সীমাহীন সমুদ্রে ভেলার মতো ভাসতে পারি : উম্মে সালমা
‘ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল আকাশে পাখির মতো ডানা মেলে ওড়ার, যেখানে থাকবে না কোনো বাধা, উড়ে উড়ে দেখব পৃথিবীর নানা দৃশ্য আর সৌন্দর্য। আকাশে ওড়ার সেই স্বপ্নটি পূরণ করতে না পারলেও এখন সীমাহীন সমুদ্রে ভেলার মতো ভেসে বেড়াতে পারি আমি। পৃথিবীর বিস্তৃত এ অংশটিই আমার কাছে এখন সবচেয়ে আপন’। বললেন বাংলাদেশে মেরিন একাডেমি থেকে প্রথমবারের মতো পাস করে বের হওয়া ১৩ জন নারী ক্যাডেটের একজন উম্মে সালমা।
নোয়াখালীর সেনবাগে সালমার গ্রামের বাড়ি, তবে বাবার কর্মস্থলের কারণে চট্টগ্রাম শহরেই তার বেড়ে ওঠা। সালমা ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০১১ সালে চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে সালমা মেজ। বাবা-মাকে না জানিয়ে টিউশনির টাকা জমিয়ে সেই টাকায় বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির ফরম কেনেন। পূরণ করে জমাও দেন। ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগও পেয়ে যান।
এ প্রসঙ্গে উম্মে সালমা বলেন, ঘটনাটি আমার বাবা-মা জানলে আর দ্বিমত করেননি। আমার মেরিন একাডেমিতে পড়ার আগ্রহ দেখে তারা উৎসাহ দেন। যদিও তাদের ইচ্ছা ছিল আমাকে সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়াবেন। আমার বাবা একটি বেসরকারি শিপিং কোম্পানিতে কর্মরত রয়েছেন। আমার দাদাও একটি বিদেশী শিপিং কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। দাদা এবং বাবার সীমাহীন সাগরের বিভিন্ন রোমাঞ্চকর ও দুঃসাহসিক গল্প শুনে আমারও মনের মণিকোঠায় ঠাঁই নিয়েছিল সাগর পাড়ি দেয়ার ইচ্ছা। প্রথমদিকে একটু ভয় পেতাম, কিভাবে সাগরে কাজ করব। বিষয়টিকে মানুষ কিভাবে দেখবে। তারপরও সিদ্ধান্ত নেই একজন নারী সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ বাহিনীতে তার সাহসিকতার পরিচয় দিলে আমি কেন মেরিন অফিসার হিসেবে কাজ করতে পারব না। সব সংশয় দূরে ঠেলে নির্ভীক চিত্তে ২০১২ সালে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমিতে ভর্তি হই। প্রথম ব্যাচে আমরা মোট ১৬ জন মেয়ে ভর্তি হই। এরপর অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন পরীক্ষায় ৩ জন অকৃতকার্য হলে আমরা মোট ১৩ জন নারী ক্যাডেট শেষ পর্যন্ত টিকে থাকি। সফলভাবে মেরিন ক্যাডেট হিসেবে পাস করে বের হই। এরপর অনেকের মনের মধ্যে হতাশা ও ভয় কাজ করতে থাকে। যেহেতু এ পেশায় আগে কোনো নারী ছিল না। তার পরও মনের মধ্যে একটি সাহস কাজ করে, পারতেই হবে আমাদের।
বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হলাম : ফাহিমা আশরাফ
ক্যাডেট ফাহিমা আশরাফ জানান, এখন আমাদের অনেক ভালো লাগছে। আমরা নারী ক্যাডেটরা বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলাম। তারপরও আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করা। নারী নাবিকদের নিয়ে যেসব আশংকার কথা বলা হচ্ছে, আশা করি ধীরে ধীরে সেসব ধারণা মিথ্যে প্রমাণিত হবে। আমরা সমুদ্র জয় করতে চাই, দেশের স্বাধীনতা ও সমুদ্রসীমা অক্ষুণ্ন রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর। এখন আর আমাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র ভয় কাজ করে না। দেশের অন্য মেয়েদের অনুরোধ করব, তারাও যেন এগিয়ে আসে এ দুঃসাহসিক অভিযাত্রায়। তাহলেই এগিয়ে যাবে নারী। এগিয়ে যাবে দেশ।
প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হওয়াত ভালো লাগছে : লাভলী দাশ
লাভলী দাশ বলেন, নারী ক্যাডেটদের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হওয়াতে অনেক ভালো লাগছে। কেননা আমাদের ব্যাচের কথা মানুষ অনেকদিন মনে রাখবে। আমরা ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলাম।
তিনি আরও বলেন, ভারত নারীদের এই পেশায় উৎসাহিত করতে প্রশিক্ষণ ফি ৫০ ভাগ কমিয়েছে আর বয়স দুই বছর শিথিল করেছে। ফলে ভারতে নারী ক্যাডেটের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের দেশের নারী ক্যাডেটরাও যাতে এ পেশায় বেশি আসতে পারেন সরকারের সে ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
বিশেষজ্ঞরা যা বললেন
ইউসুফ হোসেন
চিফ ইঞ্জিনিয়ার, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন
নারী ক্যাডেটরা চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকলেও এটি দেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে । প্রথমবারের মতো ১৩ বাংলাদেশী নারী নাবিক হিসেবে যোগ দিচ্ছেন বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের বিভিন্ন জাহাজে। বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন যুগের উন্মোচন। অবশ্য তাদের নিয়োগ চূড়ান্ত হতে আর এক বছর সময় লাগবে। এখন ক্যাডেট হিসেবে শিপিং কর্পোরেশনে যোগ দিয়ে তারা এক বছরের প্রশিক্ষণ নেবেন। তারপর বিভিন্ন জাহাজে তাদের নিয়োগ দেয়া হবে। মেরিন একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করে ১৩ জন নারী মেরিন ক্যাডেট জাহাজে চাকরির জন্য আবেদন করেছেন। তাদের আবেদন বিবেচনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের প্রতিটি জাহাজে দু’জন করে নারী মেরিন অফিসার নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আর এটি হলেই বাণিজ্যিক জাহাজে নারীদের মেরিন অফিসারের চাকরি বাংলাদেশে নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি করবে।
কমান্ড্যান্ট ড. সাজিদ হোসাইন
বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় ২০১২ সালে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে প্রথম নারী ক্যাডেটদের নিয়ে প্রথম ব্যাচ শুরু করি। তখন একাডেমিতে থাকার পরিবেশ ও একোমোডেশনসহ নানাবিধ সমস্যা ছিল। তারপরও আমরা তাদের পুরুষ ক্যাডেটদের সমকক্ষ করে ট্রেন্ডআপ করতে পেরেছি। বিশ্বে ২০টি দেশের আড়াই হাজার নারী এ পেশায় কর্মরত আছেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ১৯৯৯ সালে নারীরা জাহাজে কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে সেখানে প্রধান প্রকৌশলী ও ক্যাপ্টেন পদেও কাজ করছেন নারী মেরিন কর্মকর্তারা।