুসলিম বিশ্বের নারীরা সব থেকে আধুনিক হিসেবে এই পোশাকটিকেই বেছে নিয়েছেন। বিশেষ করে ইরান ও তুরস্কের আধুনিক নারীরা এই পোশাক পছন্দ করছেন। এর সাথে আরো একটি স্টাইল রয়েছে। সেটি হলো হাল ফ্যাশনের রঙিন লম্বা ধরনের পোশাক, কিন্তু মাথায় বড় মাপের ওড়না দিয়ে মাথা শিথিলভাবে মোড়ানো। আর পাশ্চাত্য রীতির মিশেলে সালোয়ার কামিজসহ যেকোনো ধরনের পোশাক। সুত্রঃ নয়াদিগন্ত।