মো: শহীদুল হক সরকার
অপরাজিতাবিডি ডটকম
শুধু অর্থই রুমার উচ্চ শিক্ষার স্বপ্নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে:
রুমা খাতুন। নাটোর সদরের কাফুরিয়া এলাকার জোলারপাড়া গ্রামের মো: আলাউদ্দিন ও মোছা: জাহানারা বেগমের বড় মেয়ে। রুমা এবারের এইচএসসি পরীায় স্থানীয় কাফুরিয়া ডিগ্রি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে জিপিএ ৫ পেয়েছে। এর আগে ২০১২ সালে রুমা স্থানীয় কাফুরিয়া হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৫ পেয়েছিল। রুমার যখন দুই বছর বয়স তখন তার বাবা তাদের দুই বোন ও তার মাকে ছেড়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে দেশ ছাড়ে। এ পর্যন্ত সে রুমা ও রুনার কোনো খোঁজখবর নেয়নি। তাদেরকে কোনো দিন দেখতেও আসেনি। রুমার ছোটবোন রুনা এবার এসএসসিতে মানবিক বিভাগে জিটিএ ৫ পেয়েছে। রুমার মা জাহানারা বেগমের অরজ্ঞান নেই। হয়নি স্কুলে যাওয়ার সুযোগ। তার পরও দুই মেয়ের লেখাপড়ার খরচ, পোশাক, খাতা-কলম কেনার টাকা জোগাতে মা এখনো দিনের পর দিন অন্যের বাড়িতে সামান্য বেতনে ঝিয়ের কাজ করে। মেধাবী দুই মেয়ে কান্ত মাকে একটু শান্তি দিতে এখনো অন্যের বাড়ি গিয়ে মায়ের বদলে ঝিয়ের কাজ করে দেয়। রুমা আর রুনা জানায়, অনেকেই বিষয়টি ভালোভাবে নেয় না। কিন্তু এই কাজের জন্য তাদের মা যেটুকু বিশ্্রাম পায়, সেটাই তাদের জন্য এখন বড় সান্ত্বনা। মা, মামা ও স্কুল-কলেজের শিক ছাড়াও স্থানীয় প্রাইভেট শিক আব্দুস সাত্তারের সহযোগিতা দুই বোনকে এতটা পথ আনলেও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এরা হতাশাগ্রস্ত। রুমা এখন দেশের প্রতিষ্ঠিত একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে পড়তে চায়। শুধু অর্থই এই স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করে সে এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়েছে
সুবর্ণা খাতুন। সুবর্ণা। এসএসসির পর এবার এইচএসসিতেও গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। নাটোর সদর উপজেলার ছাতনী শিবপুর গুচ্ছগ্রামের সুবর্ণা খাতুনকে দারিদ্র্য এবারো দমাতে পারেনি। কেরোসিন কেনার সামর্থ্য না থাকায় দিনের আলোয় লেখাপড়া করে ২০১২ সালে এসএসসিতে সে জিপিএ ৫ পেয়েছিল। আধপেটা খেয়ে না খেয়ে চলে তাদের সংসার। এসএসসি পাস করার পর সুবর্ণার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। সুবর্ণার মনের ভেতরে চেপে রাখা উচ্চশিার স্বপ্ন যখন ধূলিসাৎ হওয়ার পথে তখন ২০১২ সালের ১২ জুন নয়া দিগন্তে তার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়। ওই প্রতিবেদনে তাদের পরিবারের করুণ কাহিনীসহ উচ্চশিার জন্য সুবর্ণার আকুতি ছিল। এইচএসসিতে সুবর্ণা ভর্তি হয় নাটোরের রানী ভবানী সরকারি মহিলা কলেজে। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর সে আবারো যুদ্ধ শুরু করে। ছাত্রীনিবাসে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যায় সে। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত বাবা কালাম এখনো সুস্থ হয়ে ওঠেননি। অন্যের জমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে মা সারোয়ারা খাতুনের আনা অর্থেই চলে তাদের সংসার। খরচের জন্য মায়ের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে সুবর্ণাদের পুরো পরিবারকে। দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করে এবারো সে এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়ে পাস করেছে। গত দুই বছর যারা তাকে সহায়তা করেছেন তাদের প্রতি সে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। সুবর্ণা জানায়, কলেজের ইংরেজি শিক খালিদ হোসেন তাকে বিনা পয়সায় পড়িয়েছেন। মানবিক বিভাগের ছাত্রী সুবর্ণা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে অনার্স করতে চায়। তার সেই স্বপ্ন পূরণে আবারো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দারিদ্র্য। তাই সে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ বিত্তবানদের কাছে সহায়তা চেয়েছে। সুবর্ণাদের প্রতিবেশী ও ছাতনী উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক আবদুল আলীম জানান, এইচএসসিতে সুবর্ণার ঈর্ষান্বিত ফলাফলে এলাকার মানুষ মহাখুশি। সবার সহায়তা পেলে দরিদ্র পরিবারের এই মেয়ে উচ্চশিায় শিতি হয়ে দেশের সুনাম বয়ে আনবে বলে তারা মনে করেন। তিনি অদম্য মেধাবী সুবর্ণা যাতে দমে না যায়, সে জন্য সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
মেয়েটার লেখাপড়ার আগ্রহ দেখে রাস্তায় রাস্তায় মাটি কেটে খরচ দিতাম
লাভলী খাতুন। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার চকপাড়া গ্রামের হাবিল মণ্ডলের মেয়ে। লাভলী খাতুন দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় বড়াইগ্রাম মহিলা কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ ৫ পেয়েছে। লাভলীর বাবা ভ্যান চালাতেন। বছর তিনেক আগে কোমরে ব্যথা পাওয়ায় তিনি এখন প্রায় শয্যাগত। সংসার খরচ আর মেয়ের পড়াশোনার খরচ জোগাতে মা জরিনা বেগম গ্রামীণ কাঁচা রাস্তায় মাটি কাটার কাজ করতেন। কোমরের হাড় য় আর কিডনিতে পাথর হওয়ায় তাকে কাজ থেকে বাদ দিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। স্ত্রী ও নিজের চিকিৎসা আর সংসারের ব্যয় মেটাতে পৈতৃক নিবাস একই এলাকার মামুদপুর গ্রামের মাত্র দুই শতক জমির বাড়ির ভিটাটি বিক্রি করে দেন হাবিল মণ্ডল। তারপর থেকে চকপাড়া গ্রামে শ্বশুরের বাড়িতে একটি ঘর তুলে কোনো রকমে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেঁচে আছেন। দারিদ্র্য যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে তাদের। কখনো এক বেলা খাবার জুটলে আরেক বেলা জোটে না। ক্ষুধার্ত অসুস্থ বাবা-মায়ের মুখের মলিন চাহনি তার লেখাপড়ার একমাত্র অনুপ্রেরণা। বড় হয়ে সে বিসিএস ক্যাডার হতে চায়। কিন্তু এত অভাবের মধ্যে তার কলেজের ভর্তির খরচই তাদের নেই। তাই কিভাবে মেয়েকে লেখাপড়া করাবেন, এ দুশ্চিন্তার কাছে ভালো ফলাফলের আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে। তার মা জরিনা বেগম আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘মেয়েটার লেখাপড়ার আগ্রহ দেখে রাস্তায় রাস্তায় মাটি কেটে খরচ দিতাম। কিন্তু এখন কাজ করতে পারি না। মেয়েটা এত ভালো রেজাল্ট করেও লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় কাঁদছে। অথচ আমরা কিছুই করতে পারছি না।’
গোল্ডেন জিপিএ ৫ পাওয়া কারিমার উচ্চশিার স্বপ্ন কি শুধু অর্থাভাবে থমকে যাবে
কারিমা খাতুন। নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার তমালতলা মহিলা কলেজ থেকে এবারের এইচএসসি পরীায় মানবিক বিভাগ থেকে গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়েছে। সে একই উপজেলার তমালতলার কাজীর চক মালঞ্চি গ্রামের আবুল কালাম আজাদের মেয়ে। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে সবার বড়। ছোটবোন নবম শ্রেণীতে আর ছোট ভাই পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছে। একটি মাত্র টিনের ছোট ছাপরাঘরে বাবা-মা ও ভাইবোন মিলে পাঁচজনকে গাদাগাদি করে বসবাস করতে হয়। সেই ঘরেই তিন ভাইবোন মিলে একটি মাত্র কেরোসিনের বাতির আলোয় পড়ালেখা করে জিপিএ ৫ পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে দরিদ্র পরিবারের মেয়ে কারিমা। মেধাবী কারিমা এবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে উচ্চশিা গ্রহণ করতে চায়। তার বাবা আবুল কালাম আজাদ সাইকেল মেরামতের কাজ করে কোনো রকমে পাঁচ সদস্যের পরিবারের সংসারের খরচ চালায়। সংসার খরচের পাশাপাশি মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালানোই তার জন্য কষ্টকর। দরিদ্র এই বাবার পে মেয়ের উচ্চশিা গ্রহণের খরচ জোগাড় করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারিমার মা আছমা বেগম বলেছেন, সমাজের হৃদয়বান ও বিত্তবানদের সহযোগিতা না পেলে তার মেয়ে কারিমার উচ্চশিা গ্রহণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। গোল্ডেন জিপিএ ৫ পাওয়া মেধাবী ছাত্রী কারিমার উচ্চশিার স্বপ্ন কি শুধু অর্থাভাবে থমকে যাবে, এটাই এখন তার বাবা-মা ও স্বজনদের একমাত্র চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন শঙ্কা আর উদ্বিগ্নতা তাড়া করছে কারিমা আর তার হতদরিদ্র বাবা-মাকে।
উচ্চশিক্ষার খরচ কোথা থেকে আসবে, ভেবেই হতাশ আয়শা
আয়শা খাতুন। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার মাড়িয়া গ্রামের নৈশপ্রহরী মো: নুরুল ইসলামের মেয়ে। আয়শা খাতুন এবার মৌখাড়া ইসলামিয়া মহিলা ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছে। সে ইতঃপূর্বে এসএসসি পরীাতেও জিপিএ ৫ পেয়েছিল। তার বাবা স্থানীয় বেসরকারি জননী হাসপাতালে সামান্য বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি করেন। বাড়ি-ভিটা ছাড়া তাদের তেমন কোনো সম্পদ নেই। একমাত্র ছেলেকে মাস্টার্স পাস করালেও এখন পর্যন্ত চাকরি মেলেনি। ফলে শিতি বেকার ছেলের ব্যয়ভারও তাকে বহন করতে হচ্ছে। সামান্য বেতনে সংসার খরচ চালানোই তার জন্য যেখানে কষ্টকর, সেখানে মেয়ের উচ্চশিার ব্যয় নির্বাহ তার জন্য রীতিমতো দুঃসাধ্য। আয়শা এসএসসিতে জিপিএ ৫ পাওয়ার পর দু’টি প্রাইভেট ব্যাংকে বৃত্তির জন্য আবেদন করলেও কোনো ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান তার পাশে দাঁড়ায়নি। কলেজের শিকেরা তাকে কিছু বই, খাতা-কলম দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। এবার উচ্চশিা গ্রহণের জন্য জেলার বাইরে গিয়ে অবস্থান করা, কোচিং করা বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া চালানোর খরচ কোথা থেকে কিভাবে আসবে, সেটা ভেবেই হতাশ আয়শা ও তার বাবা-মা।
ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন মুক্তিয়ারার কাছে যেন শুধুই মরীচিকা
মুক্তিয়ারা খাতুন। বড়াইগ্রাম উপজেলার একইমাড়িয়া গ্রামের দরিদ্র রাজমিস্ত্রি আলম সরকারের মেয়ে মুক্তিয়ারা খাতুন বড়াইগ্রাম মহিলা কারিগরি অ্যান্ড বিএম কলেজ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছে। তার বাবা অন্যের অট্টালিকা গড়ে দিলেও নিজস্ব জমি না থাকায় একখণ্ড খাস জমিতে বাড়ি করে বসবাস করছেন। রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়ে কোমরে আঘাত পেয়ে ডান পায়ে ঠিকমতো রক্ত চলাচল করছে না বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। ফলে প্রায় ছয় মাস কোনো কাজ করতে পারছেন না তিনি। তিন বেলা ঠিকমতো খাবার জোটানোই যেখানে দুঃসাধ্য, সেখানে মেয়ের ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন তার কাছে যেন শুধুই মরীচিকা।
অপরাজিতাবিডি ডটকম/এসআই/আরআই/এ/০১সেপ্টেম্বর ২০১৪ই.