‘ফেমিনিজম’ বা ‘নারীবাদ’ নিয়ে ভুল ধারণা বিদ্যমান রয়েছে সারা বিশ্বের প্রায় সবদেশেই।এমনকি এই ২০১৬ সালে এসেও ‘নারীবাদ’কে বেশ নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন স্বয়ং নারীরাও। অনেকে আবার ব্যঙ্গ করে বলেন
বর্তমানের নারীবাদে আসলে নারীকেই বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে! মূলতঃ নারীবাদ বিষয়টি নিয়ে সঠিক জ্ঞানের
অভাবই এসব নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে। নারীদের অধিকার আদায়, সমতা অর্জন এবং সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংগঠিত বিভিনড়ব মতবাদ ও আন্দোলনই হলো ফেমিনিজম, যার বাংলা শব্দটি হলো নারীবাদ। এবং বলা হয়ে থাকে, এসব ‘কজ’ (পধঁংব)
বা অধিকারের যেকোন একটি যদি কোনো ব্যক্তি সমর্থন করে থাকেন তবে তিনি নিজেকে নারীবাদী বলুন আর
না-ই বলুন, সংজ্ঞানুযায়ী তিনি একজন ‘নারীবাদী’। এবং এসব কোনো একটি অধিকার আদায়ের জন্য সংঘটিত
আন্দোলনগুলোও নিজস্ব কর্মীদের দ্বারা নারীবাদী আন্দোলন বলে অ্যাখ্যায়িত নাহলেও সেগুলো আসলে
নারীবাদী আন্দোলন, বা সংক্ষেপে নারী আন্দোলন। এখানে অধিকার আদায় এবং অংশগ্রহণ বলতে
ভোটাধিকার, রাজনীতি, ব্যবসা, শিক্ষা, কাজের ক্ষেত্রে সমান পারিশ্রমিক, সম্পত্তির অধিকার, শিক্ষার অধিকার,
বিবাহে সমানাধিকার, মাতৃত্ব, অবসর, প্রজনন-সংμান্ত অধিকার (গর্ভনিরোধক ব্যবহার ও গর্ভপাতের অধিকার), ভাষার লিঙ্গ নিরপেক্ষতা, পক্ষপাতহীন বেতন-কাঠামো এবং বিভিনড়ব ক্ষেত্রে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার অধিকার প্রভৃতির স্বীকৃতি প্রদান তথা নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নকে বোঝায়।
এসব অধিকার আদায়ের যেকোনো ধরনের আন্দোলনই
নারীবাদের অন্তর্ভূক্ত।
‘নারীবাদ’ ধারণাটি মোটেও নতুন নয়, বরং এর রয়েছে অন্তত ১৩০ বছরের প্রত্যক্ষ ইতিহাস। সভ্যতার ইতিহাসে প্রায় প্রতিটি সামাজিক পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে লিঙ্গবৈষম্য নিরসনকারী নারীবাদী আন্দোলনগুলো রয়েছে। বিভিনড়ব মতবাদ অনুযায়ী নারীবাদী হতে পারেন যেকোন লিঙ্গের। এমনকি ‘নারীবাদ’ শব্দটি প্রম যিনি ব্যবহার করেন এবং এই মতবাদের সূত্রপাত ঘটান, তিনি নিজেও একজন পুরুষ। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি দার্শনিক চার্লস ফুরেয়ার প্রম নারীবাদ শব্দটির আনুষ্ঠানিক ব্যবহার করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। নারীবাদ” (ভবসরহরংস) সহস্রাব্দের নারীবাদ এবং নারীবাদী” (ভবসরহরংঃ) শব্দ দুটি ফ্রান্স ও
নেদারল্যান্ডসে প্রম প্রকাশিত হয় ১৮৭২ সালে, যুক্তরাজ্যে ১৮৯০ সালে, এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১০ সালে। অক্সফোর্ড
ইংরেজি অভিধান অনুযায়ী, নারীবাদী” শব্দের উৎপত্তিকাল ১৮৫২ এবং নারীবাদ” শব্দের ক্ষেত্রে তা ১৮৯৫।
সময়কাল, সংস্কৃতি ও দেশভেদে বিশ্বের বিভিনড়ব প্রান্তের নারীবাদীরা বিভিনড়ব কর্মসূচী ও লক্ষ্য পূরণের জন্য কাজ করেছেন। তবে পাশ্চাত্য নারীবাদী আন্দোলনের ইতিহাস তিনটি প্রবাহ”-এ বিভক্ত। নির্দিষ্ট কিছু নারীবাদী লক্ষ্যের এক একটি আঙ্গিক নিয়ে এক একটি প্রবাহ কাজ করেছে। প্রম প্রবাহটি ছিল ঊনবিংশ শতক ও বিংশ শতকের প্রম ভাগে। এ সময় নারীর ভোটাধিকার অর্জনের উপর জোর দেওয়া হয়, এবং নারীদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্বটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এ শিক্ষার অধিকার অনেকটাই শুধু সমাজের ঊঁচু শ্রেণীর নারী সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
দ্বিতীয় প্রবাহ শুরু হয় ১৯৬০’র দশকে। এই সময়ে নারীর সামাজিক এবং কর্মক্ষেত্রে আইনগত সাম্য প্রতিষ্ঠার
ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হয়। তবে পুরুষতান্ত্রিকতার মূল কারণ হিসেবে শুধু মাতৃত্ব ও যৌনতায় পুরুষের নিয়ন্ত্রণকে দায়ী করার হয় এসময়ের কিছু ত্বত্ত্বে। ফলে নারীবাদের ধারণাকে এভাবে সীমিত করে ফেলায় সমালোচনার
মুখে পড়ে সেই সময়ের নারীবাদ। এছাড়া যৌনতার সঙ্গী হিসেবে পুরুষদের প্রয়োজন শেষ করার অংশ হিসেবে
সমলিঙ্গ সম্পর্কগুলো ব্যাপক হারে আত্মপ্রকাশ করে, এবং এতে সমকামীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনেরও
সূত্রপাত ঘটে। একইসঙ্গে সামনে চলে আসে তৃতীয় লিঙ্গদের সামাজিক অধিকারের বিষয়গুলোও।
তৃতীয় প্রবাহ মূলতঃ দ্বিতীয় প্রবাহের প্রতিμিয়া স্বরূপ ১৯৯০ এর দশক থেকে শুরু হয়। তবে এটি একটি
ভিনড়বমুখী ধারাবাহিকতা। এই পর্যায়ে প্রাগত লিঙ্গ নির্ভর সামাজিক মূল্যবোধ গুলোর পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যান নারীবাদীরা। নারীদের সাজসজ্জার বিষয়টিকে দ্বিতীয় প্রবাহে পুরুষতান্ত্রিকতার বাহক হিসাবে ধরা হতো।
তবে সাজসজ্জাসহ নারীদের সব ধরনের নারীসুলভ আচরণ নিয়েও একজন নারী যে কোনো পেশাতেই পুরুষের
সমান কর্মদক্ষ হতে পারে- এটাই ছিল তৃতীয় প্রবাহের মূল ভাবনা। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গদের অধিকার আন্দোলনও
আরো শক্তিশালী হয় এসময়। বর্ণবাদের শিকার কৃষ্ণাঙ্গ, বাদামি’, ‘হলুদ’ জাতিসমূহসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর
নারীদের অধিকার যে একজন শ্বেতাঙ্গ নারীর অধিকারের সমতুল্য, তা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেরও সূত্রপাত ঘটে। বলা হচ্ছে, নারীবাদের চর্তু প্রবাহ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে, এবং এই প্রবাহের মূল আন্দোলনটি অনেকটাই
ইন্টারনেট ও গণমাধ্যমভিত্তিক। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই সব শ্রেণীর সব বয়সের মানুষের কাছে ছড়িয়ে
পড়া ডিজিটাল গণমাধ্যমে নারীদের যেভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে তা পুরুষতান্ত্রিকতার বাহক কি না তা অনুসন্ধান
করা, এবং এই ডিজিটাল গণমাধ্যম ব্যবহার করেই নারী আন্দোলন এবং এর মূল ভাবনাগুলো সব স্তরের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়াই হবে বর্তমান প্রবাহের মূল লক্ষ্য।
সহস্রাব্দের নারীবাদ
Facebook Comments