সমুদ্রের টানে নদীর ছুটে চলা-১
আফরোজা হাসান
অফিসের কাজ শেষ করে কেবিন থেকে বেড়িয়ে দুই কন্যাকে ওয়েটিংরুমে বসে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন ফাইয়াজ সাহেব। কন্যাদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন একসাথে দুইজনের আগমনের হেতু। স্বভাব স্বরূপ একজনের হাতে বই, অন্যজনের হাতে মোবাইল। একজনের মুখ প্রশান্ত আরেকজনের চেহারা জুড়ে খেলা করছে দুষ্টুমি। দেখে অবশ্য মনেহচ্ছে না আজ নতুন কোন ঝগড়া নিয়ে হাজির হয়েছে দুজন।
হাসি ফুটে উঠলো ফাইয়াজ সাহেবের মুখে। সপ্তাহে কম করে হলেও একদিন তাঁর দুই কন্যা অফিসে হানা দেয়। এবং বেশির ভাগ সময়ই দুজন ঝগড়া করতে করতে ঢোকে। পুরো অফিস জুড়ে সেদিন বইতে থাকে আনন্দধারা। স্টাফদের সবার ঠোঁটের কোণেও খেলা করে হাসি। ছোটবেলাতেও নিয়মিত অফিসে আসতো তাঁর দুই কন্যা। নিজ নিজ মহিমায় স্টাফদের সবার মনেও একটু করে জায়গা দখল করে নিয়েছিল দুই কন্যা সেই ছোটবেলাতেই।
এরপর থেকে রাজশাহীর আম, বগুড়ার দই, নাটোরের কাঁচাগোল্লা আর কোনদিন কিনে খেতে হয় না ফাইয়াজ সাহেবকে। স্টাফদের যার দেশের বাড়ি যেখানে সে সেই স্থানের বিখ্যাত জিনিস নিয়ে হাজির হয় মামণিদের জন্য। অবশ্য ফাইয়াজ সাহেবের দুই কন্যাও কম যায় না এই ব্যাপারে। প্রায়ই বাসা থেকে স্টাফদের সবার জন্য খাবার নিয়ে আসে স্টাফদের সবার জন্য। পর্দার দিকে পরিপূর্ণ খেয়াল রেখে স্টাফদের সবার পরিবারের খোঁজ-খবর রাখা, পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করা ইত্যাদি কাজগুলো খুব আনন্দ নিয়ে করে দুই বোন।
ভীষণ ভালো লাগে তখন ফাইয়াজ সাহেবের। তিনি নিজেও সবসময় স্টাফদের খোঁজ-খবর রাখতে চেষ্টা করেন। মেয়েরা যখন থেকে অফিসে আসা শুরু করেছে একটা দায়িত্ব নেমে গিয়েছে কাঁধ থেকে এমনটা অনুভব করেন। অদ্ভুত এক প্রশান্তি খেলা করে মন জুড়ে। সন্তানরা বড় হয়ে যখন তাদের কাজের দ্বারা পিতার মনে এই ভরসা তৈরি করে ‘আমরা আছি পাশে’ তখন মনেহয় এমনতর প্রশান্তির আবহ সৃষ্টি হয় মনে।
সমস্যা শুধু একটাই দিনের মধ্যে একাধিক বার দুজন চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তোলে। দুজনের পছন্দ-অপছন্দ, ভালোলাগা-মন্দলাগা একদম আলাদা বলেই হয়তো এমনটা হয়। তবে ফাইয়াজ সাহেব খুব উপভোগ করেন দুই কন্যার ঝগড়াঝাটি। একজনের কথা জ্ঞান মিশ্রিত, অন্যজনের শব্দরাও মনেহয় যেন খুনসুটি করছে। এই মেয়ে দুটাকে জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মনেহয় ফাইয়াজ সাহেবের।
হাসিমুখে মেয়েদের কাছে এগিয়ে গেলেন। বাবাকে দেখে শাবাব এবং মাহাম উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সালাম দিলো।
সালামের জবাব দিয়ে ফাইয়াজ সাহেব বললেন, কিরে মা তোরা কখন এসেছিস?
এই নাও আমাদের সিভি! বলে বাবার হাতে সিভি ধরিয়ে দিলো শাবাব।
অবাক কণ্ঠে ফাইয়াজ সাহেব বললেন, সিভি দিয়ে কি করবো?
আমরা দুজন ঠিক করেছি জব করবো তোমার অফিসে। সিরিয়াস কণ্ঠে বললো মাহাম।
হাসতে হাসতে দুহাতে দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে ফাইয়াজ সাহেব বললেন, কি আজ আবার ঝগড়া হয়েছে মামণির সাথে? আবার কি করেছিস তোরা দুজন?
শাবাব বলল, কিছুই করিনি আমরা বাবা। তোমার বৌ খালি খালি চিৎকার করে। আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছো বৌকে। স্বৈরাচারী মহিলা।
মাহামও মাথা ঝাঁকিয়ে বড় বোনের সাথে সহমত পোষণ করে বলল, তো কাল থেকে জয়েন করছি আমরা।
শাবাব বলল, প্রতিদিন বিকেলে তিনঘণ্টা কাজ করবো আমরা। বেশি না মাত্র ত্রিশ হাজার বেতনেই এই কাজ করে দেবো আমরা।
দুই মেয়ের সিরিয়াস ভাব দেখে ফাইয়াজ সাহেবও হাসি গোপন করে বললেন, আরে এটা কেমন কথা হলো? অফিসের তো কিছু রুল আছে চাকরি করতে হলে সেসব মানতে হবে। সবার আগে ইন্টারভিউ দিতে হবে।
অবাক কণ্ঠে শাবাব বলল, ছিঃ বাবা! তুমি আমাদের ইন্টারভিউ নেবে? বাবা হয়ে মেয়েদের ইন্টারভিউ?
মেয়েরা যদি বাবার অফিসে কাজ করার বদলে বেতন চাইতে পারে, বাবা মেয়েদের ইন্টারভিউ নিতে পারবে না কেন? তাছাড়া আমি প্রফেশন আর রিলেশন মিক্সআপ করার পক্ষপাতী নই। কেননা এতে সম্পর্ক তার নিজস্ব গতিপথে চলতে বাঁধাগ্রস্ত হয়।
ঠিকআছে দিলাম নাহয় ইন্টারভিউ। আপনার অফিসে ইতিহাস হয়ে থাকবে এই ইন্টারভিউ মনে রাখবেন। এই মাহাম চল। বোনের হাত ধরে হাঁটা ধরলো শাবাব।
ফাইয়াজ সাহেব হেসে বলল, চলেন পৌছে দেই আপনাদেরকে।
জ্বীনা। আমরা বসদের কাছ থেকে লিফট নেই না। বলার জন্য শুকরিয়া।
অফিস থেকে বেড়িয়ে যেতে থাকা দুই কন্যার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আনন্দাশ্রুতে চোখ ভরে গেলো ফাইয়াজ সাহেবের। সত্যিই জীবনের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে তাঁর দুই কন্যা। ছোট্ট ছোট্ট হাতের ছোঁয়ায় জীবনের একটি অধ্যায় রচনার স্বপ্ন দুচোখ নিয়ে তিনিও রওনা হলেন মেয়েদের পেছনে।
চলবে