রোজা হচ্ছে ‘তাকওয়া’ অর্জনের সর্বোত্তম ট্রেনিংকোর্স। একজন মানুষ যতবড় পাপিষ্ঠ কিংবা যেমনই হোক না কেন রোজা রাখার পর তার অবস্থা এমন হয় যে, প্রচণ্ড গরমের দিনে পিপাসায় কাতর সে, একাকী কক্ষে, অন্য কেউ সাথে নেই, দরজা-জানালা বন্ধ, কক্ষে রয়েছে ফ্রিজ, ফ্রিজে রয়েছে শীতল পানি-এমনি মুহূর্তে তার তীব্র চাহিদা হচ্ছে, এ প্রচণ্ড গরমে এক ঢোক ঠাণ্ডা পানি পান করার। তবুও কি এ রোজাদার লোকটি ফ্রিজ থেকে শীতল পানি বের করে পান করে নিবে? না, কখনোই না। অথচ লোকটি যদি পান করে, জগতের কেউই জানবে না। তাকে কেউ অভিশাপ কিংবা গালমন্দও করবে না। জগতবাসীর কাছে সে রোজাদার হিসেবেই গণ্য হবে। সন্ধ্যায় বের হয়ে সে লোকজনের সাথে ইফতারও করতে পারবে। কেউই জানবে না তার রোজা ভঙ্গের কথা। কিন্তু সে পান করবে না। কারণ, সে ভাবে যে, অন্য কেউ না দেখলেও আমার মালিক যার জন্য রোজা রেখেছি তিনি তো আমায় দেখছেন। তাছাড়া আর কোনো কারণ নেই।
রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা তাকওয়া অর্জন করতে বলেছেন। অর্থাৎ রোজার মাধ্যমে তিনি অন্তরের মাঝে তাকওয়া বা আল্লাহভীতির আলোক প্রজ্জ্বলিত করতে বলেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘রোজা আমার জন্যই, সুতরাং আমিই এর প্রতিদান নিজ হাতেই দেবো।’
আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হওয়ার এবং জবাবদিহিতার ভয়ের অনুভূতি হৃদয়ে জাগ্রত হওয়াকেই বলে ‘তাকওয়া’। এজন্যই শাহ আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলেছেন, ‘রোজা দ্বারা শুধুমাত্র পশুসুলভ চরিত্রের মৃত্যু ঘটবে এমন নয়, বরং বিশুদ্ধ রোজা মানেই তাকওয়ার উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সিঁড়ি।’
ইমাম গাযযালী (রহঃ) তার স্বভাবসুলভ দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সিয়ামের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘আখলাকে ইলাহী তথা আল্লাহর গুণে মানুষকে গুণান্বিত করে তোলাই হচ্ছে সিয়ামের উদ্দেশ্য। সিয়াম মানুষকে ফেরেশতাদের অনুকরণের মাধ্যমে যতদূর সম্ভব নিজেকে প্রবৃত্তির গোলামী থেকে মুক্ত হওয়ার শিক্ষা দেয়। কেননা ফিরিশতাগণ সকল চাহিদা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং মানুষের মর্যাদাও হচ্ছে পশুর চেয়ে বহু ঊর্ধ্বে। জৈবিক চাহিদা মুকাবিলা করার জন্য তাকে দান করা হয়েছে বিবেক ও বুদ্ধির আলো। অবশ্য এক দিক দিয়ে তার স্থান ফেরেশতাদের নীচে। জৈবিক চাহিদা ও পাশবিক কামনা অনেক সময় তার উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হয় এবং তার ভেতরের এ পশুত্ব দমন করতে তাকে কঠোর সাধনা করতে হয়। তাই মানুষ যখন পাশবিক ইচ্ছার সুতীব্র স্রোতে গাঁ ভাসিয়ে দেয়, তখন সে নেমে আসে অধঃপতনের নিম্নতম স্থানে। অরণ্যের পশু আর লোকালয়ের মানুষে কোনো প্রভেদ থাকে না তখন। আর যখন সে তার পাশবিকতা দমন করতে সক্ষম হয়, তখন তার স্থান হয় নূরের ফেরেশতাদেরও ওপরে।’ (এহয়াউল উলুম, খণ্ড-১, পৃষ্টা ২১৬)
রোজার আরেকটি মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- আল্লাহ তা’আলার হুকুম পালন। এমনকি পুরো দ্বীনের মূল কথাই হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুম পালন করা। যখন বলবেন, খাও তখন খাওয়াটাই ‘দ্বীন’। যখন বলবেন খেও না- তখন না খাওয়াটাই ‘দ্বীন’। আল্লাহ তা’আলার দাসত্ব স্বীকার আর আনুগত্যের এক বিস্ময়কর পদ্ধতি তিনি রোজার মাধ্যমে বান্দাকে দিয়েছেন। তিনি দিনব্যাপী রোজা রাখার হুকুম দিলেন, তার জন্য বহু সওয়াব বা প্রতিদান রাখলেন। অন্যদিকে সূর্যাস্তের সাথে সাথে তাঁর নির্দেশ- ‘তাড়াতাড়ি ইফতার করে নাও।’ ইফতারে তাড়াতাড়ি করাটা আবার মুস্তাহাব হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। বিনাকারণে ইফতারে বিলম্ব করাকে মাকরুহ হিসেবে আখ্যায়িত করলেন।
কেন মাকরুহ? যেহেতু সূর্যাস্তের সাথে সাথে আল্লাহ তা’আলার হুকুম হচ্ছে ইফতার করে নেয়ার। যেহেতু এখন যদি না খাওয়া হয়, যদি ক্ষুধার্ত থাকা হয়, তবে এ ক্ষুধার্ত অবস্থা আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় নয়। কারণ, সকল কিছুর মৌলিক উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর আনুগত্য-দাসত্ব প্রকাশ করা, নিজ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা নয়।
আবার সেহরির সময় বিলম্ব করে খাওয়া উত্তম। তাড়াতাড়ি খাওয়া সুন্নত পরিপন্থি। অনেকে রাত ১২টার সময় সাহরি খেয়ে শুয়ে পড়ে, এটা সুন্নতের পরিপন্থি। সাহাবায়ে কেরামের এ অভ্যাস ছিল যে, তাঁরা সাহরি শেষ সময় পর্যন্ত খেতেন। কারণ, সাহরি শেষ সময়ে খাওয়া শুধুমাত্র অনুমতিই নয়; বরং হুকুমও। আল্লাহ তা’আলার আনুগত্য তো এরই মাঝে নিহিত।
তাই হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী (রহ) বলেছেন, ‘যখনই আল্লাহ তা’আলা খাওয়ার নির্দেশ দেন, তখন বান্দা যদি বলে- খাবো না কিংবা বলে -আমি কম খাই, তাহলে এটা তো আনুগত্যের প্রকাশ হলো না। আরে ভাই! খাওয়ার আর না খাওয়ার মাঝে কিছু নেই। সকল কিছুই হচ্ছে তাঁর আনুগত্যের মাঝে। অতএব, যখন তিনি বলেন -খাও, তখন খাওয়াটাই ইবাদাত। তখন না খেয়ে নিজের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত আনুগত্য প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই।’