সোনার হরিণ (দুই)
ফাতিমা মারিয়াম
কয়েকদিনের মধ্যেই বিয়ের বিষয়টি বাসায় জানাজানি হয়ে গেল। মা, ভাবী এবং অন্যরা আনিসের কাছে তার পরবর্তী পদক্ষেপ কি তা জানতে চাইলো। সে বলল, ‘ আর কিছুদিন পরে আমি আমার পরিবারে এই বিষয়টি জানাব। ততদিন আমাকে সময় দিন।’ সবাই আনিসের কথাই মেনে নিলো।
আনিস এখন প্রায়ই রীতাদের বাসায় আসে। পরিবারের অন্যরাও যেহেতু বিয়েটা মেনে নিয়েছে তাই ওদের আর কোন সমস্যাই রইলো না। নিশ্চিন্তভাবে দুজনে ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগলো।
কয়েক মাস হল বিয়ে হয়েছে। কিন্তু আনিস তার পরিবারকে এখনও কিছু জানায়নি। রীতাও চাইছে বিষয়টি পারিবারিক ভাবে সমাধান হোক। এদিকে সে এখন নিজের ভিতরে আরেকজনের অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। এই অবস্থায় রীতাদের পরিবার থেকেও আনিসকে বলা হচ্ছে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলতে। আনিস ওদের কাছে আরও সময় চায়। এভাবে সে বারবার একই কথা বলে সময় পার করতে থাকে। কিন্তু তার পরিবারকে জানানোর কোন উদ্যোগই নেয় না। ফলে রীতার পরিবারের সবাই ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে যায়।
এই পর্যায়ে রীতার বড়ভাই এবং কয়েকজন আত্মীয় মিলে সিদ্ধান্ত নেয় এবার আনিস এই বাসায় আসলে তারা ওকে কড়াকড়ি ভাবে বলবে যেন সামাজিকভাবে রীতাকে পরিবারের বউ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যবস্থা করে। আনিস আসলো এবং যথারীতি সময় চাইলো। এক পর্যায়ে বড়ভাই এবং আরও দু একজনের সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হল। রীতা এসে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে আনিসকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গেল।
সেই রাতে পরিবারের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নিলো আনিসকে ভোরবেলা কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। তারা আনিসকে হাত পা বেঁধে পিটানোর পরিকল্পনা করেছিল। তখন রীতা ঘুমে থাকবে সে বাধা দিতে পারবেনা। শাস্তি দেয়ার পর আনিসও ভয় পেয়ে রীতার ব্যাপারে ইতিবাচক কিছু চিন্তা করবে। তারা এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রীতা এবং তার অনাগত সন্তানের ভালোর জন্যই।
রীতা কিভাবে যেন এই পরিকল্পনার কথা জেনে যায়। সে ভোর হওয়ার অনেক আগেই স্বামীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলো এবং যত দ্রুত সম্ভব এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বলল। আনিসকে বিদায় দিয়ে সে আবার শুয়ে রইলো যাতে কেউ টের না পায় যে আনিস চলে গেছে এবং আনিস যাতে আরও দূরে যাওয়ার কিছুটা সুযোগ পায়!!!
পরিকল্পনা মাফিক সবাই ভোরবেলা রীতার রুমের সামনে আসলো। দরজায় শব্দ শুনে রীতা উঠে দরজা খুলে দিলো। বড়ভাই ওর কাছে জানতে চাইলেন, ‘আনিস কোথায়?’ সে মিথ্যা জবাব দিল, ‘ আমি জানিনা। আমি ঘুম ভাঙার পর থেকেই ওকে দেখতে পাচ্ছিনা।‘
সবাই চারপাশে বহু খোঁজাখুঁজি করলো। রীতা কাউকে সত্যি কথাটা তখনও জানায়নি। সে চুপচাপ রইলো। মনেমনে তার দৃঢ় বিশ্বাস আনিস তার কাছে আবার ফিরে আসবে। সন্তান জন্মাবার আগেই তাকে সসম্মানে ঘরে তুলে নেবে!
কিন্তু ওটাই ছিল আনিসের রীতাদের বাসায় সর্বশেষ আসা।
দিন যায়……মাস যায়……রীতা অপেক্ষা করে…… আনিস আসবে।
কিন্তু সে আর আসেনা। তার ভাই ও অন্য আত্মীয়রা চেষ্টা করেছে আনিসকে খুঁজে বের করতে। কিন্তু সেই যুগে তো আর এত উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলনা। ফলে আনিস খুব সহজেই নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছিল।
যথাসময়ে রীতা এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলো। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রীতা তার সব দুঃখ অপমান ভুলে থাকার চেষ্টা করে। তার মনে আশা…… আনিস একদিন এসে তাদের মা ছেলেকে ওর বাড়ি নিয়ে যাবে।
দিনদিন ছেলে বড় হচ্ছে। তার খরচ বাড়ছে। বাচ্চার জন্য এটা ওটা কিনতে হয়। নিজেরও কিছু ব্যক্তিগত খরচ আছে। বাবা আর বড়ভাইয়ের কাছে কত আর হাত পাতা যায়!!! সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে তার ও তার ছেলের এইসব খরচের ব্যবস্থা তাকেই করতে হবে। আনিস আজ পর্যন্ত কোনরূপ যোগাযোগ করেনি। নিরুপায় হয়ে ছেলের জন্মের কয়েকমাস পরে রীতা চাকুরীর সন্ধান করতে লাগলো।
কিন্তু তার এই শিক্ষাগত যোগ্যতায় কোন কাজ পাওয়া তার জন্য কঠিন হয়ে গেল। অনেক চেষ্টার পর অবশেষে পরিচিত একজনের মাধ্যমে একটি হাসপাতালে আয়া হিসেবে সে তার কর্মজীবন শুরু করলো। সেই যুগে একটি মেয়ের জন্য আয়ার চাকুরী করা যে কত কঠিন ছিল তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।
চাকুরীর শুরুতে পরিবার থেকে তাকে বাধা দেয়া হয়। তার অভিভাবকরা তাকে জানায় যে তার ও তার ছেলের সব ভরণপোষণ পরিবার থেকেই করা হবে। সে যেন এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে। ঐ চাকুরীতে সে যেন আর না যায়! কিন্তু সে এ ব্যাপারে অনড় থাকল। কোন বাধাই সে মানল না। তাই ঘরের মানুষরা এই ব্যাপারে হাল ছেড়ে দেয়।
কিন্তু সমস্যা শুরু হয় অন্য জায়গায়। প্রতিবেশীরা তার এই চাকুরী করাটা কোনভাবেই মানতে পারছিলনা। ফলে তাকে অনেকেই অনেকভাবে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। পাড়ার কয়েকজন সিনিয়র ভাই তার হাসপাতালে যাওয়া আসার সময়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাকে উত্যক্ত করত। নানা রকম কটু ও অশ্লীল কথা বলতো। সে কোন কিছুর পরোয়া না করে হাসপাতালে যেতে থাকে। একসময়ে তারাও হাল ছেড়ে দেয়।
পরিবার ও সমাজের সকল বাধাকে উপেক্ষা করে রীতা দৃঢ় মনোবল নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকলো। ওর ছেলের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে বড় ভাবীর উপর দিয়ে দিলো। এছাড়া তার পক্ষে কোনভাবেই চাকুরীটা করা সম্ভব হতনা। বড় ভাবিও নিজ সন্তানের মত করেই ছেলেটিকে লালনপালন করতে থাকে।
রীতার দিন কেটে যাচ্ছে। সে প্রতিদিন ভোরবেলা হাসপাতালে যায়……আর সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফেরে। বাবার বাসায় থাকে। ফলে থাকা খাওয়ার জন্য তার কোন খরচ নেই। যা বেতন পায় তা দিয়ে মা ও ছেলের অন্যান্য খরচ চলে যায়। ছোট ভাইবোন ও পরিবারের অন্য বাচ্চাদের শখের জিনিসগুলো কিনে দেয়। বাহ্যিক ভাবে দিন ভালোই কেটে যাচ্ছে………।
ছেলে দিনদিন বড় হচ্ছে। রীতা আবারও আনিসের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। কিন্তু সে এবারও ব্যর্থ হয়। মানুষটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, শুভাকাঙ্ক্ষী সকলের শত প্রশ্নের সামনে সে বোবা হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে অনেকের কটু কথাও হজম করতে হয়। চোখের পানি আর দীর্ঘশ্বাস সম্বল করে দেখতে দেখতে ৫/৬ বছর কেটে গেল।
চলবে…