banner

মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 387 বার পঠিত

 

সুখী দাম্পত্য জীবনের ১০টি মূলনীতি

যদি তাদের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার মত পরিস্থিতিরই আশঙ্কা কর, তবে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করবে। তারা উভয়ের মীমাংসা চাইলে আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছু অবহিত। [৪:৩৫]

কুরআন-সুন্নাহর আলোকে দাম্পত্য বন্ধনের কিছু মূলনীতি একত্রিত করার চেষ্টা করেছি, যা আমাদের সবার কাজে লাগবে ইনশা’আল্লাহ।

১. বিবাহ একটি পবিত্র বন্ধন। চারপাশের পরিবেশে হারাম যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে বিবাহের মতো পবিত্র বন্ধন বরং মহামূল্যবান রত্নের ন্যায়। এটা এক হীরক টুকরো। স্বামী-স্ত্রী ও উভয়ের পরিবারের যথাসম্ভব চেষ্টা করা উচিৎ যেন এই হীরার টুকরোটিতে আঁচ না লাগে, বা ভেঙে না যায়। এ বন্ধন ভেঙে যাওয়া মানে উভয় পক্ষের জন্য হাজারো গোনাহের দরজা খুলে দেয়া, যা নিশ্চয় আমরা চাইব না।

২. আমরা আল্লাহর আবদ বা গোলাম। তাঁর সন্তুষ্টিই আমাদের সন্তুষ্টি। তাঁর তাকওয়া বা ভীতি আমাদের জীবন চলার পথের রসদ। কাজেই যা কিছুই করি না কেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও বিধানের মাপকাঠিতে তাকে পরখ করে দেখতে হবে। আমরা এমন কিছু করছি না তো, যা তাঁকে অসন্তুষ্ট করে! সেজন্য নিজে পড়াশোনা করতে হবে, আলেমদের সাথে পরামর্শ করতে হবে।

৩. শয়তান সর্বদা মানুষের পেছনে লেগে আছে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দূরত্ব তৈরি করার মাঝেই তার চূড়ান্ত সফলতা।

ক. রাসূল স. বলেন,

إِنَّ الشَّيْطَانَ يَجْرِي مِنِ ابْنِ آدَمَ مَجْرَى الدَّمِ

শয়তান মানুষের মাঝে রক্তের ন্যায় চলাচল করে। [সহীহ বুখারী: ৭১৭১]

খ. স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে দূরত্ব তৈরির চেষ্টা করা সৃষ্টি করা শয়তানের জন্য নতুন নয়। সুলায়মান আ. এর সময়কালে শয়তানদের কার্যক্রম বর্ণনায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, তারা মানুষকে যাদুবিদ্যা শেখাত।

فَيَتَعَلَّمُونَ مِنْهُمَا مَا يُفَرِّقُونَ بِهِ بَيْنَ الْمَرْءِ وَزَوْجِهِ

অতঃপর তারা তাদের কাছ থেকে এমন জাদু শিখত, যদ্দ্বারা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। [আল-কুরআন, ২:১০২]

গ. স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ তৈরিকারী শয়তান-সরদার ইবলিসের কাছে বেশি প্রিয়।

عَنْ جَابِرٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ” إِنَّ إِبْلِيسَ يَضَعُ عَرْشَهُ عَلَى الْمَاءِ ثُمَّ يَبْعَثُ سَرَايَاهُ فَأَدْنَاهُمْ مِنْهُ مَنْزِلَةً أَعْظَمُهُمْ فِتْنَةً يَجِيءُ أَحَدُهُمْ فَيَقُولُ فَعَلْتُ كَذَا وَكَذَا فَيَقُولُ مَا صَنَعْتَ شَيْئًا قَالَ ثُمَّ يَجِيءُ أَحَدُهُمْ فَيَقُولُ مَا تَرَكْتُهُ حَتَّى فَرَّقْتُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ امْرَأَتِهِ – قَالَ – فَيُدْنِيهِ مِنْهُ وَيَقُولُ نِعْمَ أَنْتَ ”

জাবির রা. বর্ণনা করেন, রাসূল স. বলেছেন, নিশ্চয় ইবলিস পানির ওপর তার সিংহাসন বসায়, অতঃপর তার বাহিনীকে পাঠায় (মানুষকে বিপথগামী করার জন্য)। তাদের মধ্যে তার কাছে সবচেয়ে নিকটবর্তী সে-ই হয় যে সবচেয়ে বড় ফিতনা তৈরি করতে পারে। তো, কেউ এসে জানায়, আমি ওটা করেছি, সেটা করেছি; ইবলিস বলে, এটা তেমন কিছু করো নি। অতঃপর অন্য একজন এসে জানায়, আমি অমুককে ততক্ষণ পর্যন্ত ছাড়ি নি, যতক্ষণ না তার ও তার স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছি। ইবলিস তাকে কাছে টেনে নিয়ে বলে, হ্যাঁ তুমি বেশ করেছ।” [সহীহ মুসলিম: ২৮১৩]

৪. আমরা কেউই ১০০% পারফেক্ট নই। কিছু ভালো ও কিছু মন্দ দিক নিয়েই আমাদের জীবন চলা। ভালো দিকগুলো দেখে খারাপগুলো এড়িয়ে চলতে হবে।

وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ ۚ فَإِن كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا

নারীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপন কর। অতঃপর যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে হয়ত তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ, অনেক কল্যাণ রেখেছেন। [আল-কুরআন, ৪:১৯]

وَعَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ وَعَسَىٰ أَن تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

পক্ষান্তরে তোমাদের কাছে হয়ত কোন একটা বিষয় পছন্দসই নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়ত কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্যে অকল্যাণকর। বস্তুত: আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না। [আল-কুরআন, ২:২১৬]

৫. ক. রাগ কোনো বীরত্ব নয়। বরং রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারাই বীরত্ব।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ” لَيْسَ الشَّدِيدُ بِالصُّرَعَةِ، إِنَّمَا الشَّدِيدُ الَّذِي يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الْغَضَبِ “.

আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূল স. বলেছেন, বীরত্ব শক্তির লড়াইয়ে জেতায় নয়, বরং প্রকৃত বীর সে-ই, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। [সহীহ বুখারী ৬১১৪]

খ. রাগ মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়। আল্লাহ তায়ালা রাসূলের স. নম্র স্বভাবের প্রশংসা করে বলেন,

فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ لِنتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ

আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন। পক্ষান্তরে আপনি যদি রাগ ও কঠিন হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করুন এবং কাজে কর্মে তাদের পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহ তা’আলার উপর ভরসা করুন আল্লাহ তাওয়াককুল কারীদের ভালবাসেন। [আল-কুরআন, ৩:১৫৯]

এই আয়াতের আরো তিনটা শিক্ষা হলো: ক. ক্ষমা করা। খ. পরামর্শ করা। গ. কোনো বিষয়ে দৃঢ় সংকল্প হলে আল্লাহর ওপর তাওয়াককুল করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা

৬. স্ত্রীর সাথে নমনীয় ব্যবহার কাপুরুষতা নয়, বরং তা শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয়।

عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ” خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لأَهْلِي

উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল স. বলেন, তোমাদের মাঝে সর্বোত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে সর্বোত্তম। এবং আমি আমার স্ত্রীদের কাছে সর্বোত্তম। [সুনান তিরমিযী ৪২৬৯]

৭. স্বামী-স্ত্রী একে অপরের পরিচ্ছদ, সবক্ষেত্রে একে অপরের সহযোগী।

هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ

তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। [আল-কুরআন, ২: ১৮৭]

৮. স্বামীর হালাল নির্দেশ পরিপালন দাসত্ব নয়, বরং শরীয়তের নির্দেশ:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، رضى الله عنه أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ” لاَ يَحِلُّ لِلْمَرْأَةِ أَنْ تَصُومَ وَزَوْجُهَا شَاهِدٌ إِلاَّ بِإِذْنِهِ، وَلاَ تَأْذَنَ فِي بَيْتِهِ إِلاَّ بِإِذْنِهِ، وَمَا أَنْفَقَتْ مِنْ نَفَقَةٍ عَنْ غَيْرِ أَمْرِهِ فَإِنَّهُ يُؤَدَّى إِلَيْهِ شَطْرُهُ “.

আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল স. বলেন, স্বামী উপস্থিত থাকাবস্থায় তার অনুমতি গ্রহণ ছাড়া স্ত্রীর জন্য (নফল) রোজা রাখা হালাল নয়। অনুরূপভাবে স্বামীর ঘরে অন্য কাউকে তার অনুমতি ছাড়া প্রবেশের অনুমতি দেয়া হালাল নয়। এবং নির্দেশ ছাড়া স্বামীর সম্পদ থেকে যা খরচ করবে (দান হিসেবে) তার অর্ধেক সওয়াব স্বামী পাবে। [সহীহ বুখারী ৫১৯৫]

৯. স্বামীর নেতৃত্ব তার মর্যাদার চূড়ান্ত স্বীকৃতি নয়, বরং সংসার নাম প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে
স্বামীর জন্য এ এক বিরাট দায়িত্ব, এবং এ দায়িত্ব সম্পর্কে সে জিজ্ঞাসিত হবে।

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ” كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ، فَالإِمَامُ رَاعٍ وَهْوَ مَسْئُولٌ وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِهِ وَهْوَ مَسْئُولٌ وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى بَيْتِ زَوْجِهَا وَهْىَ مَسْئُولَةٌ، وَالْعَبْدُ رَاعٍ عَلَى مَالِ سَيِّدِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ، أَلاَ فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ “.

আব্দুল্লাহ বিন উমার রা. বর্ণনা করেন, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে। নেতা দায়িত্বশীল এবং সে জিজ্ঞাসিত হবে। পুরুষ তার স্ত্রীর ব্যাপারে দায়িত্বশীল এবং সে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার স্বামীর বাড়ির ব্যাপারে দায়িত্বশীল এবং সে জিজ্ঞাসিত হবে। গোলাম তার মুনিবের সম্পদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল এবং সে জিজ্ঞাসিত হবে। মনে রেখো, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে। [বুখারী ৫১৮৮]
চূড়ান্ত মর্যাদার নির্ণায়ক একমাত্র তাকওয়া বা আল্লাহভীতি।

إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ ﴿الحجرات: ١٣﴾

নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্মানিত যে সর্বাধিক পরহেযগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন। [আল-কুরআন, ৪৯:১৩]

১০. সর্বোপরি আমাদের আদর্শ রাসূল স. তাঁর স্ত্রীদেরকে সময় দিয়েছেন, কথা শুনেছেন, হালাল বিনোদনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং তাদের সাথে পরামর্শ করেছেন। সীরাহ চর্চায় এমন বহু ঘটনার দেখা মেলে।

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে দুটো কথা:

১. ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যর্থ হলে পারিবারিকভাবে মীমাংসার চেষ্টা করা।

وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِّنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِّنْ أَهْلِهَا إِن يُرِيدَا إِصْلَاحًا يُوَفِّقِ اللَّهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا خَبِيرًا

যদি তাদের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার মত পরিস্থিতিরই আশঙ্কা কর, তবে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করবে। তারা উভয়ের মীমাংসা চাইলে আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছু অবহিত। [৪:৩৫]

২. অনেক ভেবেচিন্তে, ইস্তিখারা করে, পরামর্শ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। কারণ,

عَنِ ابْنِ عُمَرَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ” أَبْغَضُ الْحَلاَلِ إِلَى اللَّهِ تَعَالَى الطَّلاَقُ ”

ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী স. বলেন, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় হালাল হচ্ছে তালাক। [সুনান আবু দাউদ ২১৭৮]

আল্লাহ আমাদের হালাল বন্ধনকে মজবুত করে দিন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম করে দিন। আমীন।

মুফতি ইউসুফ সুলতান
গবেষণা সহকারী, ইসরা কনন্সালটেন্সি, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া

Facebook Comments