নিভৃত স্বপ্নচারিণী
মুখ আর মুখোশের যে পার্থক্যের কথাটা বলা হয় সেটা মূলত বলা হয় অন্যদের সাথে আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু মুখ ও মুখোশের এই যে আবডাল এটা কিন্তু ব্যক্তির নিজের সাথেও বিদ্যমান থাকে অনেক ক্ষেত্রেই। যেমন নিজের কোন দোষ কিংবা বদভ্যাস জানা থাকার পরেও জোর করে অজ্ঞাত সেজে থাকা। কিছুতেই নিজের কোন ঘাটতিকে স্বীকার করতে না চাওয়া। নিজের সাথে এই যে আড়াল, এই যে লুকোচুরি এর ফলেও মনের ঘরে বাসা বাঁধে নানান ধরণের মানসিক অস্থিরতা, দোটানা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, দোদুল্যমনতার।
মুখ আর মুখোশের ব্যবধান ঘুচিয়ে কিভাবে একজন ব্যক্তি সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে সেই সম্পর্কে জানতে গিয়েই জেনেছিলাম সেলফ হিপনোটিজম পদ্ধতি সম্বন্ধে। বিষণ্ণতার মেঘকে উড়িয়ে মনের বিষাদ কাটিয়ে বিশ্বাসের সূর্য থেকে নিঃসৃত আশার কিরণে কিভাবে নতুন করে সম্মুখে এগিয়ে চলার উৎসাহ পাওয়া যায় সেই ফমূর্লাই হচ্ছে সেলফ হিপনোটিজম।
মূলত আমাদের হতাশা, নিরাশা, দুরাশা, হাল ছেড়ে দেয়া, নিস্তেজ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি নেতিবাচক আচরণ সমূহের আসল কারণ আমরা নিজেদের নিয়ে একদমই ভাবি না।
অথচ নিজেকে নিয়ে চিন্তা করাটা খুব বেশি জরুরী। আত্মবিশ্লেষণ, আত্নপর্যালোচনা, আত্নসমালোচনা ব্যক্তিকে শুধু যে উন্নতির দিকে ধাবিত হতেই সহায়তা করে তাই নয়। ব্যক্তির সামনে উন্মোচন করে তার নিজেকে, তার আপনার আমিকে। আমরা প্রায় সময়ই নিজের কোন কথা-কাজ বা আচরণের পেছনে কোন রিজন বা লজিক খুঁজে পাই নাং। অন্যদের সাথে সাথে নিজেরাও হয়রান, পেরেশান হই নিজের কর্মকান্ডে। এর কারণ নিজের সম্পর্কে অজ্ঞতা।
নিজের চিন্তা ও কর্মের উপর নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন নিজের সম্পর্কে জানা। আবার জানতে হলে নিজেকে বুঝতে হবে এবং বুঝতে হলে নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে। কেননা নিজেকে নিয়ে ভাবলেই নিজের মুখোমুখি হওয়া যায়।
আসলে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই কিছু ভালো এবং কিছু মন্দ দিক আছে। নিজের উত্তম গুণাবলী সম্পর্কে ভাবনা মানুষকে আনন্দিত করে, উৎসাহিত করে।
অপরদিকে নিজের মধ্যে বিদ্যমান দোষ-ত্রুটি-ব্যর্থতা ইত্যাদি নিয়ে ভাবলে নিজেকে সংশোধন করার ইচ্ছে জাগ্রত হয়। প্রতিটা মানুষের মধ্যেই নিজেকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার শক্তি আছে।
এক টুকরো আলো আছে মনের কোনে ঘোর আঁধারে পথ প্রদর্শনের জন্য। তেমনি আছে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে যাবার মতো দুর্বলতা, আছে আশার টিমটিমে বাতিটাকে পুরোপুরি নিভিয়ে দেবার মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন বাতাস।
তাই অবশ্যই জানা থাকা উচিত কোথায় নিজের শক্তি আর কোথায় নিজের দুর্বলতা। নিজের সম্পর্কে যথাযথ ধারণা থাকলে মানুষ থেকে উত্তম মানুষ হবার সফর খুব সহজেই পাড়ি দেয়া সম্ভব হয়। এজন্য দরকার নিজের কাছে নিজের মুখোশ উন্মোচন করে, নিজেই নিজের আয়না হবার।
তবে বিষয়টা খানিকটা কঠিন বৈকি! কেননা আমাদের মনের ভেতরটাকে বলা যায় হাজারো চিন্তা-ভাবনার এক বিশাল কারখানা। যেখানে চেতন, অবচেতন, অচেতন সর্বাবস্থাতেই সর্বক্ষণই উৎপন্ন হতে থাকে নানামুখী চিন্তার স্রোত এবং প্রবাহিত হয় নানান দিকে।
আবেগের মহাবিশৃংখলা, প্রতিকূল অবস্থা-অবস্থান, পরিবেশ-পরিস্থিতি, আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাবে চারিত্রিক নানান দূর্বলতা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় সুন্দর জীবন গড়ার পথে। ইগোর গোলকধাঁধা, স্বার্থপরতার চোরাবালি, প্রতিহিংসার দহন, পরশ্রীকাতরতার গুপ্তঘাতক ইত্যাদি ঘুণপোকার মতে কুড়ে কুড়ে খায় মনের কোমলতা, সরলতা, উচ্ছ্বাস, বিশ্বাস, আশা, ভালোবাসাকে।
মানুষ হয়ে যেতে থাকে সুন্দর আবেগ বিবর্জিত যন্ত্র এবং অসুন্দর আবেগ চালিত অনুভূতিহীন প্রাণী। নিজেই নিজের ধরা ছোঁয়ার বাইরের কেউ। নিজেকে খুঁজে পেতে, ছুঁয়ে দিতে হিপনোটিক সাজেশন পালন করতে পারে সহায়ক ভূমিকা।