অসাধারণ প্রাকৃতিক শোভা ভোলাগঞ্জের। সঙ্গে বাড়তি পাওনা ধলাই নদের সৌন্দর্য। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়ে সিলেটের মৌলভিবাজার জেলার কমলগঞ্জ দিয়ে আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে। সিলেটের ভোলাগঞ্জের কাছে এসে আবার সে ভারতের মেঘালয় পর্বতমালার কোলঘেঁষে বয়ে গেছে। এই অক্টোবর মাস পর্যন্ত ভোলাগঞ্জ বেড়াতে যাওয়ার সেরা সময়। এখানে ধলাই নদের অসাধারণ রূপ, সারি সারি পাথর তোলার দৃশ্য, সবুজ পাহাড়ে বন্দী সাদা পাথর আর পাহাড় থেকে পাথরছুঁয়ে গড়িয়ে পড়া স্ফটিক-স্বচ্ছ জল যে দেখবে সে-ই মুগ্ধ হবে। সেই সাদা পাথরের স্বচ্ছ জলে গোসল করে কাটিয়ে দিন দারুণ একটি দিন।
বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল সিলেটের বাদাঘাট থেকে। চলা শুরুর একটু পরই বিশাল সুরমা নদী সরু হয়ে গেল। এরপর সুরমার শাখা নদী দিয়ে চলা শুরু করলাম। স্বচ্ছ দেখে এক আঁজলা জল মুখে মাখলাম, পা ঝুলিয়ে দিলাম নদীর জলে। এভাবেই একসময় আমাদের বজরাটি গিয়ে পড়ল বিশাল এক বিলে। বিলের দুপাশ অসাধারণ সবুজ। বিল থেকে আমরা ছোট্ট এক খালে এসে পড়ি। স্থানীয় লোকজন যাকে চেনেন কাটা গাঙ হিসেবে। একসময় ছোট্ট নালার মতো ছিল, মাঝখানে দিয়ে রাস্তা। নালা বড় করে পানির ব্যবস্থা করতেই খালটি কাটা হয়। সেই থেকে এর নাম কাটা খাল, কেউ কেউ বলেন কাটা গাঙ। কাটা গাঙের পাশের গ্রাম উমরগাঁওয়ে প্রথম যাত্রাবিরতি। চা পান করে আবার আমাদের যাত্রা শুরু, এখনো অনেকটা পথ যেতে হবে।
ট্রলারের গতি বেড়ে যায়। আমরা বাঁ দিকে পাহাড় আর ডান দিকে সবুজ গ্রাম দেখে দেখে ভোলাগঞ্জর দিকে চলতে থাকি। আবার যাত্রাবিরতি, কোম্পানীগঞ্জ বাজারে। বাজার ঘুরে দেখি। চলে আসি বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের চত্বরে। ২০০২ সালে স্থাপিত এই স্কুলটির শহীদ মিনারটি দেখার মতো। আবার চলা। কোম্পানীগঞ্জ যতই পেছনে পড়ছিল, ততই চোখের সামনে স্পষ্ট হচ্ছিল ভোলাগঞ্জ। ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে আর মেঘালয় রাজ্য। এটি দেশের সবচেয়ে বড় পাথর কোয়ারি এলাকা। ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার দূরত্বের রোপওয়ে বা রজ্জুপথ। যদিও ১২ বছর ধরে রোপওয়েটি অব্যবহৃত। আমাদের সামনে এখন খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়। এই পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে কিছুটা ছন্দপতন ঘটায় পাথর ভাঙার যন্ত্রের বিকট আওয়াজ। যন্ত্রের গর্জন-তর্জনে ধলাই নদ পেরিয়ে এরই মধ্যে আমরা চলে আসি ভোলাগঞ্জ বাজার। এখানে ট্রলার পরিবর্তন। এরপরের গন্তব্য সাদা পাথর এলাকা।
শান্ত পাহাড়, সঙ্গে মিশেছে আকাশের নীল। আকাশে ছোপ ছোপ শুভ্র মেঘ। আমরা জিরো পয়েন্টে দৃষ্টি ফেলি। চারদিকে পাথর আর পাথর—সব পাথর সাদা রঙা। পাথর তোলার প্রচুর নৌকা চোখে পড়ল, তবে এখানে দর্শনার্থী নেই। সাদা পাথরের অসাধারণ এক এলাকায় আমরা পা রাখি। সামনে সবুজ পাহাড়; পাশেই পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া প্রচণ্ড স্রোতের স্বচ্ছ শীতল জল আর সে জল থেকে গড়িয়ে নামা সাদা পাথর—কী অপরূপ দৃশ্য, তা বলে বোঝানোর নয়! আমরা পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া শীতল জলে ঝাঁপিয়ে পড়ি, আহা কী ঠান্ডা! একসঙ্গে এত এত সাদা পাথর জীবনে কখনো দেখিনি, ভাবতে ভাবতে আর সাদা পাথর দেখে দেখে, সেই সঙ্গে পাথর জলে গোসল করে সময় এগিয়ে যায়। এভাবে কখন যে পাহাড়ি রোদ তার কোলে আশ্রয় নিয়েছে টেরই পাইনি। অন্ধকার জেঁকে বসার আগেই তাই সেই অসম্ভব সুন্দরকে বিদায় জানাই!
কীভাবে যাবেন?
অক্টোবর মাস পর্যন্ত ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর এলাকায় যাওয়ার মোক্ষম সময়। সিলেট শহর থেকে ভোলাগঞ্জের দূরত্ব ৩৩ কিলোমিটারের মতো। এই পথে কোনো বাস চলাচল নেই, কোনো লেগুনা চলে না। যাতায়াতের একমাত্র বাহন সিএনজিচালিত অটোরিকশা, জনপ্রতি ভাড়া ২৫০ টাকা। রাস্তাটা বেশ খারাপ। তাই নদীপথ বেছে নেওয়াই ভালো। জনপ্রতি খরচ হবে ২০০ টাকা করে। ভোলাগঞ্জ থেকে সিলেট বাদাঘাটের শেষ ট্রলার ছেড়ে আসে বিকেল চারটায়। সে ক্ষেত্রে সময়ের ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে। নদীপথে যাতায়াতে একটু বাড়তি সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। সম্ভব হলে সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট রাখবেন। শুকনা খাবার ও প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ সঙ্গে রাখবেন।