অপরাজিতা ডেস্ক: ‘বান, জলোচ্ছাস, ঝড় বাদল তো লেগেই আছে । আর সেই সাথে আমাদেরও যাযাবরের মতো এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ছুটাছুটি। কতোবার কুঁড়ে তৈরি করা যায়। কেউ একবার ফিরেও দেখেনা । ঈদ এলে কয়েক কেজি চাল দেয় । আবার যিনি এখানকার ভোটার নন মেম্বর সাহেব তাকে চাল দেন না ।’ সাতক্ষীরার বেতনা পাড়ের মানুষগুলোর এমনই দুর্দশা । বিশেষ করে নারীদের ভোগান্তি যে কতো তার কোনো শেষ নেই বললেন সাতক্ষীরার বেতনা পাড়ের রাবেয়া।
এই বেতনা পাড়ের আরেক নারী রুবিয়া। একচালা কুঁড়ে ঘরেই তার বাস । তিনি বলেন, একটু বৃষ্টি হলেই ঘরে পানি পড়ে । ঝড় এলে ছন উড়ে যায় । এখানকার নারীরা বসবাসের জন্য জমি পেলেও তা চলে যায় অন্যের দখলে । সরকারের এই খাস জমির দখল নিয়ে প্রায়ই ঝগড়াঝাটি লেগেই আছে । খাস জমি বরাদ্দ দেওয়া বন্ধ করেছে সরকার । আগে থেকে যারা আছে তারাই টিকে রয়েছে এখানে। আমাদের কোনো শৌচাগার নেই। খাবার পানিও নেই । দু-থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গিয়ে পানি আনতে হয় । নদীর নোনা পানি । এই নদী ভাঙ্গে আর গড়ে । সেই সাথে আমাদের কপালও ভাঙ্গে । কারও গড়ে কারও গড়েনা ।
রেহানা, সুফিয়া, ফিরোজা, আলেয়া, রুবিনা, রাবেয়া, মুক্তার মতো ভিটেমাটি হারা এমন কয়েক শ’ পরিবারের আশ্রয় এখানে । কেউ নিয়েছে সরকারের কাছ থেকে একসনা বন্দোবস্ত । কেউ বন্দোবস্ত ছাড়াই বসবাস করছে সরকারি খাস জমিতে ।
ছোট বয়সেই মাকে হারিয়েছে রেহানা । দুটি সন্তান জন্মের পরই পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন রেহানা । তার এই অবস্থায় স্বামী তাকে ফেলে রেখে চলে যায় তৈলকুপিতে। স্বামী ফের বিয়ে করে । রেহানা বলেন, একরকম ভাসমান অবস্থায় ঘর বেঁধেছি বেতনা তীরে । সরকার পাঁচ শতক জমি আমার নামে একসনা বন্দোবস্ত দেন । কিছুদিন পর নদী খনন শুরু হলে ঘর ভেঙ্গে যায় । সেই জমিও চলে যায় নদীর মধ্যে। কোথায় দাঁড়াবেন। ভিক্ষে করেই দিন চলে । যদিও কিছুটা জমি স্থানীয় মেম্বর খুঁজে দিয়েছেন, সেখানে ঘর তুলবেন যে টাকা কোথায়! বেতনা তীরের আরেক নারী আলেয়া বেগম। তার পাঁচ জনের সংসারে আয় করার লোক নেই। কিডনি রোগে ভুগছেন তিনি। তাই পরিশ্রমের কাজ করতে পারেন না । বাপের বাড়ি থানাঘাটায় । তারা গরিব, সাহায্য করার সামর্থ্য নেই তাদের।
আর সুফিয়া খাতুন নিজেই জোন দেয় মাঠে ঘাটে । মজুরি আসে একশ’ থেকে জোর বেশি দেড় শ’ টাকা। কিন্তু কাজ সব দিন হয়না। রুবিনার পরিবারের সদস্য সংখ্যা তিন । স্বামীও জোন দেয় । রুবিনা বলেন, খড়পাতার বুননের কাজ করে মাসে আটশ’ টাকা আয় হয়। ছেলে কাজ করে ঘেরে ।
মুক্তার চারজনের সংসার । রিশিল্পীর খড়পাতা বুননের কাজ করে যা পায় তাই দিয়েই চলে তার সংসার।
ছয় জনের সংসারে আলেয়া বেগম মাঠে ঘাটে জোন মজুরি খেটে সংসারে যোগান দিয়েও স্বামীর ভালো মুখ পায়না। আর ফিরোজার স্বামী ভ্যান চালায়। সে নিজেও মাঠে জোন দেয় । আলেয়া বেগম বলেন, এরপরও স্বামীর মারধর খেতে হয় আমাদের। কথায় কথায় তালাকের হুমকি আসে। নীরবে সব সহ্য করতে হয় । আর দুর্যোগকালে অত্যাচারের মাত্রা যেন আরও বেড়ে যায় । নারী হিসাবে এভাবেই নানা দুর্ভোগের শিকার হই । প্রতি বছরই জলাবদ্ধতা জেঁকে বসে বেতনা তীরে । পানিতে তলিয়ে একাকার হয়ে যায় সব । তখন আশ্রয় নিতে হয় কাছাকাছি এক গোডাউনে । কাছে কোনো স্কুল নেই । আমাদের ছেলেমেয়েদের তাই লেখাপড়ার সুযোগও নেই । খাবার পানি যোগাড় করতে না পারলে ভোগ করতে হয় স্বামীর নির্যাতন । ঘরে চাল না থাকলেও ভাত চাই স্বামীর । এতো যন্ত্রণার মধ্যেও সরকার থেকে এলাকায় একটি গভীর নলকুপ বসালে অন্ততঃ বিশুদ্ধ পানি পেতাম পান করার জন্য।
অপরাজিতাবিডি ডটকম/আরএ/এ/সেপ্টেম্বর ২০১৪ই.