চা-বাগানের সবুজ-শ্যামল পথ পেরিয়ে ব্যবস্থাপকের বাংলোর আঙিনায় ঢুকতেই ভিন্ন এক জগৎ। পরিপাটি নানা জাতের গাছ। প্রতিটি গাছেরই কোথাও যেন রয়েছে এক মায়ার ছোঁয়া। কারও শিল্পিত হাতের পরশ প্রতিটি গাছকেই সৌন্দর্য প্রকাশের শক্তি দিয়েছে। বিভিন্ন জাতের বট, পাকুড়, হিজল, তমাল, জাম, আমলকী, শেওড়া, জারুল, ডুমুর, ডালিম, কদম, নিম, জামরুল, বাবলা, কৃষ্ণচূড়া, কামরাঙা, বকুল, অশোক, কুল, পাইন, বাঁশ, তেঁতুল, আম, কাঁঠাল, জলপাই, সফেদা, বিভিন্ন প্রকার ফুলসহ অনেক প্রজাতির শতাধিক গাছ।
সেলিনা পারভিন চেনা-অচেনা কিংবা বিলুপ্তপ্রায় গাছের সমারোহ ঘটিয়েছেন তাঁর আঙিনায়। কুষ্টিয়ার মেয়ে সেলিনা পারভিন কলেজে পড়ার সময় নিয়মিত ম্যাগাজিন পড়তেন। সেই ম্যাগাজিনে প্রকাশিত পছন্দের বিষয়ের লেখাগুলা কেটে রাখতেন। একদিন কুষ্টিয়ারই ছেলে কাজল মাহমুদের সঙ্গে ঘর-সংসার পাতলেন। স্বামীর কর্মস্থল মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার গাজীপুর চা-বাগান। চলে এলেন এখানে। কাজল মাহমুদ ওই চা-বাগানের ব্যবস্থাপক।
চা-বাগানের নীরব-নিভৃত, কোলাহলমুক্ত স্থানটিই যেন তাঁর ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সৃষ্টিমুখরতাকে জাগিয়ে তুলল। প্রশিক্ষণ ছাড়াই ম্যাগাজিন থেকে কেটে রাখা লেখাগুলো পড়ে, ছবি দেখে হাত দিলেন নতুন এক শিল্পে। যার নাম বনসাই। সেটা ১৯৯৮ সালের কথা। বললেন, ‘কেউ প্রশংসা করবে। এ জন্য কাজটি করিনি। নিজের ভেতরের ভালো লাগা থেকেই কাজটিতে হাত দেওয়া।’
সেই যে শুরু হলো। ধীরে ধীরে বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করলেন গাছ। টবে লাগানো হলো। কোনোটি পুরোনো গাছের গোড়ায় জড়িয়ে দেওয়া হলো। এক নিবিড় শ্রম ও অধ্যবসায় পেয়ে বসে তাঁকে। গাছটির বয়স হচ্ছে, কিন্তু ওটা একটি সীমিত উচ্চতায় আটকে আছে। গাছটির সারা শরীরজুড়ে লাবণ্যের কমতি নেই। সবুজ পাতা, অনেক বছরের আলো-জল খাওয়া শাখাগুলোও সময়ের সমৃদ্ধ মেজাজ নিয়ে দুলছে। এই পরিবেশটাকে গাছের শরীরজুড়ে ধরে রাখতে লাগে অনেক সময় ও পরিচর্যা। দিতে হয় নিয়মিত সেচ ও সার। সামান্য হেলাফেলার সুযোগ নেই। স্বামী, ১ ছেলে ও ১ মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসারে বনসাইগুলোও সমান যত্ন-আত্তি পায়। এই কাজটির মধ্য দিয়ে চার দেয়ালে আটকে না রেখে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করেছেন তিনি।
স্বামী কাজল মাহমুদ সমানে তাঁকে উৎসাহ জুগিয়ে চলছেন। সেলিনা পারভিনের শিল্প সৃষ্টির এই কাজ এখন আর তাঁর নিজের পরিধিতেই আটকে নেই। তাঁর এই বনসাই দেখে বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটি তাঁকে সদস্য করেছে। তিনি বনসাই সোসাইটির একাধিক প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। প্রশংসিত হয়েছেন। ২০১৫ সালে তাঁর প্রদর্শিত বনসাই পেয়েছে প্রথম পুরস্কার। বাণিজ্যিকভাবেও বনসাইয়ের সম্ভাবনা আছে। অনেকেই ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি কিংবা গাছের প্রতি মমতা থেকেই নানা জাতের বনসাই কিনে থাকেন। একটি বনসাইয়ের দাম ১ হাজার থেকে ৪-৫ লাখ টাকাও হতে পারে। তিনি এ পর্যন্ত প্রদর্শনীতে ১ থেকে ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত একেকটি বনসাই বিক্রি করেছেন। পরিবহনের অসুবিধার জন্য প্রদর্শনীতে নেওয়া বনসাইগুলো ছিল ছোট আকারের।
সেলিনা পারভিন বলেন, ‘অনেকে মনে করছেন এটাকে ছোট করে রাখা হয়। এটা আসলে ঠিক না। বরং এ চর্চার মাধ্যমে গাছের আরও প্রসার বাড়ছে। দেখা যাবে অনেক গাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এই চর্চার মাধ্যমে অনেকে অনেক গাছ এখন চিনতে পারছে। বনসাই প্রদর্শনীতে এসে অনেকে প্রকৃতিপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।’
বনসাইচর্চার পাশাপাশি তিনি বনসাইয়ের ওপর বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করেন। ছবিও আঁকেন। বই পড়েন। লেখেন কবিতা। সেলিনা পারভিন নিজের শিল্পসত্তাকে ঘর-সংসারের গতানুগতিকতায় বেঁধে না রেখে মুক্ত করেছেন শিল্পের আঙিনায়। তাঁর উঠোনজুড়েই প্রকৃতির রাগ-রং ফুটে আছে।