সাধারণত মা-বাবা জেনেবুঝে শিশুর ওপর নির্যাতন করেন না। কিন্তু তাঁদের অসচেতনতা, শিশু লালন-পালনের অদক্ষতা, মানসিক চাপ, অসুস্থতা, পারিবারিক বা অর্থনৈতিক ঝামেলা, নিজে শৈশবে নির্যাতনের শিকার হওয়া ইত্যাদি কারণে শিশুর ওপর নির্যাতন করে ফেলেন। মা-বাবা একটু সচেতন থাকলে শিশুর ওপর মানসিক নির্যাতন অনেকখানি কমিয়ে আনা সম্ভব। এ ব্যাপারে লিখেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, সাইকোলজিষ্ট তানজির আহমেদ তুষার।
আসুন জেনে নিই, কিভাবে অভিভাবকরা শিশুর ওপর নির্যাতন করে ফেলেন এবং এর প্রভাবই বা কী।
কথা দিয়ে নির্যাতন
অনেক মা-বাবা বা অভিভাবক প্রায়ই শিশুকে বকাঝকা করেন, উঠতে-বসতে খোঁটা বা গালি দেন। এ ছাড়া অপমানজনক কথা বলেন, অতিরিক্ত প্রত্যাশা ও প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারলে তিরস্কার করেন। এতে শিশু কথার মাধ্যমে নির্যাতিত হয়। এসবের মাত্রা বেশি হলে শিশুর মানসিক ও সামাজিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
মাত্রাতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ ও শাস্তি
শিশুকে কথায় কথায় শাস্তি দিলে তা-ও মানসিক নির্যাতন। অনেক অভিভাবক হাসি বা কোনো সৃজনশীল কাজের জন্যও শিশুকে বকা দিয়ে থাকেন। অনেকে আবার শিশুকে কাছে আসতে দেন না বা ‘খারাপ’ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কারো সঙ্গে মিশতে দেন না। এগুলোও মানসিক নির্যাতন। কারণ শিশু মা-বাবার শারীরিক সংস্পর্শে না যেতে পারলে নিঃসঙ্গ বোধ করে। তার সমবয়সী ও চাচাতো-খালাতো-মামাতো-ফুপাতো ভাইবোনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করতে না পারলে তার সঠিক বিকাশ হয় না।
অবজ্ঞা করা
শিশুকে অবজ্ঞা করাও মানসিক নির্যাতন। কারণ এতে শিশুর সব ধরনের বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি হয়। বেশ কয়েক ধরনের অবজ্ঞাজনিত নির্যাতন রয়েছে। যেমন-
মৌলিক অধিকারের বেলায়
প্রতিটি শিশুরই খাদ্য, পোশাক, বাসস্থানের নিশ্চয়তাসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর বিষয় থেকে নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সে অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব অভিভাবকের। সেটি রক্ষা না হলে তা হবে শিশুর জন্য অবজ্ঞাজনিত নির্যাতন।
আবেগীয় অবজ্ঞা
শিশুর মানসিক ও সামাজিক বিকাশে প্রয়োজনীয় ভালোবাসা, আদর-স্নেহ, বুদ্ধি ও আবেগের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্দীপনাসহ যথেষ্ট যত্ন করা না হলে সেটা হবে আবেগীয় অবজ্ঞা বা নির্যাতন।
তদারকির ক্ষেত্রে
অভিভাবকরা একটি ছোট শিশুকে বেশ কিছু সময়ের জন্য একাকী বা খালি বাসায় রেখে কোথাও গেলে শিশুকে তদারকির ক্ষেত্রে অবজ্ঞা করছেন বলে ধরা হয়। এটিও শিশুর জন্য নির্যাতন।
চিকিৎসাগত অবজ্ঞা
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও নানা অজুহাতে শিশুর চিকিৎসা না করানো বা টিকা দিতে বিলম্ব হলে তা হবে চিকিৎসাগত অবজ্ঞাজনিত মানসিক নির্যাতন।
শিক্ষাক্ষেত্রে
শিশুকে তাঁর শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলে, তাঁর স্কুল বা পড়াশোনা সম্পর্কে খোঁজ-খবর না রাখলে, স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক ও সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা না করা হলে এবং সময়মতো স্কুলে পৌঁছানোর ব্যবস্থা না করা হলে শিশু মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়।
মানসিক নির্যাতনের কুফল
শারীরিক নির্যাতনের মতো মানসিক নির্যাতনও শিশুর ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনের তুলনায় মানসিক নির্যাতনের প্রভাব বেশি হয়। এটি শিশুর বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব, আচরণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ ছাড়া তাকে সমাজে মানিয়ে নিতে সমস্যায় ফেলতে পারে। পরে দাম্পত্য, পারিবারিক ও কর্মজীবনে নানা ধরনের অসুবিধায় ফেলে। বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তার মতো মানসিক রোগও হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, গাইনোকোলজিক্যাল সমস্যাসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা হতে পারে শিশুর।