অনবরত বৃক্ষের গান
পড়ার টেবিলে মুনিবা,পাশে ডেস্কে বসে পড়ছে ওর ভাইয়া। দুষ্টোমিতে সেরা মুনিবা, তবে ভাইয়া যখন পড়তে বলে, মন দিয়ে পড়ে। ছাত্র সে, আর মুনিবা ক্লাস ফোর এ। ছোট্ট বাটিতে আমলকি, জলপাই নিয়ে এসে রাখলেন আম্মা।
বললেন, “জুবায়ের, মুনিবা, তোমাদের দাদুভাই পাঠিয়েছেন সকালে, গ্রাম থেকে। “ভাইয়া টিপ্পনী কেটে বলে,”মুনিবার মাথায় যা দুষ্ট বুদ্ধি, ওর টক খাওয়া ঠিক হবে না,বরং আমি খেয়ে ফেলি।” এ নিয়ে একদফা অভিমান,খুনশুটি। মুনিবা তো পড়বেই না,ভাইয়ার সাথে রাগ। অনেক বুঝিয়ে ঠিক হলো, ভাইয়া বেড়াতে নিয়ে যাবে।
রাতে খাওয়ার টেবিলে, আব্বুর কাছে নালিশ করলো মুনিবা। শাস্তি হিসেবে যে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে, সেটাও জানালো। তাদের বাবা বললেন, তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো, গল্প শুনাবো তোমাদের। গল্পের কথা শুনে, দুই-ভাই বোন নড়েচড়ে বসলো।
সবাই এসে বারান্দায় বসলে, মুনিবার আব্বু গল্প শুরু করলেন। আজকে তোমাদের দাদুভাই কতো কি পাঠিয়েছেন বলতো, মুনিবা। মুনিবা হাতের কড় গুনে বলতে শুরু করল, বাতাবি লেবু, চালতা, আমলকি, জলপাই, নারকেল, কতো সবজি। ও থামলে, মাহবুব সাহেব বললেন, এই যে বাতাবী লেবু গাছ, যখন বুনেছি, তখন জুবায়ের অনেক ছোট। মুনিবা নড়েচড়ে বসে, আমার জন্য কোন গাছ বুনোনি! তিনি বললেন,হ্যা আম্মু,বলছি শোন। তোমার আম্মা গাছ লাগাতে ভালোবাসেন, খুব। রাসূল (সা) এর প্রিয় হাদীসটি ভাইয়া শোনায়নি তোমাকে?
‘যখন কোনো মুসলমান একটি ফলবান বৃক্ষের চারা রোপণ করে, আর এতে ফল আসার পর সে নিজে অথবা অন্য কোনো মানুষ তা থেকে যা ভক্ষণ করে তা তার জন্য সাদকা (দানস্বরূপ), যা চুরি হয়, যা কিছু (খোসা, আঁটি ইত্যাদি) গৃহপালিত পশু খাবে এবং বিভিন্ন পাখপাখালি যা খাবে, সবগুলো তার জন্য সাদকা।’ (বুখারি ও মুসলিম) মুনিবা বলে,তাহলে তো পাখি পেপে খেতে আসলে,তাড়িয়ে দেওয়া যাবে না।ওর আব্বু হাসেন,আবার বলতে শুরু করেন।
আমি বাড়িতে গেলে, প্রতিমাসে গাছের চারা নিয়ে যেতে হতো। বাড়ির সামনে যে শিউলী গাছটা,আর পশ্চিমে দাড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়াটা, তোমার জন্য বুনেছিলেন। মুনিবা খুশিতে বাক-বাকুম করে ওঠে।আম্মুকে আহ্লাদে জড়িয়ে ধরে সে। সেদিনকার মতো গল্প শেষ করে ঘুমাতে যায় সবাই।
সকালে স্কুলে সামাজিক বিজ্ঞান ক্লাসে ফাতিমা ম্যাম পড়াচ্ছিলেন। জলবায়ু কনফারেন্স নিয়ে অডিও, ভিজ্যুয়াল দেখালেন, কিভাবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, অক্সিজেনের পরিমান কমে যাচ্ছে। আটলান্টিক এ পানির উচ্চতা বেড়ে, নিম্নভূমির দেশগুলো তলিয়ে যেতে পারে। মুনিবার ছোট্ট মন চিন্তায় ভরে গেলো, সে ম্যামকে জিজ্ঞেস করল, “আমাদের বাংলাদেশটার কি হবে?” ম্যাম হাসলেন,আমাদের পরিবেশকে অনেক সুন্দর রাখতে পারি, বেশী করে গাছ লাগাতে পারি। টেবিলের উপর কিছু ফুল, আর ফল। তার ছাত্র -ছাত্রীদের জন্য এনেছেন, বাসার ছাদে করা বাগান থেকে। সকলে খুব উৎসাহ পেলো। পরের সপ্তাহে সবাই মিলে ফাতিমা ম্যামের বাগান দেখতে গেলো।
সেদিন রাতে আবার মুনিবারা গল্প করতে বসল। ফাতিমা মিসের করা বাগান দেখে, খুব আগ্রহ ছোট্ট বাগান করার। ভাইয়ের শাস্তি আরো বেড়ে গেছে, বাগান করায় সহকারী হতে হবে। চারা কিনে এনে , মাটি-সার দিয়ে টব তৈরি করে দিতে হবে। ভাইয়া হাসিমুখে রাজি হলো। পরেরদিন থেকে শুরু হলো, মুনিবার বাগান করা। প্রথমে, স্ট্রবেরী চারা বুনেছে, আর আম্মুর জন্য বেলী ফুলের চারা। প্রতিদিন ক্লাস থেকে ফিরে বারান্দায় চলে যায়। একটু করে গাছগুলো বড়ো হয়, কুড়ি আসে। একদিন সাদা বেলী ফুলে গাছটা ভরে আসে,সুগন্ধে মনটা ভরে আসে। নিজের হাতে বোনা গাছে ফুল, খুশিতে সে উদ্বেল হয়ে উঠে। (এতোটা আনন্দ সে কখনোই পায়নি)।আর,যেদিন মুনিবার স্ট্রবেরী গাছ পাকা পাকা ফল ভরে যায়-দাদাভাই, আম্মু আর ভাইয়াকে নিয়ে খেতে কি যে আনন্দ পায় সে। দাদাভাই খুশিতে নাতনিকে নার্সারি থেকে দশটি ফলের চারা গিফট করেন।মুনিবার বাগান এখন বেশ বড়, বাসার সামনে ফুলেফলে ভরে আছে। বান্ধবীদের সে ফুলের চারা গিফট করে, তাদের হাসিমুখ দেখে প্রান ভরে ওঠে। #বৃক্ষরোপণ