banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 530 বার পঠিত

 

স্মৃতিটুকু নিস্তরঙ্গ

স্মৃতিটুকু নিস্তরঙ্গ


সুমাইয়া তাসনিম


আমার কাছে শেষ বলে আসলে কিছু নেই। যতদিন মানুষ বেঁচে থাকে ততদিন তার জীবনের কোনো গল্পের কোনো অধ্যায়ই একেবারে শেষ হয়না। তবু দিন শেষে কিছু কিছু চেনাপথ শত অভ্যস্ততা মুছে রোজকার রুটিন থেকে বাদ পড়ে যায়। কেবল স্মৃতিটুকু নিস্তরঙ্গ পুকুরে অবসন্ন দুপুরে টুপ করে ঝরে পড়া পাতার মত হাল্কা ঢেউ তোলে মাঝেমাঝে। এক বছর বেশি সময় লাগার পরও শেষ ক্লাস পাঁচ বছরের সময়টাকে যেন একটা মালায় গেঁথে ফেললো। যেন একটা পুতির মালা গাঁথা অবশেষে শেষ হলো। আর একটি দিনও বাকি নেই ক্লাসের। আর একটি পুতিও হাতে নেই গাঁথবার।

কাল শেষ ক্লাস শেষে অনেকক্ষণ বসে বসে মেয়েদের র‍্যাগডে প্রিপারেশন দেখলাম। তারপর ফুটপাতের হলুদ টাইলসগুলো ধরে হাঁটতে হাঁটতে পলাশি পেরিয়ে রাহির ডিপার্টমেন্টে গেলাম। ওর কাজ শেষে একসাথে বাসায় ফিরলাম। ক্লাস শেষে একসাথে ফেরা আর কবে হবে কে জানে!

আমরা যখন ইডেনে ভর্তি হই তখন ইডেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ন্যাশনালে প্রায় সবাই ভর্তি হয় একটা চাপা কষ্ট নিয়ে। আরেকটু ভালো প্রিপারেশন নিলে আরেকটু ভালো কোথাও থাকতাম এই উপলব্ধি আসে সহসাই। আমি তেমনটা ভেবেছিলাম কিনা মনে নেই। তবে পছন্দের বিষয়ে পড়তে পারায় আর কোনো কষ্ট ছিলো না।

আমার শুরুটা ছিলো সরকারি কলোনির স্কুলে। তারপর মাদরাসার দোতলা ভবন আর ছোট্ট মাঠের গন্ডি, যেখানকার টিচাররা এখনো দেখলে খুশি হয়ে যান। তারপর জেলখানার মত ঢাকা সিটি কলেজ, অনেক দিন পর্যন্ত ঘুরানো প্যাচানো সিড়ি ডিঙ্গিয়ে নিজের ক্লাস কোনটা তাই খুঁজে পেতে কষ্ট হয়ে যেতো। তারপর আসলাম ইডেনে। সিটি কলেজের মাঠ ছাড়া এসি রুমের বদ্ধ পরিবেশ আমার মত মানুষের জন্য না সেটা বেশি টের পেয়েছিলাম ইডেনের মুক্ত হাওয়ায়। ক্যাম্পাসে পা দিতেই ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে আসবে প্রকৃতির আবহে। এত্ত রকমের গাছ, এত্তরকমের পাখির ডাক, এত্ত রঙের ফুল.. আহ…! বাইরের কোনো মানুষ ছাড়া নিজেদের একটা রাজ্য মনে হয়। এত্ত মেয়ে একসাথে আমি এর আগে দেখিনি। সবাই নিজের মত পড়ছে, খাচ্ছে, কাজ করছে, আনন্দ করছে, নিজের মত সময় কাটাচ্ছে। ভিন্ন একটা জগৎ যেন! কতদিন পুকুরপাড়ের বেঞ্চে শুয়ে শুয়ে জীবনের কত প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি ভাবনায়। বিশাল মাঠের কোণের ছোট ক্লাবটায় তাইকোয়ান্ডো প্র‍্যাকটিস করতে করতে হারানো আত্মবিশ্বাস আবার খুঁজে পেয়েছি নিজের ভেতরে। ধবধবে সাদা ড্রেসটা গায়ে চাপালেই শরীরে একটা অদ্ভুত জোর পেতাম। সব শক্তি দিয়ে একেকটা কিক আর পাঞ্চ মেরে দুইঘন্টার প্র‍্যাকটিস শেষে ক্লান্ত হয়ে হাভাতের মত নাশতা করতাম হলের ক্যান্টিনে। পড়াশোনার মান নিয়ে আমার বরাবরই আপত্তি ছিল কিন্তু একসময় সেটা মেনে নিয়েছিলাম। বুঝে নিয়েছিলাম এখানে প্রেশার করার কেউ নাই। লক্ষ্য ঠিক করে নিজেকেই চেষ্টা করতে হবে৷ একদিকে ভালোই ছিলো, প্রচুর এক্সট্রা কারিকুলার এ্যাক্টিভিটিজ তেমন কোনো জটিলতা ছাড়াই করতে পেরেছিলাম।
ইডেনের বিশাল ক্যাম্পাস পুকুরঘাট আর পুকুরের মাছগুলোকে পর্যন্ত এই যাবার কালে আপন মনে হচ্ছে। কলেজ বাসের দিনগুলোতে গল্প করতে করতে কখন পথ ফুরিয়ে যেতো টের পাওয়া যেতোনা। সেই লাল কলেজ বাস “চন্দ্রমল্লিকা” তোরে মিস করবো। সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের করিডর, মিস করবো। ডিপার্টমেন্ট থেকে নামলেই ফুচকা, ভেলপুরি, আঁচার, চাটনি, ফলের জুস, কিমা পরোটা, খিচুড়ি, ফ্রাইড রাইস, শীতের ভাপা পিঠা আর নানাপদের ঝাল ঝাল ভর্তা দিয়ে চিতই পিঠা খেয়ে পেট ভরানোর দিনগুলো মিস করবো। ইডেনের প্রত্যেকটা ফুল গাছ, লাইব্রেরির টেবিল-চেয়ার, ক্লাসরুম আর পুরানো বেঞ্চগুলো, ছাদ আর ল্যাবরুম, সেমিনারের বইগুলো, মিস করবো খুব। টিচারদের আর হাসি, কান্নায় ভরপুর মেয়েগুলোকে মিস করবো।।

*এই ছবিগুলো ইডেনে বিভিন্ন সময়ে তোলা। ছবিগুলোর আসল কপি গুলো হারিয়ে ফেলেছি ত মনে হলো এই পোস্টের সাথে থাকুক।

Facebook Comments