মার ছেলে দুজন গল্প শুনতে খুব ভালবাসে। গল্প বলার কথা বললে যেকোন কাজ ছেড়ে আমার পাশে এসে বসে যায়। বড়জন শোয়া অবস্থায় থাকলে বসে পড়ে। গল্প শোনার সময় তার চোখের পলক পড়ে না, মাথাটা কাঁধের আরো কাছে নামিয়ে গাল-গলা ফুলিয়ে গল্প শোনে। তখন দেখতে শান্তশিষ্ট গাদুম গুদুম বিড়ালের মত দেখা যায়। ছোটজন সোজা কোলের মধ্যেই এসে বসে পড়ে, একদম মাথাটা আমার থুঁতনির সাথে লাগিয়েই বসে, যেন এখানে এ্যন্টিনা জাতীয় কোন সরাসরি সংযোগের ব্যবস্থা আছে। ওদের এই আগ্রহ দেখে আমারও ভাল লাগে কিন্তু সমস্যা হল এভাবে ওদের নিয়ে গল্প বলার সময় পাই খুব কম।
একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি, বাচ্চারা ইতিবাচক গল্প পছন্দ করে। যদি কোন গল্পের সমাপ্তি নেতিবাচক হয়, যেমন- শেয়াল কুমিরের বাচ্চাগুলোকে খেয়ে ফেলল, বা বাচ্চা ডাইনোসর টা পানিতে লাফ দিয়ে পড়ে গেল, তাহলে আমার দুজনই মন খারাপ করে। বড়জন বলেই ফেলে “গল্পটা এভাবে শেষ হয়েছে তো কি হয়েছে, আপনি বাকিটা বানিয়ে বলেন”। এই ”বাকিটা বানিয়ে বলেন” এর অর্থ হল “একটা শুভ সমাপ্তি” তারা শুনতে চায়। আমি বানিয়ে টানিয়ে গল্পের একটা খুশী খুশী সমাপ্তি টেনে দেই ( অভ্যাসবশত এই কাজটা মনে হয় আমি ভালই পারি)। ছোটজন গল্প শুরু করার আগেই বলে রাখবে ” আম্মু গল্পটা কিন্তু মজার হতে হবে, আমি স্যাড গল্প পছন্দ করিনা।” তো আমিও ওদের জন্য মজার মজার গল্প জোগাড় করি, না পেলে বানিয়ে বানিয়ে বলি। ওরা তন্ময় হয়ে শোনে।
ইদানিং ছোটু আমার অজান্তেই আমার ফোনে “স্টোরিয অফ প্রফেটস” নামের একটা এ্যপ ডাউনলোড করেছে। সেদিন দেখি বসে বসে নবীদের গল্প রিডিং করছে। খুব ভাল কথা, কিন্তু সমস্যা হল গল্পগুলো ঠিক শিশুতোষ ছিল না। হয়ত দশ বারো বছর বয়সের বাচ্চাদের জন্য ওটা একদম পারফেক্ট এ্যপ কিন্তু ওর বয়সোপযোগি মোটেও না। তাই নবীদের এই গল্পগুলো পড়ার পর তার মনে অনেক প্রশ্ন। যেমন- “আম্মু, আদম (আ) কেন ফরবিডেন ট্রি থেকে ফ্রুট খেয়েছিল? উনি কেন আল্লাহর কথা না শুনে ডেভিল এর কথা শুনেছিল?” কিংবা, “নুহ (আ) কেন ছেলে কেনানকে রেখে বিগ উডেন বোট এ করে চলে গিয়েছিল?” এরকম হরেক প্রশ্ন। তার উত্তরগুলো দিতে আমাকে ভাবতে হয়েছিল। উত্তরগুলো এমনভাবে সাজাতে হয়েছে যেন তার মনে ধর্মের প্রতি অভক্তি না আসে আবার উত্তরগুলো সঠিক ও তার কাছে গ্রহনীয় হয়। ধর্ম শিক্ষার ব্যাপারেও সাধারনত আট নয় বছর বয়সের আগে পাপের শাস্তি কিংবা বিয়োগাত্নক ব্যাপারগুলো না বলাটাই ভাল। তাতে ওদের কোমল মনে ঋণাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।
দেশে গিয়ে দেখলাম,ছোট ছোট বাচ্চা গুলো একাকি বা আর সদস্যদের সাথে বসে স্যাটেলাইটের চ্যানেল গুলোতে দেশী বিদেশী ড্রামা সিরিয়ালগুলো নেশার মত দেখছে। নাটকের ক্লাইমেক্স এ তাদের উত্তেজনা থাকে টানটান, plচোখ মুখের ইম্প্রেশনে এটা স্পষ্ট যে তারা মন মস্তিষ্কের সবটুকু দিয়েই ব্যাপারগুলো গ্রহণ করছে। সময়ে অসময়ে ঠিক নাটকের মত সাজ, কথা বা কাজ করতে তারা একটুও পিছপা হয় না।
ছোটকালের শোনা গল্প, দেখা নাটক, ছবি বা পারিপার্শ্বিকতা থেকে পাওয়া শিক্ষা কিংবা ওদের সাথে ঘটে যাওয়া উভয় ইতিবাচক বা নেতিবাচক আচরণগুলো ওদের জন্য শিক্ষার অনেক বড় অংশ হয়ে যায়, বড় হওয়ার পরও এর বিপরীতে কোন কথা বা উপদেশ সহজে গ্রহন করতে চায় না, হোক ভাল বা মন্দ। আজকের পৃথিবীর বেশীরভাগ কিশোর কিশোরী বা যুবক যুবতিদের প্রধান সমস্যা ডিপ্রেশন,যার অংকুর তৈরী হয়ে যায় শিশুকালে।
ছেলেদের মাঝে পজিটিভ থটস বা ইতিবাচক চিন্তা আর আদর্শিক মনোভাব গড়ে তোলার জন্য আমি সময় পেলেই চাইল্ড সাইকোলজি এন্ড ডেভেলপমেন্ট নিয়ে বিভিন্ন আর্টিকেল পড়ি। কখনো একই বিষয় বারবার পড়ি। এই ব্যাপারে আমার একটা ফ্যান্সি আছে। “বড় হয়ে কি হবে?” জাতীয় একটা কমন প্রশ্ন যদি আমার বাচ্চাদের করা হয়, তাহলে আমি চাই ওরা বলুক “একজন ভাল ও সুখী মানুষ হতে চাই”।
সন্তানের মাঝে পজেটিভ থটস তৈরী করুন (১ম পর্ব) -ফাতিমা খান
Facebook Comments