banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1326 বার পঠিত

 

শিশুর চোখের সমস্যার ব্যাপারে সচেতনতা প্রয়োজন


স্বাস্থ্যকথা


আরাফকে (১১) নিয়ে তার বাবা-মা ঢাকার ফার্মগেটে অবস্থিত ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে এসেছেন চোখ পরীক্ষা করাতে। জন্মের পর এটাই আরাফের প্রথম চোখ পরীক্ষা। কারণ, ক’দিন থেকে তার মা দেখছিলেন আরাফ খানিকটা বাঁকাভাবে টেলিভিশন দেখে। এতেই তারা তাকে চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
চিকিৎসক প্রাথমিকভাবে আরাফের চোখ পরীক্ষা করার পর তার পাওয়ার (চোখের শক্তি) পরীক্ষা করার জন্য একজন টেকনিশিয়ানকে নির্দেশ দেন। টেকনিশিয়ান বলেন, আরাফের চোখের পাওয়ার অনেক বেশি এবং তার একটি চোখ অলস (লেজি) হয়ে গেছে।
বিষয়টি কী জানার জন্য চিকিৎসকে বললে তিনি আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, আরাফের ডান দিকের চোখটি অলস হয়ে গেছে এবং বাম চোখ ভালো আছে। তার ডান চোখে চশমার পাওয়ার মাইনাস চার এবং বাম চোখের পাওয়ার মাইনাস দুই। চিকিৎসক জানান, আরাফ অনেক আগে থেকেই দূরের জিনিস কম দেখত। বিষয়টি সে হয়ত বুঝতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে শিশুরা এ ধরনের সমস্যা বুঝতে পারে না।
এই লেজি আই বা অলস চোখ আসলে কী? জানতে চাইলে ঐ হাসপাতালের চক্ষু শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও কনসালটেন্ট ডা. সাজ্জাদ জানান, এটা সাধারণত কম বয়সী শিশুদের হয়ে থাকে। এটা মূলত চোখের সমস্যা নয়, এটা ব্রেনের সাথে চোখের নার্ভের যে সম্পর্ক সেখানে কিছু সমস্যা হয়ে থাকে। বইয়ের ভাষায় এটাকে অ্যামব্ল্যায়োপিয়া বলা হয়। জন্মের পর প্রত্যেক শিশুর দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক থাকে না। শিশু দেখতে দেখতে তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। শিশুর রেটিনার আলোক সংবেদনশীল কোষগুলোর ওপর আলো পড়লে আলোর উপস্থিতিতে সেগুলো পরিপূর্ণতা লাভ করতে থাকে। সাধারণত ছয় থেকে নয় বছরের মধ্যে তা পরিপূর্ণতা লাভ করে অর্থাৎ চোখ স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি প্রাপ্ত হয়। কিন্ত কোনো কারণে চোখের রেটিনায় যদি আলো না পড়ে কিংবা জন্মগত ছানি হলে অথবা লেন্স ঘোলা হলে রেটিনায় আলো পড়ে না। আবার জন্মগত ভাবে চোখের পাতা নিচের দিকে পড়ে গেলে চোখের যে স্বচ্ছ অংশ কর্ণিয়া দিয়ে আলো প্রবেশ করে, তা যদি ঢেকে যায় তাহলে পর্যাপ্ত আলো চোখে প্রবেশ করতে পারে না। এভাবে কোনো একটি চোখ ব্যবহার না হলে বা জন্মগত ট্যারা হলে ঐ চোখের দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এক সময় দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি হারিয়ে গিয়ে সে অন্ধ হয়ে যায়। এটাই হলো অলস চোখ বা অ্যামব্ল্যায়োপিয়া।
শিশুদের চোখে নানা ধরণের সমস্যা হতে পারে। এর মধ্যে পাওয়ারের সমস্যা বেশি দেখা যায়। তবে অলস চোখের বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি সময়মতো চিকিৎসা না করালে সারাজীবন তাকে ভুগতে হয়। এমনকি সে এক সময় অন্ধ হয়ে যেতে পারে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ‘পৃথিবীতে ১ দশমিক ৪ মিলিয়ন শিশু অন্ধত্বে ভুগছে। এরমধ্যে চার ভাগের তিন ভাগ শিশু এশিয়া ও আফ্রিকার গরীব দেশগুলোতে বাস করে। বাংলাদেশে শিশু অন্ধত্বের বিষয়টি তেমনভাবে পরিচিত নয়। এখানে প্রায় ৪০ হাজার শিশু অন্ধত্বের শিকার।’
ডা. সাজ্জাদ আরো বলেন, ‘চোখ অলস হলে, নয় বছরের মধ্যে চিকিৎসা করানো হলে, সম্পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তÍু অবহেলা বা অজ্ঞতার কারণে যদি এ সময় পার হয়ে যায় তাহলে চিকিৎসা করেও ভালো ফল পাওয়া সম্ভব নয়। যেসব কারণে চোখ অলস হয়ে যায় তার সঠিক চিকিৎসা করালে পুরোপুরি ভালো হয়। জন্মগতভাবে যদি শিশুর চোখে ছানি থাকে, তাহলে দ্রুত ছানির অপারেশন করাতে হবে। বয়স নয় বছর পেরিয়ে গেলে অপারেশন করেও তেমন ফল পাওয়া যায় না। এ রোগের চিকিৎসা হিসেবে শিশুকে চশমা ব্যবহার এবং প্যাচ থেরাপি দুটোই দিতে হয়।’
ডা. সাজ্জাদ বলেন, ‘প্যাচ থেরাপি কঠিন কিছু নয়। ভালো চোখটি কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে বা বন্ধ করে রাখা হয়। আর অলস চোখটি দিয়ে শিশুকে কাজ করাতে হয়। এসময় শিশু অলস চোখ দিয়ে হোমওয়ার্ক, ছবি আঁকা, গেম খেলা বা টেলিভিশন দেখার কাজ করবে। মনে রাখতে হবে এসময় যা কিছু করা হোক না কেন তা গভীর মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। এভাবে কাজ করালে চোখের রেটিনার আলোক সংবেদনশীল কোষগুলো আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ ধরণের চোখের ব্যায়াম বা অ্যাকুলেশন থেরাপি করে দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। এ রোগে অনেক সময় শিশুর চোখ ট্যারা হয়ে যায়। চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়নে ট্যারা চোখের চিকিৎসা করানো যায়।’
চিকিৎসকরা বলেছেন, শিশু যদি চোখে ঝাঁপসা দেখে, তার চোখের কালো মনি ধূসর বা সাদা হয়, দূরের বা কাছের জিনিস ভালো না দেখে, টেলিভিশন খুব কাছ থেকে দেখে কিংবা স্কুলে ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা বুঝতে না পারে তাহলে দেরি না চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন।
আরাফের মা বলেন, যে কোনো সমস্যা হলেই আরাফ তাকে জানাতো। কিন্তু চোখের সমস্যার বিষয়ে কখনো কিছু বলেনি এবং চোখে কম দেখার বিষয়ে নেতিবাচক কিছু তাদের চোখেও পড়েনি। হঠাৎ করেই এ ধরণের সমস্যা হওয়ায় তারা অনেক ঘাবড়ে গেলেও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলছেন এবং দিন দিন ছেলের চোখের অগ্রগতি হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, এখন বুঝতে পারছি চিকিৎসকরা কেন পাঁচ বছরের মধ্যে শিশুকে চোখের ডাক্তার দেখার কথা বলেন এবং কোনো সমস্যা না থাকলেও প্রত্যেক বছর একবার করে চোখের ডাক্তার দেখা কেন জরুরি। এতে শিশু একেবারে অন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে অনেক সময় পাওয়া যায়। সময়মতো চিকিৎসা এবং যত্ন নিলে শিশু অন্ধতে¦র হাত থেকে শিশু বাঁচতে পারে। এজন্য সচেতনতা প্রয়োজন। চিকিৎসকরা বলেছেন, পাঁচ বছর বয়সে বা স্কুলে দেয়ার আগে শিশুর চোখ পরীক্ষা করে নেয়া উচিৎ এবং নিয়ম করে প্রতি বছর একবার করে শিশুকে চোখের ডাক্তারের কাছে চোখ পরীক্ষা করে নিতে হবে।

সুত্র: বাসস।

Facebook Comments