তিন বছরের নিঝুম ঘুম থেকে ওঠার আগেই তার মা-বাবা নিজ নিজ কর্মস্থলে চলে যায়। এমন দিন খুব কমই আছে সে তার মা-বাবা বা দুজনকেই সকালে উঠে দেখতে পেয়েছে। বাড়ির কাছাকাছি কর্মস্থল হওয়ায় দুপুরে খাবার খেতে মা-বাবা বাড়িতে এলেও তা কিছু সময়ের জন্য। অবুঝ নিঝুম তাদের সঙ্গ চাইলেও মা-বাবার তাড়া থাকে আবার অফিসে যাওয়ার। কাজের লোক তাকে আড়ালে নিয়ে গেলে তারা আবার বেরিয়ে পড়েন কাজের উদ্দেশ্যে। তাই নিঝুমকে দিনের প্রায় সবটা সময়ই কাটাতে হয় বুয়ার কাছে। বাড়িতে প্রায় নিঃসঙ্গ থাকে বলে দরজায় কোনো শব্দ হলেই সে ছুটে যায় কে এলো তা দেখার জন্য। সন্ধ্যায় মা-বাবা ফিরে এলে সংসারের নানা দিকও দেখতে হয় তাদের। এছাড়া থাকে সারা দিনের ক্লান্তি। চাকরি, সন্তান ও সংসার সব দিক সমন্বয় করার চেষ্টা করতে গিয়ে তারা তাদের সন্তানের স্বভাবিক বিকাশের জন্য যেটুকু সময় ও সংস্পর্শ দরকার তা দিতে পারছেন না। ফলে এ তিন বছর বয়সেও নিঝুম শুধু কিছু শব্দ উচ্চারণ করা ছাড়া কোনো প্রশড়ব বোঝা বা তার উত্তর দেয়ার মতো ক্ষমতা অর্জন করেনি। এখনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাকে আকারে ইঙ্গিতে যোগাযোগ করতে হয়, যা এই বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক নয়।
নিঝুমের মতো সাড়ে তিন বছরের হেমা এক চিকিৎসক দম্পতির সন্তান। কোনো ডে-কেয়ার সেন্টার না থাকায় হেমাকেও কাজের লোকের কাছে থাকতে হয়। হেমার বাবা একাধিক প্রাইভেট ক্লিনিকে কাজ করেন। কারণ তাকে তার নিজের পরিবার ছাড়াও গ্রামে বসবাসকারী মা-বাবা ও ভাই- বোনদের পড়ালেখার খরচ চালাতে হয়। হেমার মা রাজশাহী মেডিকেলে চাকরি করেন। মেধাবী ছাত্রী হওয়ায় তিনি চাকরির পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার জন্য পড়াশোনা করছেন। ফলে হেমার জন্য তার মা-বাবার সময় নিঝুমের চেয়েও কম। মা দুপুরে অফিসের পর বাড়িতে এলেও তার চেষ্টা থাকে বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে লাইব্রেরিতে পড়তে যাওয়ার। ফিরে আসেন রাত নয়টা-দশটায়। আবার মাঝে মাঝেই তাকে রাতে হাসপাতালে ডিউটি করতে হয়। মা-বাবার যথেষ্ট সময় না দিতে পারা এবং বাড়িতে বেশিরভাগ সময় একা থাকার ফলে সে একগুয়ে স্বভাবের হয়ে গেছে। সে যখন যা করতে চায় তখন তাই তাকে করতে দিতে হয়।
একক পরিবারের প্রচলন বাংলাদেশে বেশ আগে হলেও বর্তমানে এর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে। সেই সাথে আধুনিক জীবন যাপনের আকাক্সক্ষা, ব্যয়বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি কারণে নারীরা এখন অনেক বেশি চাকরির সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করছে।
বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপ ২০০২-০৩ অনুসারে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে ০ দশমিক ৯৮ কোটি নারী বিভিনড়ব পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। এই শ্রমশক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পোশাক শিল্পে কাজ করছে। এখানকার মোট শ্রমশক্তির ৯০ শতাংশেরও বেশি নারী শ্রমিক।
বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত কর্মজীবী নারীদের মধ্যে অনেকেরই শিশু সন্তান রয়েছে। মায়ের অবর্তমানে যাদের দেখাশোনার জন্য কেউ থাকে না, বা কাজের লোকের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাই নারীদের কর্মক্ষেত্রে আসা অব্যাহত রাখতে এবং কাজে মনোযোগী করতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রয়োজন অনুসারে মানসম্পনড়ব ডে-কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে কর্মজীবী মায়েদের বাচ্চাদের রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের যথেষ্ট অভাব রয়ে গেছে।
জাতীয় শ্রম আইন ২০০৬ অনুসারে কোনো প্রতিষ্ঠানে ৪০ জন নারী থাকলেই সেখানে শিশুদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার থাকার বিধান থাকলেও এখন পর্যন্ত খুব কম সংখ্যক প্রতিষ্ঠানেই ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে। আবার সরকারি ও বেসরকারিভাবে যে ডে-কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সেগুলোর প্রায় সবই রাজধানীকেন্দ্রিক। চাহিদা ও প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও দেশের অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে এখনও পর্যন্ত ভালো মানের ডে-কেয়ার সেন্টারের সংখ্যা খুবই কম। ডে-কেয়ার সেন্টারের মানের ক্ষেত্রে দেখা যায় খোদ ঢাকা শহরেই যেসব ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে তার কিছু সংখ্যক ছাড়া বেশিরভাগই মানসম্পনড়ব নয়। অর্থাৎ বিভিনড়ব বয়সী শিশুদের উপযোগী পরিবেশ, শিশু অনুপাতে প্রশিক্ষিত পরিচর্যাকারীদের সংখ্যা, নিরাপত্তা, পরিষ্কার-পরিচ্ছনড়বতা, পর্যাপ্ত জায়গা, স্কুলপূর্ব শিশুদের জন্য শিক্ষার পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়গুলোর সমন্বয়ের অভাব রয়ে গেছে এসব ডে-কেয়ার সেন্টারগুলোতে। ব্যাপক সংখ্যক নারী যে পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত সেখানে দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ কারখানাতেই ডে-কেয়ার সেন্টার নেই। বেসরকারি সংস্থা কর্মজীবী নারী ২০০৭ সালের জুন মাসে ৫৫টি পোশাক কারখানায় একটি জরিপ চালায়। সেখানে দেখা গেছে, ৫৫টির মধ্যে মাত্র ১৫টি কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে। তবে কর্মজীবী নারীর মাঠপর্যায়ের সমন্বয়ক আরিফা আক্তার অনু বললেন, ‘যেসব কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থা রয়েছে তার অধিকাংশই শিশুদের বসবাসের উপযোগী নয়। শুধু নিয়ম রক্ষার জন্য এসব ডে-কেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আবার অনেক সময় বিদেশিদের আকৃষ্ট করার জন্য এসব ডে-কেয়ার সেন্টার অস্থায়ী ভিত্তিতে তৈরি করা হয়।’
তিনি আরো বললেন, ‘তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা হচ্ছে, নারী গার্মেন্টস শ্রমিকরা মা হওয়ার পর অধিকাংশই তাদের কাজ ছেড়ে দেয় এবং বাচ্চা বড় না হওয়া পর্যন্ত বাড়িতে বসেই উপার্জনমূলক অন্য কাজে শ্রম দেয়। এছাড়া এদের বাচ্চারা দেখাশোনার অভাবে শিশু অবস্থায় বেশি মারা যায় এবং এদের মধ্যে অপরাধী হওয়ার প্রবণতাও বেশি দেখা যায়। মায়েরা শিশুদের নিরাপত্তার জন্য একটু বড় হওয়ার পর গ্রামে আত্মীয়- স্বজনের কাছে পাঠিয়ে দেয় অথবা তালাবন্ধ করে বা শেকল দিয়ে বাড়িতে বেঁধে রেখে আসেন।’ সরকারি উদ্যোগে এ পর্যন্ত নি¤ড়ববিত্ত ও মধ্যবিত্ত কর্মজীবী মায়েদের শিশুদের জন্য ৩২টি ডে-কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬টি মধ্যবিত্তদের জন্য যার সবই ঢাকা শহরে অবস্থিত। নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য বাকি ১৮টির মধ্যে ঢাকা শহরে ৭টি, অন্যান্য বিভাগীয় শহরে ৫টি এবং বিভিনড়ব জেলা শহরে ১৪টি ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় সরকারি উদ্যোগ এক্ষেত্রে খুব কম। এছাড়া মধ্যবিত্তদের জন্য ঢাকার বাইরে কোনো ডে-কেয়ার সেন্টার নেই।
সরকারি যে ডে-কেয়ার সেন্টারগুলো আছে সেগুলোতেও লোকবলের অভাব রয়েছে। আবার নি¤ড়ববিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য প্রতিষ্ঠত ডে-কেয়ার সেন্টারগুলোতে রয়েছে বৈষম্য। মধ্যবিত্তদের জন্য নির্ধারিত ডে-কেয়ার সেন্টারগুলোতে ৫০টি শিশুকে দেখাশোনার জন্য যেখানে দুজন কাজ করছে, সেখানে নি¤ড়ববিত্তদের ডে-কেয়ার সেন্টারগুলোতে শিশুর সংখ্যা ৮০ হলেও আয়ার সংখ্যা বাড়েনি অর্থাৎ এখানেও দুজন আয়া রাখা হয়েছে। এছাড়া সকল সরকারি ডে-কেয়ার সেন্টারে দুজন কুকের পদ থাকার নিয়ম থাকলেও বর্তমানে নি¤ড়ববিত্তদের ডে-কেয়ার সেন্টারে একটি কুকের পদ বাদ দেয়া হয়েছে এবং এখানে কোনো স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগ দেয়া হয়নি।
মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের শিশু উনড়বয়ন বিভাগের সহকারী পরিচালক শামীমা খানম এ সম্পর্কে বলেন, ‘ডে-কেয়ার সেন্টারের মানের ক্ষেত্রে শিশু অনুপাতে যথেষ্ট লোকবল অবশ্যই থাকা উচিত। তবে সরকার অর্থের অপর্যাপ্ততার কারণ দেখিয়ে লোকবল কমিয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে অধিদফতরের ডে-কেয়ার সেন্টারটিতে ৫০টি শিশু থাকার ব্যবস্থা থাকলেও রয়েছে ১৫টি শিশু।’ শিশুদের রাখতে আসার সমস্যার কথাটিও তিনি এ সেন্টারে শিশু কমে যাওয়ার একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের আইইআরে অবস্থিত ছায়ানীড় নামে যে ডে-কেয়ার সেন্টারটি রয়েছে সেখানে দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের থাকার ব্যবস্থা নেই। বর্তমানে চাকরিজীবী মায়েদের চার মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়া হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অনেক মা তার প্রতিষ্ঠানে ডে-কেয়ার সেন্টার থাকা সত্ত্বেও তাদের দুই বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের সেখানে রাখতে পারছেন না।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে কর্মজীবী মায়েরা তাদের শিশুদের ডে-কেয়ার সেন্টারে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেও পর্যাপ্ত সংখ্যক ডে-কেয়ার সেন্টার না থাকা ও এগুলোর বিভিনড়ব সমস্যার কারণে বাবা-মা তাদের বাচ্চাকে সেখানে রাখতে পারছেন না। ফলে মা ও শিশু উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মা তার সন্তানের চিন্তায় যথেষ্ট দক্ষতা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কর্মস্থলে সর্বোচ্চ মানের কাজ দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ক্যারিয়ার ও সন্তান কোনোদিকেই তারা যথার্থ মনোযোগ দিতে পারছেন না। উভয় দিক সামলাতে না পেরে কর্মজীবী মায়েরা অনেক সময় নিজেদের ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে ছাড় দিতে বাধ্য হন। কেউ চাকরি ছেড়ে দেন, আবার কেউ সন্তান একটু বড় না হওয়া পর্যন্ত উচ্চশিক্ষা নেয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। এছাড়া কর্মক্ষেত্রেও নানা বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন।
লিখেছেন- শামিম আরা বেগম।