সোনার হরিণ (চার)
ফাতিমা মারিয়াম
মালা অতি দরিদ্র ঘরের মেয়ে। অসম্ভব রূপবতী। ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড়। তার দরিদ্র পিতা সব জেনেশুনেই মেয়েকে এখানে বিয়ে দিলেন। ঢাকায় জামাইয়ের পরিবারের নিজস্ব বাড়ি আছে। শফিক যদিও খালার পরিবারেই মানুষ তবুও পরিবারের সবাই তাকে এই পরিবারের একজন হিসেবেই গণ্য করে। তাই বেকার হওয়া সত্ত্বেও মালার বাবা বিনা বাক্যব্যয়ে মেয়েকে শফিকের কাছে বিয়ে দেন। পরিবারের অবস্থা ভালো। এখানে মেয়ে খেয়ে পরে সুখে থাকতে পারবে।
আগের বউকে এরা কখনোই মেনে নেবে না। তাই মালাই হবে পরিবারে শফিকের স্বীকৃত বউ। আর তাছাড়াও আগের বউ যেহেতু নিজেই চাকুরী করে শফিক পরবর্তীতে যা-ই রোজগার করুক না কেন ওদিকে বেশি কিছু দিতে হবেনা। এসব কিছু ভেবেই তিনি এই ঘরে মালাকে বিয়ে দিলেন। মালাও পরিবারের সিদ্ধান্ত চুপচাপ মেনে নিলো। আর মেনে না নিয়েই বা করবে কী? সীমাহীন দারিদ্র্য তাদের সবাইকে এই পথে আসতে বাধ্য করেছে।
বিয়ের প্রায় এক/দেড় মাস পরে মালা শ্বশুরবাড়িতে আসলো। এদিকে শর্ত অনুযায়ী পরিবারের পক্ষ থেকে শফিককে ব্যবসা করার জন্য টাকা দেয়া হল। ঐ টাকা দিয়ে সে ছোট একটি রেস্টুরেন্ট দিলো। ব্যবসা মোটামুটি চলছে।
শফিকের দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনাটা রীতা প্রথমে টের পায়নি। মালা ঢাকা আসার আগেই তার কানে কিছু কিছু কথা এসেছিল। কিন্তু সে বিশ্বাস করেনি। শফিকের কাছে জানতে চাইলে সে সবকিছু অস্বীকার করলো। রীতাও তাই বিশ্বাস করে।
কিন্তু মালা ঢাকায় আসার পর এক কান দুই কান হতে হতে রীতার কানে আবার কথাটা আসে। এবার অনেক প্রত্যক্ষদর্শীও সাক্ষী দিলো। প্রতিবেশীদের অনেকেই মালাকে দেখে এসে রীতার কাছে বলে দেয়। রীতা নিজেও কিছু প্রমাণ সংগ্রহ করে।
অবশেষে সে নিশ্চিত হয়ে শফিককে জিজ্ঞাসা করলো। এবার সে সব কিছু স্বীকার করলো। রীতা একেবারেই ভেঙ্গে পড়ে। খুব কান্নাকাটি করতে থাকে। মা, ভাবী এবং প্রতিবেশীরা তাকে এসময় বুঝায়, ধৈর্য ধারণ করতে বলে। তার শারীরিক অবস্থা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে সে চুপ করে যায়।
কিছুদিন পরে রীতা শফিককে সাথে নিয়ে ঐ বাসায় গিয়েছে মালার সাথে দেখা করতে। মালার সাথে কথাবার্তা বলেছে। সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছে। কারণ তার ধারণা ছিল সে যদি মালাকে সহজভাবে গ্রহণ করে নেয়, তবে শফিকসহ অন্যদের মন জয় করা তার জন্য সহজ হবে। তার বোকামি ও ভুলের কারণে আজ ছেলেটি পিতৃ-পরিচয়-হীন! তাই পরবর্তী সন্তান যেন এ সমস্যায় না পড়ে এজন্য সে আজ মনে অনেক কষ্ট চেপে রেখে এই ধরণের সামাজিকতা করে যাচ্ছে!
শফিক প্রায়ই আসে। তার খোঁজ খবর নেয়। এটা ওটা কিনে দেয়।
দিন যায়……।
কিছুদিন পরে রীতার একটি ছেলে হল। ছেলে হওয়ায় শফিক বেশ খুশী। রীতাও খুশী… রীতার শ্বশুর শাশুড়ি সহ সবাই নিয়মিত রীতা ও তার পুত্রকে দেখতে আসে। এমনকি স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সবার মন রক্ষা করতে মালাও কয়েকবার এসেছে।
দেখতে দেখতে ছেলের বয়স কয়েকমাস হয়ে গেছে। এবার রীতা আলাদা বাসা নিলো। সংসার এখন বড় হয়েছে। বাবার বাসায় আর কত থাকা যায়! যদিও বাসার কেউ তাকে কখনই এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি, তবুও সে নিজ সিদ্ধান্তেই বাসা নিলো।
বাবার বাসার কাছাকাছি বাসা ভাড়া করেছে। যেহেতু সে সারাদিন বাইরে থাকে তাই সংসার ও ছেলের দেখাশোনা করার জন্য দুঃসম্পর্কের এক ফুফু শাশুড়িকে রীতা নিয়ে এলো। রান্নাবান্না, ছেলেদের দেখাশোনা, সংসারের আর সব কাজ ফুফু করে।
সংসারে খরচ এখন অনেক বেড়েছে। শফিক সহযোগিতা করে, রীতার বেতনও এখন আগের চাইতে বেশি। সংসার বেশ ভালোই চলছে।
প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনরা বিপদে আপদে তাকে ডাকে। রাতবিরেতে কারো কোন সমস্যা হলে সবার আগে রীতাকে খবর দেয়। সে ছুটে যায়! গর্ভবতী মায়েদেরকে গর্ভকালীন পুরো সময় সে দেখাশোনা করে। কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, কোন ডাক্তার ভালো, কোথায় কি সুবিধা আছে এসব ব্যাপারে সে পরামর্শ দেয়। এর বিনিময়ে সবাই তাকে পারিশ্রমিক দেয়।
দিন যাচ্ছে……।
শ্বশুর বাড়ীর যে কোন কারও অসুখবিসুখেই সে ছুটে যায়। ফলে দিনদিন ওখানেও তার কদর বাড়ছে। রীতার ছেলের বয়স যখন এক/দেড় বছর তখন সে জানতে পারল মালার বাচ্চা হবে। পুরো সময়টা সে মালাকে দেখেশুনে রাখল। যখনই সময় পায় ঐ বাসায় গিয়ে মালাকে দেখে আসে। বাচ্চা হওয়ার সময় মালাকে সে তার হাসপাতালে নিয়ে গেল। মালার একটি ছেলে হল।
মালার ছেলের বয়স যখন কয়েকমাস তখন অশান্তি শুরু করলো মালা।
সে দেখছে রীতা তার সংসার বেশ গুছিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সে এখনও খালা শাশুড়ির পরিবারের অধীনে। উনাদের সাথে মাঝে মধ্যে একটু আধটু মন কষাকষি হয়। দুই চারটি কটু কথাও হয়। কেউ কাউকে ছাড় দেয়না। মাঝে মাঝে খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে ঘরের সবার সাথে এমন কি স্বামীর সাথেও তুলকালাম কাণ্ড করে।
দিনদিন ঝগড়া ঝাটি বেড়েই চলেছে। এখন তার একটাই দাবী-তাকে আলাদা বাসা ভাড়া করে আলাদা সংসারে রাখতে হবে। পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিলো তখন শফিক বাধ্য হল মালাকে আলাদা সংসার করে দিতে।
চলবে..